শৈত্যপ্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত

সারাদেশে জেঁকে বসেছে শীত। ঘন কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। উত্তরাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় গুঁড়ি গুঁড়ি কুয়াশা পড়ছে। গতকাল শনিবার সারাদিন বহু স্থানে সূর্যের দেখা মেলেনি। হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চলাচল করেছে। ঘন কুয়াশার কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ১১ ঘণ্টা এবং মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটে ৮
ঘণ্টা নৌযান চলাচল বন্ধ ছিল। কুয়াশায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের সিডিউলও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।


আবহাওয়া অধিদফতরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ সমকালকে বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আজ রোববারও তা অব্যাহত থাকতে পারে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে আগামীকাল সোমবার থেকে। তিনি আরও বলেন, উত্তর-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বিস্তার ঘটায় গত দু'দিন আগে উত্তরাঞ্চলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়। গতকাল শনিবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল যশোরে, ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তীব্র শীতে কুড়িগ্রামের উলিপুরে ৩ জন, নীলফামারীর ডিমলায় ৩ জন, ডোমারে ২ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ২ শিশু, রাজশাহীতে একজন, কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে একজন, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় একজন, পিরোজপুরের জিয়ানগরে একজন ও যশোরে একজন মারা গেছেন। এছাড়া গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে নিউমোনিয়ায় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়। গরম কাপড়ের অভাবে দুর্ভোগে পড়েছেন দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষ। বিভিন্ন জায়গায় শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও তা অপ্রতুল।
আবহাওয়া অফিস জানায়, সোমবার থেকে তাপমাত্রা বাড়তে পারে। ধীরে ধীরে শীত কমবে। তবে মাসের শেষ ভাগে অথবা জানুয়ারির শুরুতে আবার শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় কক্সবাজারে ২৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বনিম্ন ছিল ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া চট্টগ্রামে ১৪ দশমিক ২, রাজশাহীতে ৭ দশমিক ৪, রংপুরে ১০ দশমিক ৪, খুলনায় ১০, বরিশালে ৯ দশমিক ৮ এবং সিলেটে ১৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
ব্যুরো, নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর :
উলিপুর (কুড়িগ্রাম) : শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গল ও বুধবার রেড ক্রস এলাকার নইমুদ্দিন, অনন্তপুরের রহিম উদ্দিন ও রামপুরের মিছির উদ্দিন মারা গেছেন বলে জানান হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন। গত ৩ দিনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে সায়েম, সুমি, রাফিজা, লিপি, আয়মনসহ ২৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
গাইবান্ধা : শীতজনিত রোগে শুক্রবার রাতে উত্তর মরুয়াদহ গ্রামের রাধা রানী ও ধুমাইটারী গ্রামের ফুল মিয়া মারা গেছেন। সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, কোল্ড ডায়রিয়াসহ শীতজনিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। বৃদ্ধ ও শিশুরা এসব রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
নীলফামারী : শীতে ডিমলা উপজেলার গয়াবাড়ীর অপিতন বেওয়া গতকাল এবং আটঘরিয়াপাড়ার আফির উদ্দিন শুক্রবার মারা গেছেন বলে তাদের পরিবার জানায়। সর্দি-কাশি ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
ডোমার : শীতে উপজেলার সোনারায়ের শহীদুল, হরিণচড়ার লুৎফর রহমান এবং ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই এলাকার কেটু মামুদ মারা গেছেন বলে তাদের পরিবার জানায়। এছাড়া ডোমার উপজেলার চিকনমাটি এলাকার ইছাহাক আলী (৮০) শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সর্দি-কাশি-জ্বরসহ শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন দুই থেকে তিনশ' লোক হাসপাতালে আসছেন।
ঠাকুরগাঁও : তিনদিনে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে সদর হাসপাতালে ১২০ শিশু ভর্তি হয়েছে। বৃহস্পতিবার আমেনা ও শুক্রবার রুবেল নামে ২ শিশু মারা গেছে।
রাজশাহী : রাজশাহী অঞ্চলে একদিনের ব্যবধানে তাপামাত্রা কমেছে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। গতকাল শীতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। ভোরে বাস টার্মিনাল এলাকায় ছিন্নমূল ওই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।
গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা) : নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে উপজেলার সাহেবগঞ্জ গ্রামের এনামুলের ছেলে রিপন মারা গেছে।
তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ) : শীতের তীব্রতায় শুক্রবার উপজেলার সাচাইল গ্রামের গিয়াস উদ্দিন ভূঁইয়ার মৃত্যু হয়েছে। কয়েক দিন ধরে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শতাধিক লোক হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : গতকাল জাকির হোসেন (৪০) নামে এক ইটভাটা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
জিয়ানগর (পিরোজপুর) : বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলার ইন্দুরকানী গ্রামের আবুবকর মীর মারা গেছেন বলে তার পরিবার জানিয়েছে।
যশোর : গতকাল যশোরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতে শুক্রবার রাতে যশোরে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। অজ্ঞাতপরিচয় ওই বৃদ্ধ শহরের সার্কিট হাউসের সামনে যাত্রী ছাউনিতে বেশ কয়েক দিন ধরে অবস্থান করছিলেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ : হাড় কাঁপানো শীতে দুর্ভোগে পড়েছেন হতদরিদ্র-ছিন্নমূল মানুষ। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে আসছেন না। শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া ও হাঁপানি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
গোপালগঞ্জ : কনকনে শীতে কাঁপছে গোপালগঞ্জের ৫ উপজেলার চর ও ১১৪টি বিলপাড়ের ৫ লাখ মানুষ। খেটে খাওয়া মানুষ ও কৃষক পড়েছেন চরম দুর্ভোগে।
ঈশ্বরদী :শৈত্যপ্রবাহে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। গতকাল এখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
পার্বতীপুর (দিনাজপুর) : গতকাল ৭ শিশু নিউমোনিয়া ও ২ বৃদ্ধ এজমার সমস্যায় উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
ধামরাই (ঢাকা) : ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫ শতাধিক শিশু ও বৃদ্ধ ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কালামপুর জনতা, রয়েল ক্লিনিক ও হলি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়।
খুলনা : গতকাল খুলনায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শিশু হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ধুনট (বগুড়া) : নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।
সিরাজগঞ্জ : গতকাল সকালে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সোনতলা গ্রামের ৩শ' শীর্তাত ও দুস্থ মানুষের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের কম্বল বিতরণ করেন জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম।
ভা ারিয়া : জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গতকাল ভা ারিয়া উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে দুস্থ, অসহায় ও শীতার্ত মানুষের মধ্যে কম্বল বিতরণ করেন।
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় ১১ ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) :ঘন কুয়াশায় শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ফেরিসহ সব নৌযান চলাচল বন্ধ ছিল।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার দৌলতদিয়া কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান জানান, কুয়াশার ঘনত্ব বাড়তে থাকলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে রাত সাড়ে ১১টা থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় দৌলতদিয়া ঘাটে শাহ পরান, হামিদুর রহমান, মাঝ নদীতে শাহ জালাল, খান জাহান আলী এবং পাটুরিয়া ঘাটে শাহ আমানত, মতিউর রহমান, শাহ আলী, কেরামত আলী, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর ও ফেরি কুমারী যানবাহন বোঝাই করে নোঙর করে থাকে। কুয়াশা কমে গেলে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ফেরি চলাচল শুরু হয়। কয়েকদিন ধরে দূরপাল্লর যানবাহন এ ঘাট দিয়ে না আসায় তেমন যানজট ছিল না।
মাওয়ায় যানজট
লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) : ঘন কুয়াশায় মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটে গতকাল ফেরি চলাচল ৮ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। বিভিন্ন পয়েন্টে আটকাপড়ে ৯টি ফেরি। উভয় ঘাটে সৃষ্টি হয় যানজট। চরম দুর্ভোগের শিকার হন যাত্রীরা।
বিআইডবি্লউটিসি মাওয়া অফিসের ম্যানেজার (বাণিজ্য) চন্দ্র শেখর জানান, ঘন কুয়াশায় শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঘাট থেকে ছেড়ে আসা ফেরিগুলো পদ্মার বিভিন্ন পয়েন্টে নোঙর করে রাখা হয়। সকাল ৮টার দিকে কুয়াশা কমলে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হয়।
পটুয়াখালী : ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে বাস ও লঞ্চ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.