জেলা পরিষদ নির্বাচন কবে-প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে মহাজোটে অসন্তোষ by শাহেদ চৌধুরী ও শরীফুল ইসলাম

জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জেলা পরিষদ আইনেও নির্বাচনের বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। এ কারণে পূর্ণাঙ্গ জেলা পরিষদ গঠন এবং আদৌ নির্বাচন হবে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। এ জন্য আইন সংশোধন করা হবে। এদিকে প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। অকার্যকর জেলা পরিষদ কার্যকর


করতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলেও এ নিয়ে শুরুতেই শুরু হয়েছে নানা বিপত্তি। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রশাসক নিয়োগকে অসাংবিধানিক হিসেবে অভিহিত করেছে। মহাজোট সরকারের শরিকদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। জেলা পরিষদ আইনে বলা হয়েছে, জেলা পরিষদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত একজন প্রশাসক পরিষদের কার্যাবলি সম্পাদন করবেন। তবে নির্বাচন
কবে হবে এবং প্রশাসক কত দিন দায়িত্ব পালন করবেন তার কোনো সময়সীমা আইনে উল্লেখ নেই। এ নিয়ে আজ রোববার সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে একটি সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সেই সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে জেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত স্পষ্ট কিছু বলেনি। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন সমকালকে বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের চিঠি পাওয়ার পর জেলা পরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে আগাম কিছুই বলা যাবে না।
মেয়াদ শেষের দিকে থাকায় বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজনে অনীহা দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে জেলা পরিষদ নির্বাচনে আগ্রহী নন সরকারি দল আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। তারা নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে এই নির্বাচনে আগ্রহী। সে ক্ষেত্রে বর্তমান নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে যেতে পারে, যা নতুন কমিশনের জন্য সহায়ক হবে।
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলেছেন, জেলা পরিষদ প্রশাসকদের মেয়াদ ছয় মাস পেরোনোর আগেই নির্বাচনের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে জেলা পরিষদ আইন-২০০০ সংশোধন করা হবে। এতে প্রশাসক নিয়োগের কত দিন পর নির্বাচন হবে তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে।
আইন সংশোধন না করে বিদ্যমান আইনে নির্বাচন আয়োজনেরও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আজকালের মধ্যেই আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসবে স্থানীয় সরকার বিভাগ। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণের বিধান রয়েছে। এর ভিত্তিতে নির্বাচন করা যায় কি-না তাও ভাবনায় রাখা হয়েছে।
এমনটা হলে দ্রুতই প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচনের সময়সীমা জানিয়ে দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে নির্বাচন কমিশন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে আগামী বছরের মার্চ মাসের শেষদিকে জেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর আইন সংশোধন করা হলে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের বিধান রাখা হবে। সে ক্ষেত্রে জুলাইয়ের আগে নির্বাচন হবে না।
মহাজোটে ক্ষোভ-অসন্তোষ
জেলা পরিষদ প্রশাসক পদে নিয়োগের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে ক্ষোভ-অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে মহাজোটের শরিকদের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শরিক রাজনৈতিক দলগুলোকে সামান্যতম মর্যাদাও দেওয়া হয়নি।
কোনো রাখঢাক না রেখেই জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছেন, আওয়ামী লীগ আরেকবার সাইজ করেছে জাতীয় পার্টিকে। জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের আগে তারা জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনা করার মতো সৌজন্যবোধও দেখায়নি। এমনকি পার্টি চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের সঙ্গেও কথা বলেনি। এ অবস্থায় আজ রোববার সকাল ১১টায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানীর অফিসে যৌথ সভা ডাকা হয়েছে। এই বৈঠকে প্রশাসক নিয়োগের বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যরাই প্রশাসক নিয়োগের খবর জানতেন না। সেখানে এই খবর ওয়ার্কার্স পার্টি পাবে কোত্থেকে। আর প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। অথচ এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই আলোচনা করা উচিত ছিল। মেননের ক্ষোভ, এমনিতেই সরকারের কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ নেই; তাই তাদের না জানিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করায় তারা বিস্মিত হননি।
সড়ক অবরোধ
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি পঙ্কজ দে জানিয়েছেন, ব্যারিস্টার এনামুল কবীর ইমনকে প্রশাসক নিয়োগ করার প্রতিবাদে শনিবার জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলকারীরা স্টেশন রোড এবং যুবলীগের উকিলপাড়া কার্যালয়ের সামনে টায়ার জ্বালিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে।
এ সময় ট্রাফিক পয়েন্ট এলাকায় এক পথসভায় করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল, ফজলুর রহমান, জসিম উদ্দিন দিলীপ, শংকর দাশ, আরমানুল সিদ্দিক মান্না, সিমন চৌধুরী, শাহাব উদ্দিন, সুব্রত সরকার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। তারা ব্যারিস্টার এনামুল কবীর ইমনের নিয়োগ বাতিল করে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা মুকুটকে নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান।
এ ছাড়া বিশ্বম্ভরপুরে ইমনকে প্রশাসক নিয়োগ করার পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল হয়েছে। শুক্রবার উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শামসুজ্জামান শাহ, সাধারণ সম্পাদক বেনজির আহমদ মানিক, আবদুল কাইয়ুম মাস্টার, রফিকুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বে বিপক্ষে এবং শনিবার সফর উদ্দিন, সোলেমান মিয়া, ওলিমান, নুরুল, তৈয়বুর ও লুৎফুর রহমানের নেতৃত্বে আনন্দ মিছিল হয়েছে।
অসাংবিধানিক এবং রিট
বৃহস্পতিবার জেলা পরিষদ প্রশাসক নিয়োগের পর বিএনপিসহ বিভিন্ন সংগঠন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। তাদের মতে, এই নিয়োগ অসাংবিধানিক। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, প্রশাসক নিয়োগ অসাংবিধানিক নয়। জেলা পরিষদ পরিচালিত হয় আইনের মাধ্যমে। কোনো আদালতই এ আইন বাতিল করেননি। আইনটি এখনও বলবত রয়েছে। এ আইনে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই।
২০০০ সালের ৩ জুলাই প্রশাসক নিয়োগের বিধান যুক্ত করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার জেলা পরিষদ আইনের সংশোধনী আনে। ওই সময়ে লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট খায়রুল আনাম আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দায়ের করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি) এবং বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ জেলা পরিষদ আইনের নির্বাচকম লী ও প্রশাসক নিয়োগের বিধান দুটি কেন অসাংবিধানিক এবং বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এ মর্মে ২০০০ সালের ১৯ জুলাই সরকারের প্রতি রুল জারি করেছিলেন।
এই রুলটির এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। হাইকোর্টে এই রুলের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসক নিয়োগে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বর্তমানে রিট আবেদনটি চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এমন পরিপ্র্রেক্ষিতে সরকার জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া যাবে না এমন কোনো রায় হাইকোর্ট দেননি। তারা একটি রিট আবেদনের পরিপ্র্রেক্ষিতে আইনের দুটি বিধান কেন অবৈধ নয় সেটা জানতে চেয়েছেন। এ অবস্থায় প্রশাসক নিয়োগে কোনো বাধা নেই। এমন বিবেচনায়ই সরকার জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে।
প্রশাসকরা দায়িত্ব নেবেন কাল
আজ রোববার প্রশাসক নিয়োগের গেজেট প্রকাশ করা হবে। আগামীকাল সোমবার থেকেই প্রশাসকরা দায়িত্ব নেবেন। তারা আপাতত পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের গাড়ি ব্যবহার করবেন। প্রয়োজনে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাও এই গাড়ি ব্যবহার করবেন। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ পাওয়ার পরপরই প্রশাসকদের জন্য গাড়ি কেনা হবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে প্রশাসকদের জন্য গাড়ি, আসবাবপত্র, জনবলের জন্য অর্থ বিভাগের কাছে ২শ' কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিন মাসেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এর জবাব আসেনি। স্থানীয় সরকার বিভাগ এই অর্থ ছাড় করার জন্য আজ রোববারই অর্থ বিভাগকে তাগিদপত্র দেবে। প্রশাসকরা উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা পাবেন। তারা সরকারি বাসভবন, কর্মচারী, নিরাপত্তা রক্ষীসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন।
তিনি স্বাধীনতাবিরোধী নন
শনিবার সমকালে 'অনেক বিতর্কিত নেতা : দলে ক্ষোভ' শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের একাংশের ব্যাখ্যা দিয়েছেন নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী খান খসরু এমপি। তিনি বলেছেন, জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মতিয়ার রহমান খান সৎ, নিষ্ঠাবান ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক। তাকে জড়িয়ে মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা আবু সিদ্দিক আহমেদ। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নন, পদত্যাগ করেছেন। মতিয়ার রহমান খান স্বাধীনতাবিরোধী_ এ অভিযোগ সত্য নয়। তার বিরুদ্ধে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অসত্য, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছেন আবু সিদ্দিক আহমেদ।
এদিকে শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুর রব মুন্সী বলেছেন, শরীয়তপুরের প্রশাসক মজিবুর রহমান মাস্টারের নিয়োগে জেলা সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে ক্ষুব্ধ হননি। তিনি তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.