জয়পুরহাট-২ আসন : বিএনপি-এ যেন ডাবল কমিটির হাট

য়পুরহাট-২ আসনটি দীর্ঘদিন থেকেই বিএনপির দখলে। ১৯৯১ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য এ আসনে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবু ইউসুফ মো. খলিলুর রহমান বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দল পরিবর্তন করলে এ আসনে নতুন মুখ ছাত্রনেতা ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা দলের মনোনয়ন লাভ করেন। দলে নতুন মুখের কারণে দল থেকে অনেক নেতা-কর্মী প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে তাঁর


বিরোধিতা করেন। ফলে মাত্র তিন হাজার ১৫৯ ভোটে তিনি জয়লাভ করেন। নির্বাচনের পর দলে অবস্থান পোক্ত করতে নতুন এই সংসদ সদস্যকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। নিজেদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী মিছিল, সমাবেশ, এমনকি ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। যে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তিনটি উপজেলাতেই বিএনপির দুটি করে কমিটি রয়েছে। সাবেক ও বর্তমানের এই নেতৃত্বের কোন্দল আগের চেয়ে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও বর্তমান সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা সমর্থিত কমিটিগুলোই মূলত দলের সব কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মোস্তফা সমর্থকদের দাবি, এলাকায় দল গঠনে স্থানীয় সংসদ সদস্য অগ্রাধিকার পাবেন_এটা কেন্দ্রেরই ঘোষণা। কাজেই 'জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করলে' খেসারত তাদেরই দিতেই হবে।
কালাই : কালাই উপজেলায় বিএনপির পাল্টাপাল্টি কমিটি থাকলেও বর্তমানে মোস্তফা সমর্থিত নেতা-কর্মীরাই এখানে সক্রিয়। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী উপজেলা কমিটির অনুমোদন সাধারণত জেলা কমিটি দিয়ে থাকে। কিন্তু জেলা নেতৃত্বের কোন্দলে কোণঠাসা স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা তাঁর এলাকার প্রতিটি কমিটির অনুমোদন নিয়েছেন কেন্দ্র থেকে। আর সংসদ সদস্যের বিরোধী পক্ষ কমিটির অনুমোদন নিয়েছে জেলা কমিটি থেকে। এখন বৈধ কমিটি কোনটি_এ নিয়েই চলছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক। দলের সার্বিক কর্মকাণ্ড এখন তাঁদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হচ্ছে দাবি করে মোস্তফা সমর্থিত উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মওদুদ আলম বলেন, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রয়াত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ৭১ সদস্যবিশিষ্ট কালাই উপজেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দিয়েছেন। কাজেই এই কমিটির বৈধতা নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকার কথা নয়। তিনি বলেন, দলের ত্যাগী প্রবীণ ও নবীন নেতা-কর্মীদের নিয়েই দল গঠন করা হয়েছে। বিরোধী দলে থেকেও সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা এলাকার উন্নয়নে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু রাস্তা পাকাকরণসহ এলাকার বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংস্কারকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে জানিয়ে মওদুদ বলেন, কালাইয়ে বিএনপি এখন আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।
তবে জেলা কমিটি অনুমোদিত কালাই উপজেলা বিএনপির অপরাংশের সভাপতি ও পুনট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম হোসেন ফকির দল বিভাজনে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফাকে দায়ী করে বলেন, দলে যাঁরা নিবেদিত ও পরীক্ষিত সেসব নেতা-কর্মীকে বাদ দিয়ে কমিটি গঠন করায় দলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, 'গঠনতন্ত্র মোতাবেক দল পরিচালিত হোক এটা, আমিও চাই। কিন্তু নেতা-কর্মীর মুল্যায়ন না করে নিজের খেয়াল-খুশিমতো দল পরিচালিত হলে আগামী নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বললেই বাস্তব এ পরিস্থিতির সত্যতা মিলবে বলে তিনি দাবি করেন।
ক্ষেতলাল : ক্ষেতলাল বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখনো দ্বিধাবিভক্ত দলীয় বিভাজনে। একসময় দলে যাঁদের প্রচণ্ড দাপট ছিল, এখন সেসব নেতা-কর্মী যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তাঁদের অনেককেই আর মিছিল-সমাবেশে পাওয়া যায় না। সেলিম নামের তাঁদেরই একজন বলেন, 'দলকে ভালোবেসে নিবেদিতভাবে কাজ করেছি। মাইকিং থেকে শুরু করে মিছিলে স্লোগানসহ প্রচারের জন্য এমন কোনো কাজ নেই, যা করিনি। কিন্তু নেতৃত্ব বিভাজনে আজ সেসবের কোনো মূল্যই নেই নেতাদের কাছে।' জেলা কমিটি অনুমোদিত ক্ষেতলাল উপজেলা বিএনপির একাংশের সঙ্গে আছেন দলের নিবেদিত এই ছাত্রদল নেতা সেলিম। তাঁর দাবি, 'তাঁদের মতো অনেক পরিচিত ও বিএনপির পরীক্ষিত নেতাকে বাদ দিয়ে ক্ষেতলাল উপজেলা বিএনপির পাল্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশক্রমে। সম্মেলনের দিন আমরা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছি। পরে তাঁরা উপজেলা সদর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে নির্জন স্থানে গিয়ে কমিটি গঠন করেন। অথচ ওই কমিটির অনেক নেতা-কর্মী আছে, যাঁদের এলাকায় তো দূরের কথা দলেই কোনো ফেসভ্যালু নেই।'
তবে এসব অভিযোগের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন মোস্তফা সমর্থিত উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুজ্জামান মৃধা। তিনি বলেন, দলের চেইন অব কমান্ড বজায় রেখে এখন সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।
ক্ষেতলাল উপজেলা বিএনপির অপরাংশের সভাপতি রওনকুল ইসলাম চৌধূরী টিপু বলেন, বিএনপির ত্যাগী ও পরীক্ষিত অনেক নেতা-কর্মী বাদ দিয়ে বিতর্কিত কমিটি করার অভিযোগে দলীয় কার্যালয়ে এখনো কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি এলাকার সংসদ সদস্য। এ থেকেই বোঝা যায় সংসদ সদস্যের কর্মকাণ্ডে নেতা-কর্মীরা কতটা ক্ষুব্ধ। দলের প্রতিটি কর্মকাণ্ড তাঁদের নেতৃত্বেই এখনো সফল ও জাঁকজমকভাবে পালন করার দাবি করে তিনি বলেন, 'এ উপজেলার অধিকাংশ নেতা-কর্মীই আমাদের সঙ্গে আছেন।'
আক্কেলপুর : এ উপজেলা বিএনপিতেও রয়েছে নেতৃত্বের কোন্দল। তবে সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফার বাড়ি এখানে হওয়ায় তাঁর অবস্থান অনেকটা মজবুত। দলে স্থান পেতে ইদানীং লায়ন বিদু্যুত নামের ধনাঢ্য এক ব্যক্তির পদার্পণে আক্কেলপুরে দলের কর্মসূচি পালন নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছে। বিগত হরতালে দুই পক্ষের বিপরীতমুখী অবস্থানে উভয়পক্ষের কয়েক নেতা-কর্মী আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। লায়ন বিদ্যুত জয়পুরহাট-২ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেতে মাঠে কাজ করছেন। যার ফলে এখানে দলীয় কর্মকাণ্ডে নেতা-কর্মীরা মোস্তফা ও বিদ্যুত গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে কাজ করছেন। আক্কেলপুর পৌর মেয়র আলমগীর চৌধুরী বাদশা বলেন, দলে একসময় বিভক্তি থাকলেও বর্তমানে নেতা-কর্মীরা সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন। বিএনপি একটি বড় দল, কাজেই এখানে কিছু মতপার্থক্য থাকলেও দলের মূল স্রোতধারায় সেটা কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
কমিটি নিয়ে বিরোধ থাকলেও জয়পুরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা দলে কোনো প্রকার কোন্দল নেই দাবি করে বলেন, জেলায় যেসব থানা ও পৌর কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে নিয়েই দলের সব কর্মকাণ্ড শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা হচ্ছে। তাঁর এলাকার তিনটি উপজেলায় বিএনপির পরীক্ষিত ও ত্যাগী প্রায় অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে বাদ দিয়ে পছন্দের লোকজনকে নিয়ে থানা ও পৌর কমিটি গঠন করা হয়েছে নেতা-কর্মীদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, বিএনপি একটি বড় দল। এখানে সব নেতা-কর্মীকে সমভাবে মন জোগানো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, তাঁদের স্বতন্ত্র মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নবীন ও প্রবীণদের সমন্বয় ঘটিয়ে তাঁর নির্বাচনী এলাকার থানা ও পৌর কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.