ব্যর্থতার বৃত্তবন্দি by ইকবাল হোসেন

বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রতিভার কোনো অভাব নেই। প্রতিভাবান ক্রিকেটাররাই সবসময় জাতীয় দলে সুযোগ পান। দলে আসার পর তারা সেই প্রতিভার ঝলকও দেখান। কিন্তু এরপর! সেই প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না ক্রিকেটের অভিজাত ঘরের একেবারে নবীন সদস্য; তবুও ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর প্রায় এক যুগ অতিক্রম করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। ওয়ানডে মর্যাদা এরও তিন বছর আগে। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ


পার করেছে প্রায় ২৫ বছর। ২০০০ সালের পর গত ১১ বছরে বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছে ৭২টি (পাকিস্তানের বিপক্ষে আজ থেকে শুরু হতে যাওয়া ঢাকা টেস্ট বাদে)। এর মধ্যে ক্যারিবীয়দের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে ২টি টেস্ট এবং জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামে অর্জিত জয়টি ছাড়া আর কোনো টেস্ট জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ৬২টি টেস্টেই হার। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টসহ বাংলাদেশ বরণ করেছে ৩৫তম লজ্জাজনক ইনিংস পরাজয়। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর এক যুগের কাছাকাছি হতে চলল। এর মধ্যে বাংলাদেশ কী অর্জন করেছে, আর কী অর্জন করতে পারেনি তার একটা হিসাব-নিকাশ করার সময় সত্যিই হয়ে গেছে। এর প্রয়োজনীয়তাটাও অনেক বেশি। কারণ, আন্তর্জাতিক আসরে যেভাবে একের পর এক আমরা হাসির পাত্রে পরিণত হচ্ছি, তা হতে সম্ভবত আর কেউ রাজি হবেন না।
বিজয়ের মাসে পাকিস্তানিদের বিপক্ষে অন্তত একটি কিংবা দুটি ওয়ানডে জয় আশা করেছিল ক্রিকেটপ্রেমীরা। একই সঙ্গে টেস্ট সিরিজে আশা করেছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিলই রাখেননি ক্রিকেটাররা। টোয়েন্টি২০ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম টেস্ট_ সব ক্ষেত্রেই চরম ব্যর্থতার পরিচয়। মিসবাহ-উল হকদের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার মতো কোনো মানসিকতাই দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ধরে নেওয়া যাক, পাকিস্তান এই সময়ে খুব ভালো অবস্থানে আছে। কেলেঙ্কারির একটা অধ্যায় কাটিয়ে দল হিসেবে তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। মিসবাহর নেতৃত্বে ভালো ক্রিকেটও খেলছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়ে তুলতে পারবে না তা তো নয়! গত দশ-এগারো বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেক পরিণত হওয়ার কথা। অথচ পরিণত হওয়ার চেয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট যেন নামছে আরও অতল গহ্বরে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এখন যে অবস্থা তাতে সম্ভবত ঘরের মাঠেও জিম্বাবুয়েকে হারানো কঠিন হবে। এমনিতেই বিশ্বকাপের পর অ্যাওয়ে সিরিজ খেলতে গিয়ে পরিবর্তিত জিম্বাবুয়েকে দেখে এসেছে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বাধীন দলটি। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, হিথ স্ট্রিকদের পর জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট যেভাবে পিছিয়ে পড়েছিল, সেখান থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয় তা তারা দেখিয়েছে। জিম্বাবুয়ের সাম্প্রতিক ফর্মের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে। বলতে অসুবিধা নেই, বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রতিভার কোনো অভাব নেই। প্রতিভাবান ক্রিকেটাররাই সব সময় জাতীয় দলে সুযোগ পান। দলে আসার পর তারা সেই প্রতিভার ঝলকও দেখান। কিন্তু এরপর! সেই প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গড় তামিম ইকবালের, ৩৮.৯৩ করে। লর্ডসে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ে তামিম দেশের সম্মান বৃদ্ধি করেছেন ঠিক, কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে এ কোন তামিমকে দেখল বাংলাদেশের দর্শক! কেনই বা তাকে হোটেল থেকে বের করে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয় বোর্ডের পক্ষ থেকে! কেনই বা একই বোলারের বলে বারবার বোকার মতো আউট হয়ে ফিরে আসতে হয় তাকে? এই 'কেন'র জবাব তামিম নিজেও যেমন দিতে পারবেন না, তেমনি বোর্ডের কাছেও হয়তো নেই। কিন্তু দুটি সত্য চট্টগ্রাম টেস্টের পর বের হয়ে এসেছে। একটি সত্য জানিয়েছেন কোচ স্টুয়ার্ট ল, 'ক্রিকেটাররা মানসিকভাবে দুর্বল।' অন্য সত্যটি টেস্ট শেষ হওয়ার পর অধিনায়ক মুশফিক জানিয়েছেন, 'জাতীয় ক্রিকেট লীগে না খেলা।' অন্যান্য দেশে যখন একজন ক্রিকেটার দিনের পর দিন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলতে খেলতে চূড়ান্ত পরিণত হয়, তখনই তার মাথায় টেস্ট ক্যাপ ওঠে। টেস্ট ৫ দিনের খেলা। ৫ দিন কীভাবে খেলতে হবে সে প্রশিক্ষণ তো একজন ক্রিকেটার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেই শিখবেন। সেখানেই তিনি পোক্ত হবেন। এরপর জাতীয় দলে আসবেন। কিন্তু আমাদের তারকা(!) ক্রিকেটাররা বিশ্রামের অজুহাতে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলবেন না। ভ্রমণ ক্লান্তির ভয়ে ঢাকার বাইরে গিয়ে জাতীয় লীগ খেলবেন না। বিনা প্রস্তুতিতে, বিনা শ্রমে তারা নেমে যাবেন জাতীয় দলের গুরুভার নিয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলতে। আর জাতিকে ডোবাবেন চরম লজ্জায়! টেস্ট খেলার মতো শারীরিক ও মানসিকভাবে পোক্ত না হলে সেই ক্রিকেটারদের মাঠে ঠেলে দেওয়ার আগে কর্মকর্তাদেরও ভাবতে হবে। নবীন দল হিসেবে আমাদের জয় না আসতে পারে, কিন্তু লড়াই করার মানসিকতাও কি থাকবে না! শুধু টেস্ট কেন, পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে এবং টোয়েন্টি২০-তে ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং ভুলে যাওয়া দেখে ক্রিকেটপ্রেমীরা আঁতকে উঠেছেন। তাদের আউট হওয়ার ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অধিকাংশ সময়ই হয়তো উচ্চাভিলাষী শট খেলতে গিয়ে কিংবা বল বুঝতে না পেরে বোকার মতো উইকেট বিলিয়ে এসেছেন। ওয়ানডেতে মাঝে মধ্যে আমাদের ক্রিকেটাররা সাফল্য বয়ে এনেছেন, ভবিষ্যতেও হয়তো আনবেন। কিন্তু এটাকে চূড়ান্ত সাফল্য বলা যায় না। আসল ক্রিকেটই হলো টেস্ট। এখানে সাফল্যের ধারায় আসতে না পারলে সার্থকতা নেই। ক্রিকেট কর্মকর্তাদের এখনই এ নিয়ে ভাবা উচিত। জাতি হিসেবে আমাদের আর হাসির খোরাকে পরিণত না করে ক্রিকেট দলকে সত্যিকারের ক্রিকেটার দিয়ে গড়ে তুলুন।

No comments

Powered by Blogger.