রঙ্গব্যঙ্গ-ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এবং একটি কাল্পনিক গল্প by মোস্তফা কামাল
তমাল ও শাকিল দুই বন্ধু। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ওরা দুজনই ছিল স্কুলের ছাত্র। শাকিল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও ওর বাবা এবং বড় ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আর তমালের পুরো পরিবার ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। তমালের বাবা শান্তি কমিটির স্থানীয় নেতা ছিলেন। তমালও পাকিস্তানি সৈন্যদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। তমালের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে সেই সময়ই শাকিলের সঙ্গে তুমুল দ্বন্দ্ব হয়। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে কথা বলাবলি,
এমনকি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ওরা নতুন করে স্কুলে ভর্তি হয়। শাকিল তমালকে এড়ানোর চেষ্টা করলেও পারেনি। ওদের গ্রামে একটি মাত্র স্কুল। তাই ওদের একই স্কুলে পড়তে হয়েছে। শাকিল ভেবেছিল, কলেজে ভর্তি হলে নিশ্চয়ই তমাল আর ওর সঙ্গে থাকবে না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও তমালকে সে এড়াতে পারেনি। যা হোক, কর্মজীবনে প্রবেশ করে দুজন দুদিকে চলে যায়। একসঙ্গে পড়াশোনা করলেও শাকিল ইচ্ছা করেই আর তমালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। কর্মজীবনে প্রবেশ করে তমাল শাকিলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করলেও শাকিলের সাড়া না পেয়ে সেও তাকে ভুলে যায়।
হঠাৎ একদিন শাকিল পত্রিকায় দেখে, একটি জাতীয় দৈনিকে তমালের কবিতা বেরিয়েছে। কবিতার শিরোনাম জনক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা। শাকিল বিস্ময়ের দৃষ্টিতে পত্রিকার দিকে তাকায়। তমালের নামটা খুব ভালো করে দেখে। হুম! আমার বন্ধু তমাল জাহিদ! কিন্তু সে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হলো কবে! সে তো একটা রাজাকার! সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেও কি বদলে গেল! শাকিল কবিতাটি খুব ভালো করে পড়ে। কবিতা তো হয়নি! বেশ ভালো তেল মারা হয়েছে। ওর নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে!
তমালের কবিতাটি পড়ে শাকিলের ভীষণ মন খারাপ হয়। শাকিল দুশ্চিন্তা করছে। আর মনে মনে ভাবছে, রাজাকাররা এভাবেই নিজেদের রং বদল করে আমাদের মধ্যে মিশে গেছে। বড় বড় পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছে। দেশটাকে তারা লুটেপুটে খাচ্ছে। ওরা গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে সারা দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছেন! হায়রে স্বাধীনতা!
শাকিল মনে মনে ভাবে, তমালের মুখোমুখি হবে সে। তমালের এই রং বদলের কারণটা তাকে জানতেই হবে। সে তো তমালকে খুব ভালো করে চেনে! সে স্বার্থ ছাড়া কোনো কাজ করে না। ওর কবিতা লেখার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো স্বার্থ আছে।
শাকিলের ভাবনাগুলো মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সে আবার একদিন পত্রিকায় দেখে, তমাল জাহিদ ভারপ্রাপ্ত সচিব হয়েছে। শাকিল বিস্ময়ে বিমূঢ়! সে মনে মনে ভাবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সরকার একজন রাজাকারকে সচিব করল! এটা কী করে সম্ভব! না না, এ হতে পারে না! সে আবার ভাবে, সচিব হওয়ার জন্যই সে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছে! সরকার তার কালো অতীতটা দেখেনি। দেখেছে তার বর্তমানটা। এক কবিতায় সচিব পদ!
শাকিল ভাবে, তমালের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তার বদলে যাওয়ার কাহিনী তার কাছ থেকেই শুনতে হবে। তারপর একদিন শাকিল তমালের দপ্তরে গিয়ে হাজির। শাকিলকে দেখে তমাল রীতিমতো বিস্মিত। এত বছর পর সে তাকে চিনল কী করে! তমাল বিস্ময়ের সঙ্গেই বলল, আরে বন্ধু তুমি!
'হ্যাঁ, আমার বন্ধু সচিব হয়েছে শুনে ছুটে এলাম।'
'ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। কী খাবে, চা না কফি?'
'নো থ্যাঙ্কস! শোন বন্ধু, আমি তোমাকে শুধু দেখতে এসেছি। আর একটা কথা, পত্রিকায় দেখলাম, তুমি নাকি মুক্তিযোদ্ধা ছিলে! আবার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতাও লিখেছ। ঘটনা কী? একেবারে রং বদল করে ফেললে?'
'এই! চুপ চুপ! আস্তে কথা বল! কেউ শুনে ফেলবে!'
'আচ্ছা ঘটনা কী বল তো!'
'বুঝতে পারছ না? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সরকার ক্ষমতায়। আমি রাজাকার ছিলাম_এটা জানতে পারলে চাকরি থাকবে? তাই রং বদল করে ফেললাম। আবার দেখলাম, সরকারকে একটু তেল দিলে সচিব পদটাও পাওয়া সম্ভব। তাই একেবারে ঘি ঢেলে দিলাম! হা হা হা!'
'তাই তো বলি! আমার বন্ধু হঠাৎ একেবারে বদলে গেল!'
'শুধু কি পোশাকি বদল! একেবারে কাগজ-কলমে নিজেকে বদলে ফেলেছি!'
'মানে!'
'মানে মুক্তিযোদ্ধার একটা সার্টিফিকেট জোগাড় করে ফেলেছি। কাজেই আর কোনো চিন্তা নেই। তমাল এখন কাগজ-কলমে মুক্তিযোদ্ধা! সেই একাত্তরের কথা তোমার মনে আছে?'
'থাকবে না কেন? সবই মনে আছে।'
'পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করেছি বলে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলে। আমার চেহারা দেখতেও তোমার ঘৃণা লাগত। অথচ আমি এখন একজন সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা! তুমি তো তখন মুক্তিযোদ্ধাদের একটু একটু সহযোগিতা করেছিলে! তোমার কোনো সার্টিফিকেট আছে?'
শাকিল মাথা নিচু করে বলে, না, নেই। আমার কোনো সার্টিফিকেট নেই। দরকারও নেই।
'আছে বন্ধু আছে! দরকার আছে! সার্টিফিকেট না থাকলে আজ সচিব হতে পারতাম না। বুঝতে পারছ?
'হুম!'
'আর দুই বছর সচিব থাকতে পারলে হয়! তারপর দেশ গোল্লায় যাক! তাতে আমার কী! রং বদল করে সচিব তো হয়েছি! সরকারের সর্বোচ্চ পদে চাকরি করছি। আর কী চাই! হা হা হা!'
খেদের সঙ্গে শাকিল বলল, বাহ তমাল, বাহ! কাজের কাজ করেছ! তোমার মতো করিৎকর্মা কয়জন হয়!
'আরো আছে বন্ধু। আমার চেয়েও অনেক করিৎকর্মা লোক আছে। যাকগে, এসব কথা এখন থাক। তুমি কেমন আছ বল তো?'
'আমি ভালো আছি। ব্যবসা করছি। একটা গ্রুপ অব কম্পানির চেয়ারম্যান!'
'তাই নাকি! তাহলে তো আর কথাই নেই! অবসরে গিয়ে তোমার কম্পানিতে বসে যাব। কী বল?'
'স্যরি বন্ধু! স্যরি! সরকার তোমাকে সচিব বানাতে পারে, কিন্তু আমার কম্পানিতে কোনো রাজাকারের ঠাঁই নেই! আসি।'
শাকিল আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। তমাল তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিলে রইল।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
হঠাৎ একদিন শাকিল পত্রিকায় দেখে, একটি জাতীয় দৈনিকে তমালের কবিতা বেরিয়েছে। কবিতার শিরোনাম জনক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা। শাকিল বিস্ময়ের দৃষ্টিতে পত্রিকার দিকে তাকায়। তমালের নামটা খুব ভালো করে দেখে। হুম! আমার বন্ধু তমাল জাহিদ! কিন্তু সে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হলো কবে! সে তো একটা রাজাকার! সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেও কি বদলে গেল! শাকিল কবিতাটি খুব ভালো করে পড়ে। কবিতা তো হয়নি! বেশ ভালো তেল মারা হয়েছে। ওর নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে!
তমালের কবিতাটি পড়ে শাকিলের ভীষণ মন খারাপ হয়। শাকিল দুশ্চিন্তা করছে। আর মনে মনে ভাবছে, রাজাকাররা এভাবেই নিজেদের রং বদল করে আমাদের মধ্যে মিশে গেছে। বড় বড় পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছে। দেশটাকে তারা লুটেপুটে খাচ্ছে। ওরা গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে সারা দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছেন! হায়রে স্বাধীনতা!
শাকিল মনে মনে ভাবে, তমালের মুখোমুখি হবে সে। তমালের এই রং বদলের কারণটা তাকে জানতেই হবে। সে তো তমালকে খুব ভালো করে চেনে! সে স্বার্থ ছাড়া কোনো কাজ করে না। ওর কবিতা লেখার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো স্বার্থ আছে।
শাকিলের ভাবনাগুলো মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সে আবার একদিন পত্রিকায় দেখে, তমাল জাহিদ ভারপ্রাপ্ত সচিব হয়েছে। শাকিল বিস্ময়ে বিমূঢ়! সে মনে মনে ভাবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সরকার একজন রাজাকারকে সচিব করল! এটা কী করে সম্ভব! না না, এ হতে পারে না! সে আবার ভাবে, সচিব হওয়ার জন্যই সে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছে! সরকার তার কালো অতীতটা দেখেনি। দেখেছে তার বর্তমানটা। এক কবিতায় সচিব পদ!
শাকিল ভাবে, তমালের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তার বদলে যাওয়ার কাহিনী তার কাছ থেকেই শুনতে হবে। তারপর একদিন শাকিল তমালের দপ্তরে গিয়ে হাজির। শাকিলকে দেখে তমাল রীতিমতো বিস্মিত। এত বছর পর সে তাকে চিনল কী করে! তমাল বিস্ময়ের সঙ্গেই বলল, আরে বন্ধু তুমি!
'হ্যাঁ, আমার বন্ধু সচিব হয়েছে শুনে ছুটে এলাম।'
'ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। কী খাবে, চা না কফি?'
'নো থ্যাঙ্কস! শোন বন্ধু, আমি তোমাকে শুধু দেখতে এসেছি। আর একটা কথা, পত্রিকায় দেখলাম, তুমি নাকি মুক্তিযোদ্ধা ছিলে! আবার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতাও লিখেছ। ঘটনা কী? একেবারে রং বদল করে ফেললে?'
'এই! চুপ চুপ! আস্তে কথা বল! কেউ শুনে ফেলবে!'
'আচ্ছা ঘটনা কী বল তো!'
'বুঝতে পারছ না? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সরকার ক্ষমতায়। আমি রাজাকার ছিলাম_এটা জানতে পারলে চাকরি থাকবে? তাই রং বদল করে ফেললাম। আবার দেখলাম, সরকারকে একটু তেল দিলে সচিব পদটাও পাওয়া সম্ভব। তাই একেবারে ঘি ঢেলে দিলাম! হা হা হা!'
'তাই তো বলি! আমার বন্ধু হঠাৎ একেবারে বদলে গেল!'
'শুধু কি পোশাকি বদল! একেবারে কাগজ-কলমে নিজেকে বদলে ফেলেছি!'
'মানে!'
'মানে মুক্তিযোদ্ধার একটা সার্টিফিকেট জোগাড় করে ফেলেছি। কাজেই আর কোনো চিন্তা নেই। তমাল এখন কাগজ-কলমে মুক্তিযোদ্ধা! সেই একাত্তরের কথা তোমার মনে আছে?'
'থাকবে না কেন? সবই মনে আছে।'
'পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করেছি বলে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলে। আমার চেহারা দেখতেও তোমার ঘৃণা লাগত। অথচ আমি এখন একজন সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা! তুমি তো তখন মুক্তিযোদ্ধাদের একটু একটু সহযোগিতা করেছিলে! তোমার কোনো সার্টিফিকেট আছে?'
শাকিল মাথা নিচু করে বলে, না, নেই। আমার কোনো সার্টিফিকেট নেই। দরকারও নেই।
'আছে বন্ধু আছে! দরকার আছে! সার্টিফিকেট না থাকলে আজ সচিব হতে পারতাম না। বুঝতে পারছ?
'হুম!'
'আর দুই বছর সচিব থাকতে পারলে হয়! তারপর দেশ গোল্লায় যাক! তাতে আমার কী! রং বদল করে সচিব তো হয়েছি! সরকারের সর্বোচ্চ পদে চাকরি করছি। আর কী চাই! হা হা হা!'
খেদের সঙ্গে শাকিল বলল, বাহ তমাল, বাহ! কাজের কাজ করেছ! তোমার মতো করিৎকর্মা কয়জন হয়!
'আরো আছে বন্ধু। আমার চেয়েও অনেক করিৎকর্মা লোক আছে। যাকগে, এসব কথা এখন থাক। তুমি কেমন আছ বল তো?'
'আমি ভালো আছি। ব্যবসা করছি। একটা গ্রুপ অব কম্পানির চেয়ারম্যান!'
'তাই নাকি! তাহলে তো আর কথাই নেই! অবসরে গিয়ে তোমার কম্পানিতে বসে যাব। কী বল?'
'স্যরি বন্ধু! স্যরি! সরকার তোমাকে সচিব বানাতে পারে, কিন্তু আমার কম্পানিতে কোনো রাজাকারের ঠাঁই নেই! আসি।'
শাকিল আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। তমাল তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিলে রইল।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments