আব্বাস নাসির-বদলে গেছে কি অনেক!
১৯৭১-এর যুদ্ধ শেষ হওয়ারও ৩০ বছর পরের কথা। আমি তখন প্রথম ঢাকা সফর করি। দিনটি শুরু হয়েছিল সাভারে স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনের মাধ্যমে। স্মৃতিসৌধটি রাজধানী ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। স্মৃতিসৌধ চত্বরে প্রবেশ করার মুহূর্তেই আপনি উল্লেখযোগ্য কিছু দৃশ্য দেখতে পাবেন, যেগুলো সত্যিই আপনার চিন্তার খোরাক জোগাবে। তারপর এগিয়ে গেলে একপর্যায়ে দেখবেন জলাধারের কাছে সুন্দর ত্রিভুজাকৃতি স্মৃতির মিনার।
ওপরে যেতে যেতে ১৫০ ফুট গিয়ে শূন্যে মিশেছে। এই মিনারের দুদিকে গণকবর। সেই গণকবরে আনুমানিক ৩০ হাজার মানুষ অন্তিম শয্যায় শায়িত। এই গণকবর আবিষ্কৃত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈনদের আত্মসমর্পণের পর পর।
১৯৭১ সালে আমি প্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম না। কিন্তু তার পরও আমি জানি, আমাদের কাঁধের বোঝাটার কথা জানি। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। আর আমাদের সেখানে যাওয়াটা ছিল ভয়ংকর যাকে বলে। তাদের অপরাধ কী ছিল? তারা আইনানুগভাবেই ক্ষমতা চেয়েছিল। এটা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। কারণ বছরের শুরুতে যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচনে তারা একটি দলকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয়। আর নির্বাচনটা হয়েছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু। নির্বাচনের ফল ক্ষমতাসীন জেনারেলদের মধ্যে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। তারা এর আগে যে গোপন তথ্য পেয়েছিল, সবই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছিল সেই নির্বাচনে। জেনারেলদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। আর এতেই তাঁদের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দেয়। নির্বাচনী ফল তাঁদের প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়। তাঁরা বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বিলম্ব ঘটাতে থাকে। পরিণতিতে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
এই বিক্ষোভ দমন করার জন্য সেনারা অস্ত্র ব্যবহার করতে থাকে। আর সেই অস্ত্রের ব্যবহার যে কতটা নির্মম হতে পারে, সেটা ইতিহাসই সাক্ষ্য দিচ্ছে। এর ফলে হাজার হাজার মানুষকে ভারতে চলে যেতে হয়েছে নিরাপত্তার জন্য, যারা গণবিক্ষোভকে উসকে দেয়, বিক্ষোভকারীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়; একপর্যায়ে তো তারা যুদ্ধই ঘোষণা করে বসে।
এই বিদ্রোহ যখন বাড়তে থাকে, তখন সেনাদের নির্যাতনও বাড়তে থাকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, প্যারামিলিটারি ইউনিট ও তাদের এ দেশীয় দালালদের নির্যাতন বেড়ে যায় অস্বাভাবিক। মিলিশিয়া বাহিনী গঠিত হয় মূলত জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ও সদস্যদের নিয়ে, যারা গণহত্যা ও গণধর্ষণের মতো নির্মম কাজগুলো করেছে। আর যে মুহূর্তে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে খবর প্রকাশ বন্ধ করে দেয়, তখন পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম সেগুলোকে ফলাও করে প্রচার করতে থাকে। কিন্তু এটাও ঠিক, অবাঙালিদের ওপর মুক্তিবাহিনীও কম অত্যাচার করেনি!
আমি যখন সৌধের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন আমার ভাবনায় আসে, আচ্ছা আমরা নিজেদের লোকের ওপর এতটা নির্মম হতে পারলাম কিভাবে? আমি নিজে নিজেই শত-সহস্রবার নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি।
১৯৬৭ সালের পর এই প্রথম আমি কলিমুল্লাহকে দেখতে যাচ্ছি। তিনি থাকেন গুলশানের একটি বাড়িতে। কিন্তু আমার মনে বারবার একটা শব্দই উচ্চারিত হচ্ছে, তাঁর বাড়ি থেকে কেউ যদি ঘৃণিত '৭১-এর কোনো প্রসঙ্গ তুলে আনে? আর তারা আমাকে দেখার পর যদি বলে দেয়, আমরা পাকিস্তানি কাউকে দেখতে চাই না!
কিন্তু তাদের বাড়িতে পেঁৗছানোর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমার সব দ্বিধা কেটে যায়। আমি বুঝতে পারি, আমার উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আন্টি তানিমার আপ্যায়নের কোনো ঘাটতি দেখলাম না। আর এই আদর কিন্তু আমার বাবার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, যে বাবাকে আমি ১৯৭০ সালে হারিয়েছি। কলিমুল্লাহ আঙ্কেল খারিয়ানে ছিলেন ২৪ ক্যাভালরিতে। আসিফ ও মালিহা আমার কত কাছের ছিল। শৈশবের বিরাট একটি অংশ কেটেছে খেলাধুলায়, এমন যাদের সঙ্গে সম্পর্ক, তাদের সামনে এমন একটি বিষয় নিয়ে কি কথা বলা ঠিক হবে?
তবে তানিমা আন্টির আপ্যায়ন আমাকে সহজ করে দেয়। তাঁদের মধ্যে ঘৃণা কিংবা ক্রোধ আমি দেখতে পাইনি। আন্টি আমাকে বললেন, ১৯৭১-এর অব্যবহিত পরের একটি কাহিনী শোনাতে পারে আসিফ। আসিফ আমাকে বলে, ১৯৭১ সালে তার বয়স যখন মাত্র ১৪, তখন সে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে। সে যুদ্ধের কথাগুলো এমনভাবে বলতে থাকে, যেন তার সামনে কিছু ছবি রাখা আছে, আর সেগুলোরই বর্ণনা করছে সে। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েক দিন পরের ঘটনা। তাদের বাগানে একজন আগন্তুক আসেন। তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে চান। আগন্তুক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন সদস্য। পাকিস্তান আর্মির একজন ক্যাপ্টেন। দেখতে এসেছেন তাঁদের, কেমন আছেন তাঁরা। তাঁকে নিয়ে এসেছেন একজন মেজর। তারপর সেই মেজর চলে যান ভারতে যুদ্ধবন্দি হয়ে।
সেই ১৬ ডিসেম্বরের পর ৪০ বছর গত হয়ে গেছে। আমার কাছে মনে হয়, আমি এখনো সাভারে স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার মনে প্রশ্ন আসছে, আসলে পরিবর্তনটা হলো কোথায়?
লেখক : দ্য ডন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক
ডন থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন
১৯৭১ সালে আমি প্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম না। কিন্তু তার পরও আমি জানি, আমাদের কাঁধের বোঝাটার কথা জানি। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। আর আমাদের সেখানে যাওয়াটা ছিল ভয়ংকর যাকে বলে। তাদের অপরাধ কী ছিল? তারা আইনানুগভাবেই ক্ষমতা চেয়েছিল। এটা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। কারণ বছরের শুরুতে যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচনে তারা একটি দলকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয়। আর নির্বাচনটা হয়েছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু। নির্বাচনের ফল ক্ষমতাসীন জেনারেলদের মধ্যে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। তারা এর আগে যে গোপন তথ্য পেয়েছিল, সবই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছিল সেই নির্বাচনে। জেনারেলদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। আর এতেই তাঁদের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দেয়। নির্বাচনী ফল তাঁদের প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়। তাঁরা বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বিলম্ব ঘটাতে থাকে। পরিণতিতে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
এই বিক্ষোভ দমন করার জন্য সেনারা অস্ত্র ব্যবহার করতে থাকে। আর সেই অস্ত্রের ব্যবহার যে কতটা নির্মম হতে পারে, সেটা ইতিহাসই সাক্ষ্য দিচ্ছে। এর ফলে হাজার হাজার মানুষকে ভারতে চলে যেতে হয়েছে নিরাপত্তার জন্য, যারা গণবিক্ষোভকে উসকে দেয়, বিক্ষোভকারীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়; একপর্যায়ে তো তারা যুদ্ধই ঘোষণা করে বসে।
এই বিদ্রোহ যখন বাড়তে থাকে, তখন সেনাদের নির্যাতনও বাড়তে থাকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, প্যারামিলিটারি ইউনিট ও তাদের এ দেশীয় দালালদের নির্যাতন বেড়ে যায় অস্বাভাবিক। মিলিশিয়া বাহিনী গঠিত হয় মূলত জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ও সদস্যদের নিয়ে, যারা গণহত্যা ও গণধর্ষণের মতো নির্মম কাজগুলো করেছে। আর যে মুহূর্তে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে খবর প্রকাশ বন্ধ করে দেয়, তখন পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম সেগুলোকে ফলাও করে প্রচার করতে থাকে। কিন্তু এটাও ঠিক, অবাঙালিদের ওপর মুক্তিবাহিনীও কম অত্যাচার করেনি!
আমি যখন সৌধের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন আমার ভাবনায় আসে, আচ্ছা আমরা নিজেদের লোকের ওপর এতটা নির্মম হতে পারলাম কিভাবে? আমি নিজে নিজেই শত-সহস্রবার নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি।
১৯৬৭ সালের পর এই প্রথম আমি কলিমুল্লাহকে দেখতে যাচ্ছি। তিনি থাকেন গুলশানের একটি বাড়িতে। কিন্তু আমার মনে বারবার একটা শব্দই উচ্চারিত হচ্ছে, তাঁর বাড়ি থেকে কেউ যদি ঘৃণিত '৭১-এর কোনো প্রসঙ্গ তুলে আনে? আর তারা আমাকে দেখার পর যদি বলে দেয়, আমরা পাকিস্তানি কাউকে দেখতে চাই না!
কিন্তু তাদের বাড়িতে পেঁৗছানোর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমার সব দ্বিধা কেটে যায়। আমি বুঝতে পারি, আমার উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আন্টি তানিমার আপ্যায়নের কোনো ঘাটতি দেখলাম না। আর এই আদর কিন্তু আমার বাবার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, যে বাবাকে আমি ১৯৭০ সালে হারিয়েছি। কলিমুল্লাহ আঙ্কেল খারিয়ানে ছিলেন ২৪ ক্যাভালরিতে। আসিফ ও মালিহা আমার কত কাছের ছিল। শৈশবের বিরাট একটি অংশ কেটেছে খেলাধুলায়, এমন যাদের সঙ্গে সম্পর্ক, তাদের সামনে এমন একটি বিষয় নিয়ে কি কথা বলা ঠিক হবে?
তবে তানিমা আন্টির আপ্যায়ন আমাকে সহজ করে দেয়। তাঁদের মধ্যে ঘৃণা কিংবা ক্রোধ আমি দেখতে পাইনি। আন্টি আমাকে বললেন, ১৯৭১-এর অব্যবহিত পরের একটি কাহিনী শোনাতে পারে আসিফ। আসিফ আমাকে বলে, ১৯৭১ সালে তার বয়স যখন মাত্র ১৪, তখন সে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে। সে যুদ্ধের কথাগুলো এমনভাবে বলতে থাকে, যেন তার সামনে কিছু ছবি রাখা আছে, আর সেগুলোরই বর্ণনা করছে সে। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েক দিন পরের ঘটনা। তাদের বাগানে একজন আগন্তুক আসেন। তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে চান। আগন্তুক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন সদস্য। পাকিস্তান আর্মির একজন ক্যাপ্টেন। দেখতে এসেছেন তাঁদের, কেমন আছেন তাঁরা। তাঁকে নিয়ে এসেছেন একজন মেজর। তারপর সেই মেজর চলে যান ভারতে যুদ্ধবন্দি হয়ে।
সেই ১৬ ডিসেম্বরের পর ৪০ বছর গত হয়ে গেছে। আমার কাছে মনে হয়, আমি এখনো সাভারে স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার মনে প্রশ্ন আসছে, আসলে পরিবর্তনটা হলো কোথায়?
লেখক : দ্য ডন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক
ডন থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন
No comments