এখনও জ্বলছে বুয়াজিজি’র শরীর! by কল্লোল কর্মকার
কথায় আছে বারুদ যদি থাকে তাহলে তা জ্বালানোর জন্য আগুনের একটু ফুলকিই যথেষ্ট। আর বারুদের ওই বিস্ফোরণে ফেটে যেতে পারে ঘরদোরসহ বিশাল সব ইমারত। তেমনি নিস্পেষিত জনগণের ক্রোধের আগুনে যদি আলতো বাতাস লাগে তাতেই তছনছ হয়ে যেতে পারে রাষ্ট্র ক্ষমতার মসনদ। ইতিহাস সাক্ষী, এমন অনেক বড় বড় ঘটনাই ঘটেছে ছোটো কোনো একটা ঘটনা থেকে।আজ থেকে একবছর আগে তিউনিশিয়ার তরুন মোহাম্মদ বুয়াজিজি এমনই এক স্ফুলিঙ্গ হয়ে ওঠেছিলেন। নিদারুণ অর্থনৈতিক সঙ্কট আর পুলিশি অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে বুয়াজিজি তার নিজের শরীরেই আগুন জ্বালিয়ে দেন। তার শরীরের সেই আগুন শুধু তার শরীরেই থেমে থাকেনি। দাবাগ্নির মতো ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে সেই আগুনের আঁচ লাগে সবার আগে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে আরব বিশ্বসহ সমগ্র বিশ্বে। ইতিহাসের পাতায় এই দাবানলের নাম হয়ে দাঁড়ালো ‘আরব বসন্ত’।
গত বছরের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ সকালবেলা। ঘটনাস্থল তিউনিশিয়ার শহর সিদি বাওজিদ। সেদিন পর্যন্ত কেউ জানতো না এই শহরই হবে পরবর্তী বিপ্লবী ইতিহাসের সবচেয়ে বেয়াড়া সাক্ষী। পৌরসভার পুলিশ ইন্সপেক্টর ফাইদা হামদির সঙ্গে কথা কাটাকাটি বেধে যায় ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজি’র। এক পর্যায়ে সেই ইন্সপেক্টর বুয়াজিজি’র সকল পণ্য আটক করে নিয়ে যায়। এমনকি তার ফল বিক্রি করার ঠেলা গাড়িটি পর্যন্ত।
বুয়াজিজি অনেক কাতর অনুনয় বিনয় করে তার পণ্যসহ গাড়ি ফেরত পাওয়ার জন্য। কিন্তু তাতে মন গলেনি নগর কর্তৃপক্ষের। তার কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি প্রশাসন। শেষমেষ মরিয়া বুয়াজিজি বাজার থেকে কিনে আনলেন জ্বালানি। আর সেই জ্বালানিতে সিক্ত হয়ে সরকারি ভবনের গেটের সামনে নিজেকে জ্বালিয়ে দেন তিনি।
বুয়াজিজি’র চাচা রিদাহও একজন ফল বিক্রেতা। তিনিও পুলিশের হাতে নিত্য নির্যাতনের শিকার হওয়া একজন। ‘এই সরকারের ইন্সপক্টেররা জোর করে আমাদের পণ্য নিয়ে নিতো। আমাদের কাছে অবৈধভাবে ঘুষ নিতো। কিছু বললেই অকথ্য নির্যাতন করতো আমাদের ওপর।’ এভাবেই তিনি পুলিশি নির্যাতনের কথা বলেন।
বুয়াজিজি’র শরীরের ওই আগুনের তাপে পুড়ে যায় বিন আলী’র মসনদ। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো তিউনিশিয়া। মাত্র একমাসের মাথায় ক্ষমতা থেকে নেমে যেতে বাধ্য হন তিউনিশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বিন আলী।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নীতিনির্ধারকরা ভাবতেই পারেননি বুয়াজিজির শরীরের আগুন দাবানলের মতো এতটা দূর ছড়িয়ে যাবে। কারণ তিউনিশিয়ার এই বিপ্লবের ছোয়া লাগে মিসরে। অভ্যূত্থান সামাল দিতে না পেরে ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা হোসনী মোবারক।
পাশাপাশি আরব বিশ্বের আরেক প্রান্তের দেশ ইয়েমেনেও শুরু হয় বিদ্রোহের প্লাবন। সেই বিদ্রোহে নতি স্বীকার করতে হয় প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহকেও। উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সমঝোতায় এক ক্ষমতা হস্তান্তর চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
তবে আজও শান্ত হয়নি কায়রোর তাহরির স্কয়ার। এখনও বিক্ষুব্ধ জনতাকে কাঁদুনে গ্যাস আর তাজা বুলেটের দাম শোধ করতে হয় বুকের তাজা রক্ত দিয়ে। তাহরির স্কয়ারের রাস্তায় নেমে এসেছে দেশটির সর্বস্তরের জনগণ। হোসনী মোবারক রাষ্ট্র ক্ষমতায় নেই কিন্তু সেনাবহিনী এখনও গদি আকড়ে আছে মোবারকের ভূত হয়ে।
জনগণের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়তে না চাওয়ায় লিবিয়া দীর্ঘদিনের শাসক মুয়াম্মার আল গাদ্দাফিকে মরতে হয়েছে ইঁদুরের মতো। অথচ এই মানুষটিই অহংকার করে নিজ দেশের বিদ্রোহিদের ইঁদুর বলে গালি দিয়েছিলেন।
সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে সেদেশের জনতা রাস্তায় নেমেছে। সিরিয়ার হামা এবং হোমস শহরে প্রতিদিনই নিহত হচ্ছে বেসামরিক মানুষ। রাষ্ট্রীয় ট্যাংক চলছে সাধারণ মানুষের বুকের উপর দিয়ে। এমনকি বাহারাইনেও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে চলছে লাগাতার বিক্ষোভ।
বুয়াজিজি’র শরীরের আগুনে এখনও জ্বলছে অনেক দেশের ‘চেপে বসা’ ক্ষমতার মসনদ। আর এর বড় প্রমাণ বর্তমান মিসর, সিরিয়া, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশ।
No comments