সময়ের কথা-সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তের পেছনে... by অজয় দাশগুপ্ত

পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো বাংলাদেশের একটি অংশের জনগণের এমন মনোভাবের কথা অবশ্যই জানতেন এবং এ কারণে তার পক্ষে চাপ সৃষ্টি করা সহজ হয়। তবে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে এটা কোনোভাবেই বোঝায় না যে, বাংলাদেশের যেসব নাগরিক একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠনে শুধু সহযোগিতা নয়, নিজেরাও তাতে মহা উৎসাহে শামিল হয়েছে তাদের বিচার করা যাবে না মুক্তিযুদ্ধে


বিজয়ের চলি্লশ বছর পূর্ণ হলো। কী পেলাম আর কী থেকে বঞ্চিত, কত ধরনের স্মৃতিচারণা নানা স্থানে। মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে লড়েছে, তাদের অনেকের প্রশ্ন_ আমাদের জীবন কতটা বদলেছে? অভাব তো নিত্যদিনের সঙ্গী। আরেক দৃশ্যপট একটি সত্য ঘটনায় বলছি_ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, এক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা জোর তদবির করছেন যাতে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়। একাত্তরে ১৪-১৫ বছরের ওই কিশোরের পূরণ করা ফরম থেকেই স্পষ্ট যে, তিনি মুক্তিবাহিনীতে ছিলেন না। তবে এটা এখন ভালো করেই জানেন যে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট পেলে তার চাকরির মেয়াদ দুই বছর বেড়ে যাবে এবং এখন যেখানে তার পোস্টিং সেখানে থাকলে সার্টিফিকেট পেতে অনেক অনেক কাঠখড় পোড়ালেও তা মোটেই ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট হবে না। আমাদের প্রশাসন ও সমাজে যে বাস্তবতা বিদ্যমান তাতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট পেয়ে গেলেও বিস্মিত হব না।
আজ ১৭ ডিসেম্বর লিখতে বসেছি। একাত্তরের এ দিনে ছিলাম নিজের বাড়িতে। সে এলাকা মুক্ত করার সংগ্রামে অবদান রেখেছি, সেটা ভেবে এক ধরনের তৃপ্তি বরাবরই অনুভব করি। কী কঠিন কয়েকটি মাসই না আমাদের কোটি কোটি মানুষ পার হয়ে এসেছে!
একাত্তরে এবং পরের বছরগুলোতে একটি প্রশ্ন বারবার নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি_ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেন ২৫ মার্চ (১৯৭১) মধ্যরাতে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে নিজের বাসভবনে অবস্থান করেছেন চরম ঝুঁকি নিয়ে। সে রাতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা অপারেশন সার্চলাইটের বাস্তবায়ন শুরু করবে, সেটা তার ভালোভাবেই জানা ছিল। নানা সূত্রে এ খবর তার কাছে পেঁৗছায়। পাকিস্তান আর্মি ও বিমানবাহিনীর বাঙালি অফিসাররা নিশ্চিত হয়েই এ খবর তাকে দিয়েছিলেন। ভারতীয় গোয়েন্দা ও সামরিক সূত্রও তাকে এ খবর দিয়ে থাকবে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং কোষাধ্যক্ষ আবদুল কাইউম মুকুলসহ আমরা কয়েকজন হাতিরপুল বাজারের কাছে একটি বাড়িতে রাতে থাকার জন্য পেঁৗছলে সেখানে দেখি পথে ব্যারিকেড দেওয়া হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ সেখানে জয়বাংলা স্লোগান দিচ্ছে। তাদের কয়েকজন জানালেন, রাতেই পাকিস্তানি আর্মি হামলা করবে। বঙ্গবন্ধু খবর পাঠিয়েছেন, ব্যারিকেড দিতে হবে। ওই রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে যারা তার কাছে বিদায় নিয়েছেন তাদের অনেকেই বলেছেন, তাদের রাতে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন, কিন্তু অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি নিজে সরে যেতে রাজি হননি। বঙ্গবন্ধু নিজে স্বাধীনতার পরে একাধিকবার বলেছেন, তাকে বাসভবনে না পেলে পাকিস্তানিরা তার সন্ধানে ঢাকা শহরের ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাত। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার হিসেবে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তিনি সহকর্মীদের বলেছেন, ২৫ মার্চ সকালেই বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছেন, দলের নেতাকর্মীর কেউ যেন রাতে বাসায় না থাকে, সে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তার নিজের পক্ষে বাসভবন ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।
বঙ্গবন্ধু বাসায় থেকে বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। তাকে গ্রেফতার করায় জীবনরক্ষা পায়। সে রাতে তাকে পাকিস্তানি কমান্ডোরা হত্যা করা অস্বাভাবিক ছিল না। পাকিস্তানি কমান্ডো লে. কর্নেল নাদের আলি বলেছেন, মুজিবকে আটক করার পর টিক্কা খান ও অন্য পদস্থ পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা কেন তাকে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হয়নি, সেজন্য সংশ্লিষ্ট অফিসারদের ভর্ৎসনা করেছেন। একাত্তরে বরিশালের কমিউনিস্ট নেতা মুকুল সেনের ব্যাখ্যা ছিল এ ধরনের : বঙ্গবন্ধুর মতো জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী নেতার পক্ষে অন্য একটি দেশে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ কঠিন। কিন্তু তার সহকর্মীরা যেন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে সরকার গঠন করে, সে বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত তাদের জানিয়েছেন যথেষ্ট আগেভাগেই। ৭ মার্চের ভাষণেও বলেছিলেন, 'আমি যদি হুকুম দেবার না পারি...।'
ভারত সে সময়ে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকেবহাল ছিল। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। পাকিস্তানিরা একজন বাঙালির হাতে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেবে না বরং নির্যাতনের পথ বেছে নেবে এবং বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছে এটা তাদের জানা ছিল। এ সময়ে ভারত বাঙালিদের পাশে দাঁড়াবে, এ বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধীসহ শীর্ষ নেতৃত্ব একমত ছিলেন। ২৫ মার্চের তিন-চার দিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে পেঁৗছলে তাকে স্বাগত জানিয়ে খুব দ্রুততার সঙ্গে দিলি্ল পেঁৗছানো হয়। অধ্যাপক রেহমান সোবহান আমাকে বলেছেন, এপ্রিলের শুরুতেই তিনি দিলি্ল পেঁৗছান। তার উদ্দেশ্য ছিল, ড. অমর্ত্য সেন ও ড. অশোক মিত্রসহ তার ছাত্রজীবনের যেসব বন্ধু দিলি্লতে ছিলেন তাদের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়ে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে তার প্রতিকারে ভারতের সহায়তা কামনা। তেমন উদ্যোগও নেওয়া হয়। এ কাজ করতে গিয়েই তিনি জানতে পারেন, তাজউদ্দীন আহমদ দিলি্লতে রয়েছেন এবং তার সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর আলোচনা হয়েছে। ইতিহাস কিন্তু এটাও আমাদের জানায় যে, ১০ এপ্রিলের মধ্যেই তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়, যার শপথ অনুষ্ঠিত হয় ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে। ২৫ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল_ সেই কঠিন সময়ের বিচারে খুবই কম সময় নয় কি?
ফিরে আসি বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার প্রসঙ্গে। তিনি গ্রেফতার এড়ানোর জন্য বাসভবন ছেড়ে চলে গেলেও তার পক্ষে লুকানো সহজ ছিল না। এ ক্ষেত্রে আরও ঝুঁকি ছিল_ গুপ্তঘাতকের সাহায্যে তার জীবন বিপন্ন করা। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে যুক্ত একাধিক ভারতীয় সূত্র সে কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অবস্থানের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেন এভাবে : শেখ মুজিবুর রহমান কোনোভাবেই বাসভবন ছাড়তে রাজি ছিলেন না। তিনি ভারতে যাবেন না, সে বিষয়েও দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। তবে পরিকল্পনা ছিল, তার সহকর্মী ও ছাত্র-তরুণরা সেখানে যাবেন এবং মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হবে। তিনি ভারতে গেলে পাকিস্তানিরা এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা করবে, তিনি এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মিলে পরিকল্পিতভাবেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে চাইছেন। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই তিনি জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন : ২৫ মার্চ রাতে তিনি ৩২ নম্বরের বাসভবনে থাকবেন। ভারতীয় নেতৃত্বও এ বিষয়ে সম্মত হন।
বিশ্বে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের অনেক প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা আমাদের জানা আছে। বঙ্গবন্ধুর নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বাসভবনে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে আমরা কোথায় স্থান দেব?
এখন বঙ্গবন্ধুর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে আলোচনা করব। বাংলাদেশে নিষ্ঠুর গণহত্যা পরিচালনার জন্য দায়ীদের বিচার অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তারপরও বঙ্গবন্ধু তাদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর রহমান খান তার গবেষণামূলক গ্রন্থ 'থার্ড ওয়ার্ল্ড ক্যারিশম্যাট শেখ মুজিব অ্যান্ড দি স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম'-এ লিখেছেন :'পাকিস্তান হুমকি দিয়েছিল, যদি তাদের সামরিক অফিসারদের বিচার করা হয় তাহলে পাকিস্তানে যেসব বাঙালি সেনা অফিসার ও সরকারি কর্মকর্তা রয়েছেন তাদেরও বিচার করা হবে। তদুপরি, জুলফিকার আলি ভুট্টো বাংলাদেশ যেন জাতিসংঘের সদস্যপদ না পায় সেজন্যও এ বিষয়টি ব্যবহার করে চাপ সৃষ্টি করেন। যদিও সে সময় শতাধিক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, কিন্তু চীন ১৯৭২ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের আবেদনের বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান করে। ভুট্টো ইসলামী তাসও খেলেন ভালোভাবেই। তার চেষ্টার কারণে বেশিরভাগ আরব দেশ প্রথমদিকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান থেকে বিরত ছিল।'
কেন তিনি পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার করেননি, এ প্রশ্নে জিল্লুর রহমান খানকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন : 'স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিভিন্ন অপরাধের জন্য দায়ীদের শাস্তি প্রদানে আমি দৃঢ়পণ ছিলাম। এজন্য বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধ বিল পাস করা হয়। কিন্তু দুটি কারণে এ ধরনের বিচার অনুষ্ঠান করা যায়নি। পাকিস্তান সরকার হুমকি দিয়েছিল, এ বিচার অনুষ্ঠিত হলে পাকিস্তানি সামরিক শিবিরে আটক থাকা বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার করা হবে। আরেকটি কারণ ছিল, ইসলামী ঐক্য সংস্থা বা ওআইসির মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি। তারা বলছিল, বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের কথা ভেবে যেন এ বিচার অনুষ্ঠান করা না হয়। তারা এটা স্পষ্ট করে দেয়, ওআইসি ও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভে বাংলাদেশের চেষ্টার সাফল্য মূলত যুদ্ধাপরাধের বিচার করা-না করার ওপর নির্ভর করে। আমেরিকানরাও এটা চায়নি। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন এ বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে।' [পৃষ্ঠা ১৯৮-১৯৯]।
১৯৭২-১৯৭৩ সালের ঘটনাবলি যাদের স্মরণে রয়েছে তারা প্রায় চার দশক পর এটা স্বীকার করবেন, পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকদের ফিরিয়ে আনায় সরকারকে 'যে কোনো ত্যাগ স্বীকার' করার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের স্বজনরা মিছিল-সমাবেশ করেছিল। এর পেছনে মূল বিষয় ছিল মানবিকতা। আবার স্বাধীনতা এসে গেছে, এখন আর তিক্ততা বজায় রেখে লাভ কি, এমন মনোভাবের লোকও ছিল। পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো বাংলাদেশের একটি অংশের জনগণের এমন মনোভাবের কথা অবশ্যই জানতেন এবং এ কারণে তার পক্ষে চাপ সৃষ্টি করা সহজ হয়। তবে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে এটা কোনোভাবেই বোঝায় না যে, বাংলাদেশের যেসব নাগরিক একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠনে শুধু সহযোগিতা নয়, নিজেরাও তাতে মহা উৎসাহে শামিল হয়েছে তাদের বিচার করা যাবে না।

অজয় দাশগুপ্ত : মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.