সর্বনাশা by সুভাষ সাহা

শির দশকে অনেককেই ব্যাংক লোনের জন্য কসরত করতে দেখা যেত। তাদের মধ্যে এমন অনেকে থাকতেন যাদের লোনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করার অবস্থা ছিল না। রাজনৈতিক পরিচয়, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগাযোগ বা বড় সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই ছিল তাদের প্রধান সহায়। তাদের কেউ কেউ দাপটের সঙ্গেই লোন জোগাড় করে ফেলতে পারতেন। আবার অনেককে কিছুটা দক্ষিণা জোগাড় করে লোন ভাগ্যের ঝাঁপি


খুলতে হতো। তাদের প্রায় প্রত্যেককেই দেখা যেত লোনের অর্থ পেয়ে আলিশান অফিস আর চমৎকার গাড়ি প্রথমেই কিনে নিয়ে ব্যবসা-কারখানার কাজ ধরতে। এর সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ এবং ল্যাভিশ লাইফ লিড করার ব্যাপারটি তো অনেকেই জানতেন। ফলে এই নতুন ব্যবসাদারদের একটি অংশ ব্যাংকের দায় শোধ করতে না পেরে কালক্রমে ডিফল্টার হয়ে যেত। যাদের মামুর জোরটা শক্ত থাকত তারা সুদ মওকুফ করিয়ে নিয়ে পুনরায় লোনের ব্যবস্থা করে জীবনকে বাতাসে ভাসিয়ে রাখতেন। তাদের বিরাট একটি অংশ ব্যবসায়ী বা কারখানা মালিক হিসেবে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি। আসলে তারা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে নেওয়া অর্থকে 'সরকারকা মাল দরিয়ামে ঢাল' সুলভ মানসিকতা নিয়ে বিবেচনা করতেন। এই টাকা যে তাদের এক সময় শোধ করতে হতে পারে সে ভাবনাকেও অনেকেই প্রশ্রয় দিতেন না। তারা সঠিকভাবে ব্যবসায় মনোযোগী হলে দেশের অনেক উন্নতি হতে পারত। রুগ্ণ শিল্পের সংখ্যা বাড়ত না। নতুন নতুন কারখানা হতো, অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হতো।
ওই সময়ে তেমন আর একটা বাতিকও লক্ষ্য করা গেছে। অনেককেই বাড়ি তৈরির জন্য লোনের সন্ধানে এর-ওর কাছে তদবির করতে দেখা গেছে। এখানেও লোন পাওয়ার একই তরিকা। কিছু মাল ঢালো এবং তার বিনিময়ে বাড়ি তৈরির লোন নিয়ে যাও। লোন পাওয়ার পর সম্পত্তির মালিককে দেখা যেত ঠিকাদারদের সঙ্গে কত কম টাকা খরচ করে বাড়ি তৈরি করা যায় সে পরামর্শ করতে। উদ্দেশ্য ব্যাংক থেকে নেওয়া লোনের টাকার একটা অংশ নিজের পকেটে রেখে দেওয়া। এভাবে তখন ঢাকার সম্ভবত অনেক বাড়িই তৈরি করা হয়েছে। যার পরিণতি হাজার হাজার বাড়ি এখন ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। নিজে সপরিবারে যে বাড়িতে থাকবেন সে বাড়িটি অন্তত মজবুত করে তৈরি করা উচিত নয় কি! সরকারি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লোনের অর্থে যারা তখন বাড়ি করেছেন তাদের অনেককেই তখন সে হিসাবের ধার ধারতে দেখা যায়নি। ভূমিকম্পে বাড়িটি ধসে পড়লে সপরিবারে তিনি বা তার পরিবার-পরিজনই হতে পারেন এর নির্মম শিকার_ সে চিন্তাও তাদের হয়নি। একেই তবে আত্মঘাতী মানসিকতা বলে!
আমরা যারা ওই সময়ে এ ধরনের মানসিকতা দেখেছি তাদের কাছে এখনকার খাদ্যে ভেজাল মেশানো বা মাছে ফরমালিন দেওয়াকে স্বাভাবিকই মনে হবে। আসলে আমরা সেই আত্মবিধ্বংসী মানসিকতারই উত্তরাধিকার কি-না। সে কারণে যারা ফরমালিন মেশান বা খাদ্যে ভেজাল মেশান তাদের মনে একবারও এই চিন্তা উদয় হয় না যে, জনস্বাস্থ্যের পক্ষে গুরুতর ক্ষতিকারক দ্রব্য আত্মজের কাছে গিয়ে তার শরীরেও বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে।
আসলে এসবের বিরুদ্ধে বড় বড় বক্তৃতা-বিবৃতি চললেও এর অনুভব কিন্তু আমাদের জাতীয় মানসিকতায় এখনও আসেনি। সে কারণেই মেয়াদোত্তীর্ণর্ লক্ষাধিক গ্যাস সিলিন্ডার এখনও আমরা ব্যবহার করে চলেছি। রাজধানীতে সাধারণত গাড়িতে ব্যবহৃত হয় এসব সিলিন্ডারের অধিকাংশ। এসব গাড়ির একটি অংশ নিশ্চয়ই প্রাইভেট ট্যাক্সি বা জিপ। যারা এসব গাড়ির মালিক তারা অবস্থাপন্ন এবং তাদের অধিকাংশই শিক্ষিত বা শিক্ষিত অনেক মানুষ তাদের অধীনে কাজ করেন। তারাই যদি নিজের বা পরিজনের জীবন সংশয় হতে পারে জেনেও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার করেন তাহলে কাদের কাছে আমরা সুবিবেচনা আশা করব! স্বাধীনতার ৪০ বছরেও কি জাতির এই আত্মবিধ্বংসী মানসিকতার পরিবর্তন আমরা আশা করতে পারি না?

No comments

Powered by Blogger.