সাঈদী হুজুরের বেকসুর খালাস! by গোলাম মওলা রনি
শিরোনামটা দেখে আরো অনেকের মতো আপনি হয়তো চমকে যেতে পারেন। কিংবা অধীর হয়ে প্রশ্ন করতে পারেনÑ ঘটনাটা কী, একটু বলুন তো! ঘটনাটি বলব; কিন্তু তার আগে বলে নিই ঘটনার প্রেক্ষাপট। সময়টা ঠিক এখন আর মনে নেই, সম্ভবত ১৯৭৭ কিংবা ৭৮। অগ্রহায়ণ মাস। চার দিকে পাকা ধানের ম ম গন্ধ। পুরো দেশের অর্থনীতির ৯০ শতাংশই তখন গ্রামভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চালিত হতো। সেই অর্থনীতির পুরোধা ছিল কৃষি, গবাদিপশু পালন এবং তাঁত শিল্পের মতো আরো অনেক গ্রামভিত্তিক কুটির শিল্প। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গড়ে ৫০-৬০টি হাঁস-মুরগি, আট থেকে ১০টি ছাগল এবং চার থেকে পাঁচটি গরু পালা হতো। শাকসবজি, মাছ, ফলমূল ইত্যাদি নিজেরাই উৎপন্ন করত। ফলে লোকজন প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় কাটাত সারা বছর। অগ্রহায়ণ মাসে ব্যস্ততা একটু কম থাকত। আর সেই সময়ে তাদের মনও থাকত রঙরসে ভরা, মূলত নতুন ধানের আগমন, গাভীন গাইয়ের নতুন বাচ্চা প্রসব, দুধেল গাইয়ের অতিরিক্ত দুধদান এবং ফসল বিক্রির নগদ অর্থের কারণে এরা থাকত ফুরফুরে মেজাজে।
গ্রাম-গ্রামান্তরে বসত পালা গানের আসর। চলত যাত্রা, সার্কাস ও থিয়েটার। এত কিছুর মধ্যেও সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল বিচার গানের আসর। দুই পক্ষের দুই দল শিল্পী। একজন হলেন প্রধান গায়ক, বাকিরা যন্ত্রী। যন্ত্রীরা ঢোল, ঝুনঝুনি, হারমোনিয়াম, দোতারা বাজানোর পাশাপাশি প্রধান গায়কের সাথে কণ্ঠ মেলাত। এক পক্ষের প্রধান গায়ক তার দলবলসহ কখনো গানে গানে, আবার কখনো বা কথামালার মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের নানা কল্পকাহিনী, কুরআন-হাদিসের নানা প্রসঙ্গ এবং নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নানান আজগুবি তথ্য বর্ণনা করে লোকজনকে মাতিয়ে রাখত এবং প্রতিপক্ষের কাছে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করত। এক পক্ষের গান শেষ হলে অন্য পক্ষ দাঁড়িয়ে প্রথমে প্রতিপক্ষের প্রশ্নের উত্তর হয়তো বা গানে গানে, নয়তো বা কথামালার মাধ্যমে দিত এবং পাল্টা কিছু প্রশ্ন করে বসে যেত।
দেশে তখন অনেক নামকরা বিচার গানের দল ছিল। এরা এলে গানের আসর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত। যাত্রামঞ্চ কিংবা কীর্তনের মতো মাঝখানে মঞ্চ করে দর্শক-শ্রোতারা চার দিকে বসে পড়ত। ১০-১২ হাজার লোক দৈনিক সাত-আট ঘণ্টা ধরে এসব গান শুনত এবং কোনো কোনো আসর সাত-আট দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতো। বিচার গানের এক পক্ষের নাম হতো শরিয়ত এবং অপর পক্ষের নাম হতো মারেফত। এরপর উভয় পক্ষই চেষ্টা করত প্রমাণ করার জন্য ধর্মের মধ্যে কোনটি বড়? শরিয়ত না মারেফত? শিল্পীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে নানান রঙ্গরসের কাহিনী, প্রেম-ভালোবাসা, দেহতত্ত্ব, যৌনতা ইত্যাদি মিলিয়ে-মিশিয়ে একাকার করে ফেলত। কোনো মাইক ছাড়াই এসব শিল্পী কেবল খালি গলায় ১০-১২ হাজার মানুষকে মোহগ্রস্ত করে তাদের গানবাজনা শোনাত। এত বড় আসর চার দিকে সুমসাম নীরবতা দিন কিংবা রাত সারাক্ষণই হাজার হাজার নারী-পুরুষ একসাথে বসে বিচারগান শুনত।
আমি এখনো জানি না ওই সব শিল্পীর শিক্ষাদীক্ষা বা জ্ঞানের উৎস কী ছিল? কিন্তু এ কথা বুঝতে পারি যে, তাদের মেধা ও মননশীলতা ছিল অসাধারণ কবিত্বে পরিপূর্ণ এবং কণ্ঠে ছিল চমৎকার এক গায়কী সুর। তারা বাবরী চুল ঝুলিয়ে, দেহখানা দুলিয়ে, নাচতে নাচতে নারী-পুরুষকে শরীয়ত-মারেফত বর্ণনার নামে পাগল করে তুলত। যন্ত্রীদের সমস্বরে জোগান দেয়া এবং বাদ্যযন্ত্রের সুরছন্দ পরিবেশকে করে তুলত মোহময়। মানুষ মসজিদের ইমাম বা আলেম-ওলামাদের কাছে না গিয়ে বিচার গানের আসরে যেত ধর্মকর্ম সম্পর্কে জানার জন্য এবং যা জানত তা সম্পর্কে বিস্তারিত বলছি একটু পরে। সেই সময়টা, অর্থাৎ ১৯৭৭-৭৮ সালের অগ্রহায়ণ মাসে আমি একটি বিচারগান শুনতে গিয়েছিলাম ২০-২৫ মাইল পথ অতিক্রম করে। আমার এক হিন্দু শিক্ষক তার সাইকেলে করে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আমি সেখানে ছিলাম। অসংখ্য গানের মধ্যে শরিয়ত ও মারেফত পক্ষের দু’টি গানের কয়েকটি চরণ আজো আমার কানে বাজে। শরিয়তের শিল্পী গাইলেনÑ ফাতেমার ছলনা, আলীর প্রাণে সহে না, একদিন ঝগড়া করল তারা দুইজনাÑ মা ফাতেমা আলীর খেদমত জানতেন না। অন্য দিকে, মারেফতের শিল্পী সুর তুললেনÑ শরিয়তের মোল্লাজি! নামাজ পড়ার কায়দা জানো নি। নামাজ তো রে দূরের কথা, ওজু কেবল শিখছো নি...।
এসব বিচার গানের সুদূরপ্রসারী ও ভয়ঙ্কর প্রভাবে পুরো মুসলমান সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। যারা শরিয়তপন্থী তারা মসজিদে যেত এবং বিভিন্ন পীর কিংবা পীরের মাজারে গিয়ে ওরস, ওয়াজ নসিহত শুনত। পীরদের মধ্যেও ছিল ভয়ঙ্কর সব প্রতিযোগিতা। আর সেই প্রতিযোগিতায় নিজেদের প্রভাব অুণœ রাখার জন্য প্রায়ই তারা মারামারি করত। আমার বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার আবদুুস সোবাহান এখন মস্ত শিল্পপতি। তার ছেলেবেলায় দুই পীরের মারামারির মধ্যে পড়ে, আর একটু হলেই প্রাণ যেতে বসেছিল। সে তখন আট-নয় বছরের বালক। মাদরাসায় পড়ে। পাশাপাশি দুইটি গ্রামে দুইটি মাদরাসা চালাত দুইজন পীর। তারা একবার খুব ঝগড়া করল দোয়াললিন ও জোয়াললিন নিয়ে। এক পক্ষ বলছে, দোয়াললিন উচ্চারণ করতে হবে; আর অন্য পক্ষ বলছে, না, জোয়াললিন হবে। ঝগড়া মারামারিতে রূপ নিলো। উভয় পক্ষের শত শত ভক্ত, অনুরাগী, ছাত্র-শিক্ষক ঢাল-তলোয়ার এবং বড় বড় মুগুর নিয়ে মাঠে নেমে গেল। আমার বন্ধুটি তার চেয়েও লম্বা একটি মুগুর নিয়ে নেমে পড়ল। আজ আর সে মনে করতে পারছে নাÑ সেকি দোয়াললিনের পক্ষে, নাকি জোয়াললিনের পক্ষে ছিল? তবে তার বিলক্ষণ মনে আছে যে, মারামারি শুরু হওয়ার পর সে শত চেষ্টা করেও তার সমমানের কোনো বীর বালক প্রতিপক্ষের মধ্যে খুঁজে পায়নি, যার মাথায় মুগুরের বাড়ি বসিয়ে দোয়াললিন বা জোয়াললিনের জোশ ঢুকিয়ে দিতে পারে। মুগুর হাতে সে যখন প্রতিপক্ষের খোঁজে ব্যস্ত ঠিক তখনই কেউ একজন দড়াম করে তার পিঠে বসিয়ে দিলো কয়েক ঘা মুগুরের আঘাত। ওরে মাগো, ওরে বাবাগো বলে চিৎকার করতে করতে সোবাহান সেই যে মাঠ ছাড়ল আর ফিরল না। তবে সে ফিরেছিলÑ বহু দিন পর মস্তবড় এক টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে, আর তখন তার মাথায় না ছিল দোয়াললিন আর না ছিল জোয়াললিনÑ সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ, লম্বা কাহিনী। সময়-সুযোগ মতো আমরা একদিন বলব।
এবার মারেফতের কিছু নমুনা বলে মূল প্রসঙ্গে চলে যাবো। যারা বিচার গানের আসর থেকে এই বিশ্বাস নিয়ে ফিরত যে ইসলাম ধর্মে মারেফতই বড়, তারা নামাজ-কালাম ছেড়ে দিতো। গ্রামের বিভিন্ন জমিধারী, ফকির, মোল্লা, ওঝা বিভিন্ন লোকের কাছে যেত তাদের মুরিদ হওয়ার জন্য। এরপর নিজেরা বড় বড় দাড়ি, চুল ও মোচ রেখে চলাফেরা করত এবং সন্ধ্যার পর বসাত গাঁজা-গানের মারেফতি আসর। গাঁজার নেশায় বুঁদ হয়ে তারা অচেতন হওয়ার পূর্বে প্রলাপ বকত। কারো ওপর নবী, কারো ওপর আল্লাহ বা জিবরাইল ফেরেশতা ভর করেছে বলে প্রলাপ শুরু করত। আর ভক্তরা সব গাঁজার নেশায় বুঁদ হওয়া লোকটির জবানকে আল্লাহ-রাসূল বা জিবরাইলের কণ্ঠ মনে করে তার কাছে আবেদন-নিবেদন পেশ করত। অন্যরা সব একতারায় টুংটাং আওয়াজ তুলে গান গাইতÑ মদিনা যাবো ক্যামনে, মদিনা যাবো ক্যামনে! আসর জমে যেত মাঝরাতে যখন মারেফতের নারী-পুরুষেরা দেহের পর্দা আলগা করে মনের পর্দায় জোর দিতো এবং আরশে মহল্লায় ওঠার জন্য একজন অন্যজনের হাত ধরে দুনিয়াদারির শরিয়ত ভুলে যেত। তারা অদ্ভুত সব গানের তালে দেহ দুলিয়ে বেলেল্লাপনার চরম সীমায় উঠে নাচানাচি করত। দুই-একটা গানের কথামালা আমি এখনো মনে করতে পারি। এরা গাইতÑ মনের পর্দা টাইন্ন্যা দিয়া দেহের পর্দা তুলোরে, প্রেমসাগরে ডুব মারিয়া বাবাজানরে খুঁজরে!
ইসলাম ধর্মের এত যে বিকৃতি তা কিন্তু বিধর্মীরা করেনিÑ করেছে মুসলমানেরাই। এর অবশ্য অনেক কারণ ছিল এবং আজ অবধি সেই কারণগুলো বহাল আছে। শরিয়তের পণ্ডিত ব্যক্তিরা সব সময়ই ধর্মকে একটি ভীতিকর এবং আনন্দহীন বস্তুতে রূপান্তরিত করেছিল। তারা কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস কিংবা ইসলামি তাহজিব-তমদ্দুনের বিষয়গুলো এমনভাবে বর্ণনা করতেন যে, স্রোতারা তা শুনে না পেত কোনো আশার আলো, না কোনো বিনোদন। সব সময় শুধু ভয় দেখানো হতো। ফলে মানুষের মন-মননশীলতার ধর্মবোধ এবং ধর্মাকাক্সা সেখানেই চলে যেত, যেখানে রয়েছে ধর্মের সাথে কিঞ্চিৎ বিনোদন। আর এ কারণেই বিচার গানের আসর ও মাজারগুলোতে গানবাজনা কিংবা পীরের দরবারের গরুর গোশতের জিয়াফত ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
ইসলাম ধর্মের এহেন অকাল, দুরবস্থা, ফিতনা-ফাসাদের বিপরীতে মাওলানা সাঈদী শুরু করেছিলেন তার ওয়াজ মাহফিল। তিনি শুরু করেছিলেন হয়তো অনেক আগে; কিন্তু পরিচিতি আর জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন ৮০-এর দশকের প্রথম দিকেই। সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রির সংখ্যাকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো গানের শিল্পীর ক্যাসেট স্পর্শ তো দূরের কথাÑ কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। বাংলাদেশে সাঈদীর মাহফিলে সর্বোচ্চ যত লোকের সমাবেশ ঘটেছে, অত লোক দুনিয়ার কোনো স্থানে কোনো গানের শিল্পী, নাচের শিল্পী একক কিংবা সম্মিলিতভাবে জড়ো করতে পারেনি। পৃথিবীর কোনো খেলার ময়দান কিংবা আধুনিক স্টেডিয়াম সাঈদীর মাহফিলের দশ ভাগের এক ভাগ লোকও ধারণ করে কোনো খেলা দর্শকদের দেখাতে পারেনিÑ তা সে ক্রিকেট হোক বা ফুটবল কিংবা অন্য কোনো খেলার আসর। ৯০-এর দশকে সাঈদী যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, তখন তার মাহফিলগুলোতে কমপক্ষে এক লাখ এবং সর্বোচ্চ দশ লাখ লোক পর্যন্ত হাজির হতো।
কেন এত লোকসমাগম! কিংবা কেন এত জনপ্রিয়তা। সাঈদীর মাহফিলগুলোতে থাকত সুরেলা কণ্ঠ, গীতময় শব্দমালা, স্পষ্ট উচ্চারণ, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কুরআন-হাদিসের নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা বিবৃতির সম্মিলন। সর্বোপরি লাখো লোকের সমাবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার মতো নেতৃত্বগুণ, হুকুম দেবার ক্ষমতা এবং মানুষজনকে আনন্দরস, সৃজনশীলতা ও যুক্তিতর্কসহকারে কঠিন বিষয়গুলোকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করার অপরিসীম দক্ষতা। ৭০-এর দশক থেকে জেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি বছর ধরে তিনি একাদিক্রমে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজগুলো করে যাচ্ছিলেন। ফলে ওয়াজ মাহফিলে তার স্টাইলটিই সবাই অনুসরণ করতেন এবং এখনো করছেন। দীর্ঘ ৪০ বছরে তিনি নিজে এবং তার অনুসারীরা মিলে এ দেশীয় মুসলমানদের মনমানসিকতা বিচার গান, পালা গান, জারি, সারি, পুঁথিপাঠ, মাজারকেন্দ্রিক নৃত্যগীত থেকে প্রথমে ওয়াজ মাহফিলমুখী এবং পরে মসজিদ ও কিবলামুখী করে ফেলেন। একবার যে ব্যক্তি সাঈদীর মাহফিলে গেছেন কিংবা ক্যাসেট বা সিডি-ভিসিডি-ডিভিডিতে তার ওয়াজ শুনেছেন, সে ব্যক্তির ওপর ওয়াজিন হিসেবে তার বিরাট এক প্রভাব সৃষ্টি হয়ে যেত।
শুধু বাংলাদেশ নয়, আমি বলব সারা দুনিয়ায় সাঈদীর মতো অত সুরেলা কণ্ঠে প্রচণ্ড রিদমসহকারে কেউ মিলাদ পড়তে পারেনি। তিনি যখন সুর করে বলতেন নাহমাদুহু, ওয়ানাস তাইয়্যিনুহু, ওয়ানাস তাগ ফিরুহু, ওয়া নাউজু বিল্লাহি মিন সুরুরি, ওয়া আন ফুসিনা, ওয়া মিন সাইয়্যাতে আমালিনা... তখন মুহূর্তের মধ্যেই লাখ লাখ জনতা চুপ হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে তাকিয়ে চাতক পাখির মতো কিসের জন্য যেন অপেক্ষা করতে থাকতেন। সাঈদী আরো কিছুক্ষণ তিলাওয়াতের পর যখন বলতেন, ইয়া আইয়্যু হাল্লাজিনা আমানু সল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাছলিমা। তখন লাখো জনতা একত্রে একই সুরে গেয়ে উঠত আল্লাহুম্মা, সাল্লিআলা সাইয়্যাদিনা, মাওলানা মুহাম্মদ...। মাহফিলজুড়ে তখন মিলাদের ঝঙ্কার। লাখো মানুষের কণ্ঠের মিলাদ শুনে মনে হতো, আসমান থেকে যেন গমগম শব্দে রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ হচ্ছে।
সাঈদী কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের তফসির করতে গিয়ে প্রথমে আয়াতটি তিলাওয়াত করতেন। তিনি যখন পড়তেন, ইয়াওমা হুম বারিজুনা লা ইয়াখফা, আলাল্লাহি মিন শাইয়িনÑ লিমানিল মুলকুল ইয়াউমা লিল্লাহিল ওয়াহিদিল কাহহার! তখন মানুষের হৃদয়মন বিগলিত হয়ে যেত। অনেকে চোখের পানিতে বুক ভাসাত। মিলাদের মধ্যে তিনি যখন উর্দু কিয়ামগুলো আবৃত্তি করতেন তখন মানুষের কাছে পবিত্রতা এবং প্রশান্তি একসাথে চলে আসত। তিনি বলতেন, হো নায়ে এ ফুলতো, বুলবুল কাতারুননা ভি নাহোÑ দাহার মে কালিয়্যুকা তাবাসসুম ভি নাহো! এর পরপরই শ্রোতারা বলে উঠতেন, বালাগাল উলা বিকামালিহি, কাশাফাদ দুজা বিজামালিহি, হাসুনাত জামিউ খিছালিহি, সাল্লু আলাইহি ওয়ালিহি।
৪০টি বছর ধরে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, পথে-প্রান্তরে আল্লাহ-রাসূল- কুরআন-হাদিসের কথা বলতে বলতে একজন সাধারণ সাঈদী হয়ে গেলেন হজরত মাওলানা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রহ:। তার ভক্তরা শ্রদ্ধাসহকারে তাকে আড়ালে আবডালে ডাকতঃ সাঈদী হুজুর নামে। ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তিনি মানুষের বিবেকের জায়গা থেকে চলে গেলেন আবেগের স্পর্শিত স্থানে। হয়ে গেলেন নায়কঃ তারপর মহানায়ক এবং অনেকের কাছে স্বপ্নপুরুষ। কারো কাছে তিনি পীর আবার কারো কাছে মুরশিদঃ কেউবা বলেন ওলি আবার অন্য দল বলে আবদাল। তার সমালোচকদের সংখ্যাও কম নয়, তবে বেশির ভাগ সমালোচকই সাঈদী সাহেবের সাফল্যে চরমভাবে ঈর্ষিত। আর এ কারণেই তাদের সমালোচনা সমানতালে জনপ্রিয়তা পায়নি।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাঈদী সাহেব এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। গত চার বছর ধরে তাকে নিয়ে যত আলোচনা, সমালোচনা এবং বাগি¦তণ্ডাসহ নানা বিপত্তি ঘটেছে, তা বাংলাদেশে এর আগে কোনো দিন ঘটেনি। মানুষজন সাঈদী সাহেবের বিষয়টি কোনো দিন বিবেক দিয়ে ভাবেনি। তারা কেবল আবেগনির্ভর হয়ে বলে বেড়িয়েছে যে, তাদের স্বপ্নের নায়ক যুদ্ধাপরাধ করতে পারে না। এ দিকে ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত রায়ে বলা হেয়ছে, আমরা বর্তমানকালের বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন জনাব দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সাজা দিচ্ছি না, সাজা দিচ্ছি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পিরোজপুর অঞ্চলে সংঘটিত বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের নায়ক দেলোয়ার শিকদার ওরফে দেলু সিকদার ওরফে দেউল্ল্যা রাজাকারকে।
এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আসিঃ যেদিন জনাব দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার চূড়ান্ত রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে ঘোষিত হওয়ার কথাছিল, তার আগের দিনে তার মুক্তির জন্য দোয়া চেয়ে কে বা কারা লাখ লাখ মোবাইলে মেসেজ পাঠাতে থাকে। সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকেও আবেদন করে দোয়া চাওয়া হয়। বলা হয়, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সাঈদী হুজুরকে বেকসুর খালাসের ব্যবস্থা করে দাও। একদল লোক যেমন শান্তিপূর্ণভাবে খোদায়ী সাহায্য ভিক্ষা করছিল তেমনি অন্য আরেক দল চেষ্টা করছিল জমিনে অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য। এরই মধ্যে রায় ঘোষণা হলো। সাঈদী খালাস পাননি বটে, তবে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়েছেন। সাঈদী ভক্তদের মনে হলো, তারা বেজায় খুশি। তাদের ধারণা এবং বদ্ধমূল বিশ্বাসÑ তাদের স্বপ্নপুরুষ খুব তাড়াতাড়ি হয়তো আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বেকসুর খালাস পেতে যাচ্ছেন; কিন্তু সেটা কিভাবে? এই প্রশ্নের জবাব তারা নিম্নোক্তভাবে দিচ্ছেনঃ
‘ট্রাইব্যুনাল হজরত মাওলানা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সাজা দেননি। সাজা হয়েছে রাজাকার দেলু শিকদার ওরফে দেউল্ল্যা বা দেলু রাজাকারের। আর ওই শব্দমালার মধ্যেই রয়েছে জনাব সাইদীর মুক্তির সনদ। এখন তিনি যদি একটি রিট পিটিশন করে হাইকোর্টে আর্জি পেশ করেন যে, আমি দেলু রাজাকার নই, তখন সরকারের জন্য দায় হয়ে যাবে এটা প্রমাণ করার যে, এ লোকই দেলু রাজাকার। এর আগে ‘বার্ডেন অফ প্রুফ’ অর্থাৎ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দায় ছিল সাঈদীর; কিন্তু বর্তমানে রিট পিটিশনের মাধ্যমে সাঈদী সাহেব সেই দায়টি সরকারের দিকে ঠেলে দিতে পারলে বাংলাদেশের আইন আদালতের ইতিহাসে শুরু হবে এক নতুন অধ্যায়। হাইকোর্টের ওপেন ট্রায়ালে সরকারের দায় মেটানো যে কতটুকু সম্ভব আর কতটুকু অসম্ভব তা বোঝার জন্য খুব বেশি জুরিসপ্রুডেন্স জানার দরকার নেই।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
গ্রাম-গ্রামান্তরে বসত পালা গানের আসর। চলত যাত্রা, সার্কাস ও থিয়েটার। এত কিছুর মধ্যেও সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল বিচার গানের আসর। দুই পক্ষের দুই দল শিল্পী। একজন হলেন প্রধান গায়ক, বাকিরা যন্ত্রী। যন্ত্রীরা ঢোল, ঝুনঝুনি, হারমোনিয়াম, দোতারা বাজানোর পাশাপাশি প্রধান গায়কের সাথে কণ্ঠ মেলাত। এক পক্ষের প্রধান গায়ক তার দলবলসহ কখনো গানে গানে, আবার কখনো বা কথামালার মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের নানা কল্পকাহিনী, কুরআন-হাদিসের নানা প্রসঙ্গ এবং নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নানান আজগুবি তথ্য বর্ণনা করে লোকজনকে মাতিয়ে রাখত এবং প্রতিপক্ষের কাছে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করত। এক পক্ষের গান শেষ হলে অন্য পক্ষ দাঁড়িয়ে প্রথমে প্রতিপক্ষের প্রশ্নের উত্তর হয়তো বা গানে গানে, নয়তো বা কথামালার মাধ্যমে দিত এবং পাল্টা কিছু প্রশ্ন করে বসে যেত।
দেশে তখন অনেক নামকরা বিচার গানের দল ছিল। এরা এলে গানের আসর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত। যাত্রামঞ্চ কিংবা কীর্তনের মতো মাঝখানে মঞ্চ করে দর্শক-শ্রোতারা চার দিকে বসে পড়ত। ১০-১২ হাজার লোক দৈনিক সাত-আট ঘণ্টা ধরে এসব গান শুনত এবং কোনো কোনো আসর সাত-আট দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতো। বিচার গানের এক পক্ষের নাম হতো শরিয়ত এবং অপর পক্ষের নাম হতো মারেফত। এরপর উভয় পক্ষই চেষ্টা করত প্রমাণ করার জন্য ধর্মের মধ্যে কোনটি বড়? শরিয়ত না মারেফত? শিল্পীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে নানান রঙ্গরসের কাহিনী, প্রেম-ভালোবাসা, দেহতত্ত্ব, যৌনতা ইত্যাদি মিলিয়ে-মিশিয়ে একাকার করে ফেলত। কোনো মাইক ছাড়াই এসব শিল্পী কেবল খালি গলায় ১০-১২ হাজার মানুষকে মোহগ্রস্ত করে তাদের গানবাজনা শোনাত। এত বড় আসর চার দিকে সুমসাম নীরবতা দিন কিংবা রাত সারাক্ষণই হাজার হাজার নারী-পুরুষ একসাথে বসে বিচারগান শুনত।
আমি এখনো জানি না ওই সব শিল্পীর শিক্ষাদীক্ষা বা জ্ঞানের উৎস কী ছিল? কিন্তু এ কথা বুঝতে পারি যে, তাদের মেধা ও মননশীলতা ছিল অসাধারণ কবিত্বে পরিপূর্ণ এবং কণ্ঠে ছিল চমৎকার এক গায়কী সুর। তারা বাবরী চুল ঝুলিয়ে, দেহখানা দুলিয়ে, নাচতে নাচতে নারী-পুরুষকে শরীয়ত-মারেফত বর্ণনার নামে পাগল করে তুলত। যন্ত্রীদের সমস্বরে জোগান দেয়া এবং বাদ্যযন্ত্রের সুরছন্দ পরিবেশকে করে তুলত মোহময়। মানুষ মসজিদের ইমাম বা আলেম-ওলামাদের কাছে না গিয়ে বিচার গানের আসরে যেত ধর্মকর্ম সম্পর্কে জানার জন্য এবং যা জানত তা সম্পর্কে বিস্তারিত বলছি একটু পরে। সেই সময়টা, অর্থাৎ ১৯৭৭-৭৮ সালের অগ্রহায়ণ মাসে আমি একটি বিচারগান শুনতে গিয়েছিলাম ২০-২৫ মাইল পথ অতিক্রম করে। আমার এক হিন্দু শিক্ষক তার সাইকেলে করে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আমি সেখানে ছিলাম। অসংখ্য গানের মধ্যে শরিয়ত ও মারেফত পক্ষের দু’টি গানের কয়েকটি চরণ আজো আমার কানে বাজে। শরিয়তের শিল্পী গাইলেনÑ ফাতেমার ছলনা, আলীর প্রাণে সহে না, একদিন ঝগড়া করল তারা দুইজনাÑ মা ফাতেমা আলীর খেদমত জানতেন না। অন্য দিকে, মারেফতের শিল্পী সুর তুললেনÑ শরিয়তের মোল্লাজি! নামাজ পড়ার কায়দা জানো নি। নামাজ তো রে দূরের কথা, ওজু কেবল শিখছো নি...।
এসব বিচার গানের সুদূরপ্রসারী ও ভয়ঙ্কর প্রভাবে পুরো মুসলমান সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। যারা শরিয়তপন্থী তারা মসজিদে যেত এবং বিভিন্ন পীর কিংবা পীরের মাজারে গিয়ে ওরস, ওয়াজ নসিহত শুনত। পীরদের মধ্যেও ছিল ভয়ঙ্কর সব প্রতিযোগিতা। আর সেই প্রতিযোগিতায় নিজেদের প্রভাব অুণœ রাখার জন্য প্রায়ই তারা মারামারি করত। আমার বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার আবদুুস সোবাহান এখন মস্ত শিল্পপতি। তার ছেলেবেলায় দুই পীরের মারামারির মধ্যে পড়ে, আর একটু হলেই প্রাণ যেতে বসেছিল। সে তখন আট-নয় বছরের বালক। মাদরাসায় পড়ে। পাশাপাশি দুইটি গ্রামে দুইটি মাদরাসা চালাত দুইজন পীর। তারা একবার খুব ঝগড়া করল দোয়াললিন ও জোয়াললিন নিয়ে। এক পক্ষ বলছে, দোয়াললিন উচ্চারণ করতে হবে; আর অন্য পক্ষ বলছে, না, জোয়াললিন হবে। ঝগড়া মারামারিতে রূপ নিলো। উভয় পক্ষের শত শত ভক্ত, অনুরাগী, ছাত্র-শিক্ষক ঢাল-তলোয়ার এবং বড় বড় মুগুর নিয়ে মাঠে নেমে গেল। আমার বন্ধুটি তার চেয়েও লম্বা একটি মুগুর নিয়ে নেমে পড়ল। আজ আর সে মনে করতে পারছে নাÑ সেকি দোয়াললিনের পক্ষে, নাকি জোয়াললিনের পক্ষে ছিল? তবে তার বিলক্ষণ মনে আছে যে, মারামারি শুরু হওয়ার পর সে শত চেষ্টা করেও তার সমমানের কোনো বীর বালক প্রতিপক্ষের মধ্যে খুঁজে পায়নি, যার মাথায় মুগুরের বাড়ি বসিয়ে দোয়াললিন বা জোয়াললিনের জোশ ঢুকিয়ে দিতে পারে। মুগুর হাতে সে যখন প্রতিপক্ষের খোঁজে ব্যস্ত ঠিক তখনই কেউ একজন দড়াম করে তার পিঠে বসিয়ে দিলো কয়েক ঘা মুগুরের আঘাত। ওরে মাগো, ওরে বাবাগো বলে চিৎকার করতে করতে সোবাহান সেই যে মাঠ ছাড়ল আর ফিরল না। তবে সে ফিরেছিলÑ বহু দিন পর মস্তবড় এক টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে, আর তখন তার মাথায় না ছিল দোয়াললিন আর না ছিল জোয়াললিনÑ সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ, লম্বা কাহিনী। সময়-সুযোগ মতো আমরা একদিন বলব।
এবার মারেফতের কিছু নমুনা বলে মূল প্রসঙ্গে চলে যাবো। যারা বিচার গানের আসর থেকে এই বিশ্বাস নিয়ে ফিরত যে ইসলাম ধর্মে মারেফতই বড়, তারা নামাজ-কালাম ছেড়ে দিতো। গ্রামের বিভিন্ন জমিধারী, ফকির, মোল্লা, ওঝা বিভিন্ন লোকের কাছে যেত তাদের মুরিদ হওয়ার জন্য। এরপর নিজেরা বড় বড় দাড়ি, চুল ও মোচ রেখে চলাফেরা করত এবং সন্ধ্যার পর বসাত গাঁজা-গানের মারেফতি আসর। গাঁজার নেশায় বুঁদ হয়ে তারা অচেতন হওয়ার পূর্বে প্রলাপ বকত। কারো ওপর নবী, কারো ওপর আল্লাহ বা জিবরাইল ফেরেশতা ভর করেছে বলে প্রলাপ শুরু করত। আর ভক্তরা সব গাঁজার নেশায় বুঁদ হওয়া লোকটির জবানকে আল্লাহ-রাসূল বা জিবরাইলের কণ্ঠ মনে করে তার কাছে আবেদন-নিবেদন পেশ করত। অন্যরা সব একতারায় টুংটাং আওয়াজ তুলে গান গাইতÑ মদিনা যাবো ক্যামনে, মদিনা যাবো ক্যামনে! আসর জমে যেত মাঝরাতে যখন মারেফতের নারী-পুরুষেরা দেহের পর্দা আলগা করে মনের পর্দায় জোর দিতো এবং আরশে মহল্লায় ওঠার জন্য একজন অন্যজনের হাত ধরে দুনিয়াদারির শরিয়ত ভুলে যেত। তারা অদ্ভুত সব গানের তালে দেহ দুলিয়ে বেলেল্লাপনার চরম সীমায় উঠে নাচানাচি করত। দুই-একটা গানের কথামালা আমি এখনো মনে করতে পারি। এরা গাইতÑ মনের পর্দা টাইন্ন্যা দিয়া দেহের পর্দা তুলোরে, প্রেমসাগরে ডুব মারিয়া বাবাজানরে খুঁজরে!
ইসলাম ধর্মের এত যে বিকৃতি তা কিন্তু বিধর্মীরা করেনিÑ করেছে মুসলমানেরাই। এর অবশ্য অনেক কারণ ছিল এবং আজ অবধি সেই কারণগুলো বহাল আছে। শরিয়তের পণ্ডিত ব্যক্তিরা সব সময়ই ধর্মকে একটি ভীতিকর এবং আনন্দহীন বস্তুতে রূপান্তরিত করেছিল। তারা কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস কিংবা ইসলামি তাহজিব-তমদ্দুনের বিষয়গুলো এমনভাবে বর্ণনা করতেন যে, স্রোতারা তা শুনে না পেত কোনো আশার আলো, না কোনো বিনোদন। সব সময় শুধু ভয় দেখানো হতো। ফলে মানুষের মন-মননশীলতার ধর্মবোধ এবং ধর্মাকাক্সা সেখানেই চলে যেত, যেখানে রয়েছে ধর্মের সাথে কিঞ্চিৎ বিনোদন। আর এ কারণেই বিচার গানের আসর ও মাজারগুলোতে গানবাজনা কিংবা পীরের দরবারের গরুর গোশতের জিয়াফত ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
ইসলাম ধর্মের এহেন অকাল, দুরবস্থা, ফিতনা-ফাসাদের বিপরীতে মাওলানা সাঈদী শুরু করেছিলেন তার ওয়াজ মাহফিল। তিনি শুরু করেছিলেন হয়তো অনেক আগে; কিন্তু পরিচিতি আর জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন ৮০-এর দশকের প্রথম দিকেই। সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রির সংখ্যাকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো গানের শিল্পীর ক্যাসেট স্পর্শ তো দূরের কথাÑ কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। বাংলাদেশে সাঈদীর মাহফিলে সর্বোচ্চ যত লোকের সমাবেশ ঘটেছে, অত লোক দুনিয়ার কোনো স্থানে কোনো গানের শিল্পী, নাচের শিল্পী একক কিংবা সম্মিলিতভাবে জড়ো করতে পারেনি। পৃথিবীর কোনো খেলার ময়দান কিংবা আধুনিক স্টেডিয়াম সাঈদীর মাহফিলের দশ ভাগের এক ভাগ লোকও ধারণ করে কোনো খেলা দর্শকদের দেখাতে পারেনিÑ তা সে ক্রিকেট হোক বা ফুটবল কিংবা অন্য কোনো খেলার আসর। ৯০-এর দশকে সাঈদী যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, তখন তার মাহফিলগুলোতে কমপক্ষে এক লাখ এবং সর্বোচ্চ দশ লাখ লোক পর্যন্ত হাজির হতো।
কেন এত লোকসমাগম! কিংবা কেন এত জনপ্রিয়তা। সাঈদীর মাহফিলগুলোতে থাকত সুরেলা কণ্ঠ, গীতময় শব্দমালা, স্পষ্ট উচ্চারণ, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কুরআন-হাদিসের নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা বিবৃতির সম্মিলন। সর্বোপরি লাখো লোকের সমাবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার মতো নেতৃত্বগুণ, হুকুম দেবার ক্ষমতা এবং মানুষজনকে আনন্দরস, সৃজনশীলতা ও যুক্তিতর্কসহকারে কঠিন বিষয়গুলোকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করার অপরিসীম দক্ষতা। ৭০-এর দশক থেকে জেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি বছর ধরে তিনি একাদিক্রমে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজগুলো করে যাচ্ছিলেন। ফলে ওয়াজ মাহফিলে তার স্টাইলটিই সবাই অনুসরণ করতেন এবং এখনো করছেন। দীর্ঘ ৪০ বছরে তিনি নিজে এবং তার অনুসারীরা মিলে এ দেশীয় মুসলমানদের মনমানসিকতা বিচার গান, পালা গান, জারি, সারি, পুঁথিপাঠ, মাজারকেন্দ্রিক নৃত্যগীত থেকে প্রথমে ওয়াজ মাহফিলমুখী এবং পরে মসজিদ ও কিবলামুখী করে ফেলেন। একবার যে ব্যক্তি সাঈদীর মাহফিলে গেছেন কিংবা ক্যাসেট বা সিডি-ভিসিডি-ডিভিডিতে তার ওয়াজ শুনেছেন, সে ব্যক্তির ওপর ওয়াজিন হিসেবে তার বিরাট এক প্রভাব সৃষ্টি হয়ে যেত।
শুধু বাংলাদেশ নয়, আমি বলব সারা দুনিয়ায় সাঈদীর মতো অত সুরেলা কণ্ঠে প্রচণ্ড রিদমসহকারে কেউ মিলাদ পড়তে পারেনি। তিনি যখন সুর করে বলতেন নাহমাদুহু, ওয়ানাস তাইয়্যিনুহু, ওয়ানাস তাগ ফিরুহু, ওয়া নাউজু বিল্লাহি মিন সুরুরি, ওয়া আন ফুসিনা, ওয়া মিন সাইয়্যাতে আমালিনা... তখন মুহূর্তের মধ্যেই লাখ লাখ জনতা চুপ হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে তাকিয়ে চাতক পাখির মতো কিসের জন্য যেন অপেক্ষা করতে থাকতেন। সাঈদী আরো কিছুক্ষণ তিলাওয়াতের পর যখন বলতেন, ইয়া আইয়্যু হাল্লাজিনা আমানু সল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাছলিমা। তখন লাখো জনতা একত্রে একই সুরে গেয়ে উঠত আল্লাহুম্মা, সাল্লিআলা সাইয়্যাদিনা, মাওলানা মুহাম্মদ...। মাহফিলজুড়ে তখন মিলাদের ঝঙ্কার। লাখো মানুষের কণ্ঠের মিলাদ শুনে মনে হতো, আসমান থেকে যেন গমগম শব্দে রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ হচ্ছে।
সাঈদী কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের তফসির করতে গিয়ে প্রথমে আয়াতটি তিলাওয়াত করতেন। তিনি যখন পড়তেন, ইয়াওমা হুম বারিজুনা লা ইয়াখফা, আলাল্লাহি মিন শাইয়িনÑ লিমানিল মুলকুল ইয়াউমা লিল্লাহিল ওয়াহিদিল কাহহার! তখন মানুষের হৃদয়মন বিগলিত হয়ে যেত। অনেকে চোখের পানিতে বুক ভাসাত। মিলাদের মধ্যে তিনি যখন উর্দু কিয়ামগুলো আবৃত্তি করতেন তখন মানুষের কাছে পবিত্রতা এবং প্রশান্তি একসাথে চলে আসত। তিনি বলতেন, হো নায়ে এ ফুলতো, বুলবুল কাতারুননা ভি নাহোÑ দাহার মে কালিয়্যুকা তাবাসসুম ভি নাহো! এর পরপরই শ্রোতারা বলে উঠতেন, বালাগাল উলা বিকামালিহি, কাশাফাদ দুজা বিজামালিহি, হাসুনাত জামিউ খিছালিহি, সাল্লু আলাইহি ওয়ালিহি।
৪০টি বছর ধরে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, পথে-প্রান্তরে আল্লাহ-রাসূল- কুরআন-হাদিসের কথা বলতে বলতে একজন সাধারণ সাঈদী হয়ে গেলেন হজরত মাওলানা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রহ:। তার ভক্তরা শ্রদ্ধাসহকারে তাকে আড়ালে আবডালে ডাকতঃ সাঈদী হুজুর নামে। ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তিনি মানুষের বিবেকের জায়গা থেকে চলে গেলেন আবেগের স্পর্শিত স্থানে। হয়ে গেলেন নায়কঃ তারপর মহানায়ক এবং অনেকের কাছে স্বপ্নপুরুষ। কারো কাছে তিনি পীর আবার কারো কাছে মুরশিদঃ কেউবা বলেন ওলি আবার অন্য দল বলে আবদাল। তার সমালোচকদের সংখ্যাও কম নয়, তবে বেশির ভাগ সমালোচকই সাঈদী সাহেবের সাফল্যে চরমভাবে ঈর্ষিত। আর এ কারণেই তাদের সমালোচনা সমানতালে জনপ্রিয়তা পায়নি।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাঈদী সাহেব এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। গত চার বছর ধরে তাকে নিয়ে যত আলোচনা, সমালোচনা এবং বাগি¦তণ্ডাসহ নানা বিপত্তি ঘটেছে, তা বাংলাদেশে এর আগে কোনো দিন ঘটেনি। মানুষজন সাঈদী সাহেবের বিষয়টি কোনো দিন বিবেক দিয়ে ভাবেনি। তারা কেবল আবেগনির্ভর হয়ে বলে বেড়িয়েছে যে, তাদের স্বপ্নের নায়ক যুদ্ধাপরাধ করতে পারে না। এ দিকে ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত রায়ে বলা হেয়ছে, আমরা বর্তমানকালের বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন জনাব দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সাজা দিচ্ছি না, সাজা দিচ্ছি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পিরোজপুর অঞ্চলে সংঘটিত বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের নায়ক দেলোয়ার শিকদার ওরফে দেলু সিকদার ওরফে দেউল্ল্যা রাজাকারকে।
এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আসিঃ যেদিন জনাব দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার চূড়ান্ত রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে ঘোষিত হওয়ার কথাছিল, তার আগের দিনে তার মুক্তির জন্য দোয়া চেয়ে কে বা কারা লাখ লাখ মোবাইলে মেসেজ পাঠাতে থাকে। সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকেও আবেদন করে দোয়া চাওয়া হয়। বলা হয়, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সাঈদী হুজুরকে বেকসুর খালাসের ব্যবস্থা করে দাও। একদল লোক যেমন শান্তিপূর্ণভাবে খোদায়ী সাহায্য ভিক্ষা করছিল তেমনি অন্য আরেক দল চেষ্টা করছিল জমিনে অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য। এরই মধ্যে রায় ঘোষণা হলো। সাঈদী খালাস পাননি বটে, তবে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়েছেন। সাঈদী ভক্তদের মনে হলো, তারা বেজায় খুশি। তাদের ধারণা এবং বদ্ধমূল বিশ্বাসÑ তাদের স্বপ্নপুরুষ খুব তাড়াতাড়ি হয়তো আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বেকসুর খালাস পেতে যাচ্ছেন; কিন্তু সেটা কিভাবে? এই প্রশ্নের জবাব তারা নিম্নোক্তভাবে দিচ্ছেনঃ
‘ট্রাইব্যুনাল হজরত মাওলানা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সাজা দেননি। সাজা হয়েছে রাজাকার দেলু শিকদার ওরফে দেউল্ল্যা বা দেলু রাজাকারের। আর ওই শব্দমালার মধ্যেই রয়েছে জনাব সাইদীর মুক্তির সনদ। এখন তিনি যদি একটি রিট পিটিশন করে হাইকোর্টে আর্জি পেশ করেন যে, আমি দেলু রাজাকার নই, তখন সরকারের জন্য দায় হয়ে যাবে এটা প্রমাণ করার যে, এ লোকই দেলু রাজাকার। এর আগে ‘বার্ডেন অফ প্রুফ’ অর্থাৎ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দায় ছিল সাঈদীর; কিন্তু বর্তমানে রিট পিটিশনের মাধ্যমে সাঈদী সাহেব সেই দায়টি সরকারের দিকে ঠেলে দিতে পারলে বাংলাদেশের আইন আদালতের ইতিহাসে শুরু হবে এক নতুন অধ্যায়। হাইকোর্টের ওপেন ট্রায়ালে সরকারের দায় মেটানো যে কতটুকু সম্ভব আর কতটুকু অসম্ভব তা বোঝার জন্য খুব বেশি জুরিসপ্রুডেন্স জানার দরকার নেই।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
No comments