কালোমেঘ by মো. নজরুল ইসলাম
দেশীয় চিরতা হিসেবে সমধিক পরিচিত ও
‘বিকল্প কুইনাইন’ হিসেবে বহুল ব্যবহৃত কালোমেঘ বণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের
সম্ভাবনা উজ্জ্বল হচ্ছে। টাঙ্গাইলের মধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলার কৃষকরা এই
ভেষজ গাছটির চাষ করে লাভবান হচ্ছে। ইউনানি আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক ওষুধ
শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও এখন ঘাটাইলে কালোমোঘ ব্যবহার হচ্ছে। চিকিৎসা
বিজ্ঞানের মতে, কালোমেঘ জ্বর থেকে শুরু করে অজীন, যকৃতের গোলযোগসহ অনেক
জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ বন গবেষণা
ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) বর্ষজীবী বীরুৎ কালোমেঘের বৈজ্ঞানিক নাম
এন্ড্রোগ্রাফিস প্যানিকুলাটা নিস উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে একেনথেসী
পরিবারভুক্ত কালোমেঘ গাছ আধামিটার থেকে এক মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
কান্ড শাখা-প্রশাখা চারকোণাকৃতি, নরম ও সবুজ। মরিচ পাতার সদৃশ কালোমেঘ
পাতার অগ্রভাগ ও বোঁটার দিকে ক্রমশ সরু এবং বর্ণ গাঢ় সবুজ। আবহাওয়াগত
আনুকূল্যে বাংলাদেশের সর্বত্র কালোমেঘ জন্মে। বর্ষার শেষে পত্রকলা থেকে
লম্বা পুষ্পদণ্ড বের হয় এবং এ পুষ্পদণ্ডে হালকা সাদার মাঝে বেগুনি
ফোঁটাযুক্ত ১ সেন্টিমিটার লন্বা ফুলগুলো সাজানো থাকে । পরে লম্বালম্বিভাবে
দুই অংশে ৪-৫টি করে মোট ৮-১০টি বীজ থাকে। পাকা বীজের রং হালকা খয়েরি।
বর্ষার পর থেকে শীতকাল পর্যন্ত ফুল ও ফল হয়। সাধারণত জুন-জুলাই মাস চারা
লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে পরিপক্ব বীজ মাটিতে পড়ে আপনা আপনি কালোমেঘ গাছ
জন্মে। তুলনামূলকভাবে এটি ছায়াযুক্ত জায়গাতে বেশি জন্মায় বলে অন্য গাছের
নিচে এবং সাথী ফসল হিসেবেও এর চাষ করা যায়। সামান্য মাটি খুঁড়ে বীজ বপন
করলে ফলন বাড়ে। কালোমেঘ অঞ্চলভেদে কল্পনাথ হিসেবেও পরিচিত। অনেকে অত্যধিক
তেতো স্বাদের এ গাছ শুকিয়ে চিরতা বলে বিক্রি করে থাকে। দু’যুগের ব্যবধানে
ঘাটাইল উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কালোমেঘের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। চাষিরা
দিন দিন কালোমেঘ চাষের প্রয়োজনীয়তা অবগত হচ্ছেন। সরজমিন দেখা যায়, উপজেলার
সন্ধানপুর ইউনিয়নের গৌরিশ্বর ও কুশারিয়া গ্রামে প্রায় ১২ থেকে ১৫ বিঘা
জমিতে বাণিজ্যিকভাবে কালোমেঘের চাষ করা হয়। এছাড়া এ ঔষধি গাছের চাষ হচ্ছে
সন্ধানপুর, রসুলপুর, ধলাপাড়া ও দেওপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। এর
অগ্রপথিক চাষি গৌরিশ্বর গ্রামের হুরমুজ আলী (৫৫)। তিনি ১৯৮৫ সালে সর্বপ্রথম
যশোর থেকে পলিথিনে ভরে দুই তোলা পরিমাণে বীজ এনে বাড়ির পাশে ছিটিয়ে রাখেন।
ভালো ফলন হলে বিষয়টি অন্যদের নজরে আসে। তার কাছ থেকে বীজ নিয়ে অন্যরাও এর
চাষ শুরু করেন। এ কালোমেঘের চাষ গ্রামের অনেকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।
হুরমুজ আলী আগে অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করতেন। বিভিন্ন গাছের ছাল
বাকলের ব্যবসা করে কোনরকমে দিন চালাতো। সংসারে তখন নুন আনতে পানতা ফুরানোর
মতো অবস্থা। এখন কালোমেঘ চাষ করে তার সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। এ কালোমেঘ
চাষে আলাদা কোন যত্ন নেয়ার প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আঙিনা ও পতিত জমিতে বীজ
ছিটিয়ে রাখলেই চলে। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টিতে কোন সমস্যা হয় না। সাথী ফসল
হিসেবে কোন রকম খরচ ছাড়াই প্রতি বিঘায় ১২ থেকে ১৫ মণ কালোমেঘ উৎপাদন করা
হয়। যার বজারমূল্য মণপ্রতি চার হাজার টাকা। ভরা মওসুমে এ মূল্য দাঁড়ায় ১৪০০
থেকে ১৬০০ টাকা মণ। কৃষকরা জানান, সাধারণত বৈশাখ মাসে এ বীজ বপন করা হয়।
পরিপক্ব হয় কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে। এ কালোমেঘ কেনার জন্য ঢাকার
কাওরানবাজার থেকে মহাজনরা ঘাটাইলের গৌরিশ্বর ও কুশারিয়া গ্রামে আসেন।
গৌরিশ্বর গ্রামের হায়দার আলী, মজিবর রহমান; কুশারিয়া গ্রামের আব্দুল মজিদ,
নলমা গ্রামের রুস্তম আলী, মুসলিম উদ্দিন ও শাহেদ আলী এ কালোমেঘের আবাদ করে
বছরে অতিরিক্ত ৪০-৫০ হাজার টাকা আয় করছেন। বহুমাত্রিক ব্যবহার: চিরতার মতো
তিতা স্বাদের কালোমেঘের পুরো গাছটিই। ঔষধি গুণে ভরা। বৈজ্ঞানিক গবেষণায়
দেখা গেছে, কালোমেঘে রয়েছে রজন জাতীয় উপাদান কালোমেঘিন, তিক্ত কেলাসিত
ডাইটারপেন ল্যাকটোন, ডাইটারপেন গ্লকোসাইড ডি অক্সিএন্ড্রোগাফোলয়েডস, ইপি
জেনিল ইথার, অন্যান্য ফ্লাডোনয়েড ও ফেনলসহ বহু উপাদান। পাতায় রয়েছে বেট
সিটোস্টেরল গ্লকোসাইড, প্যানিকোলাইড ইত্যাদি। মূলে রয়েছে এন্ডোগ্রাফিন ও
প্যানিকোলিন আলপাসিটোস্টেরল ইত্যাদি। বিদেশে কুইনাইনের বিকল্প হিসেবে
কালোমেঘের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের দেশে স্মরণাতীতকাল থেকেই লোকজ
চিকিৎসা ক্ষেত্রে কালোমেঘ অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং গ্রাম্য কবিরাজ হাকীম ও
হোমিওপ্যাথিক জিকিৎসকরা বিভিন্ন রোগ চিকিৎসায় এটি অনেক ব্যবহার করে থাকেন।
বিশেষ করে যকৃতের বিভিন্ন রোগের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসেবে
কালোমেঘের ব্যবহার অনেক। এছাড়া কালোমেঘ রক্ত পরিষ্কার পাকস্থলীর
শক্তির্বধক, রেচক, কৃমিনাশক, জ্বর ও পেটের যাবতীয় রোগ যেমন: অজীন, অতিসার
বা উদরাময়, রক্ত আমাশায়, ঘা ও খোস-পাঁচড়া নিবারক। সমপ্রতি প্রমাণ পাওয়া
গেছে কলোমেঘ টাইফয়েড রোগেও এন্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে। মধুপুর কৃষি
গবেষণা ও উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ জানান, কালোমেঘ
বা চিরতার মধ্যে বহু মূল্যবান ক্যাফেইন। প্যারাসিটামলসহ অর্ধশতাধিক
এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক ও হারবাল ওষুধ তৈরিতে ক্যাফেইন গুরুত্বপূর্ণ
উপাদান হিসেবে কাজ করে। তিনি আরও জানান, তার সংস্থা কালোমেঘ চাষিদের মধ্যে
কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. মো. হযরত
আলি জানান, বাণিজ্যিকভিত্তিতে কালোমেঘ চাষ একটি ভাল উদ্যোগ। চাষিদের সব
ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
No comments