ব্যাপক রদবদল, তবুও গতি নেই কূটনৈতিক মিশনে by মিজানুর রহমান
কূটনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক রদবদল হয়েছে গত ক’মাসে। প্রাইজ পোস্টিং, রাজনৈতিক বিবেচনা, নিয়মিত বদলি ইত্যাদি মিলে ওই পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যেই রদবদলগুলো সম্পন্ন হয়েছে। উদ্দেশ্য বিদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক কার্যক্রমের গতি বাড়ানো এবং বিশ্ব দরবারে দেশ এবং নতুন সরকারের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা। কিন্তু না, এত রদবদলের পরও কূটনৈতিক মিশনগুলোতে কাজের গতি বাড়ছে না। বরং বেশ ক’টি মিশনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এক মিশনে বিশৃঙ্খলা সামাল দিতে না দিতেই আরেক মিশন অস্থির হয়ে উঠছে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে এমন সব গুরুতর অভিযোগ আসছে যা দেশের জন্য রীতিমত লজ্জাজনক। অবশ্য কোন কোন অভিযোগের পেছনে কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিংবা অনৈতিক লেনদেনের কথা শোন যায়। অভিযোগ ওঠার পরপরই সরকারের তরফে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সদস্যরা দলে দলে বিভিন্ন দেশে গিয়ে তদন্ত করেন। কিন্তু অনেক তদন্তের রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না। কূটনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতায় সরকারের নীতি-নির্ধারকরা তো বটেই, পেশাদার কূটনীতিকরাও ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা জানান, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে নতুন সরকার গঠনের ১০০ দিনের মধ্যে বিদেশ মিশনগুলোতে রদবদলের পরিকল্পনা নেয়া হয়। খসড়া তালিকাও তৈরি হয়ে যায়। সেটি কাটাছেঁড়া হয় এপ্রিল মাসব্যাপী। তালিকা চূড়ান্ত হলে রাষ্ট্রদূত বা হাই কমিশনারদের নাম পাঠিয়ে এগ্রিমো বা সম্মতি চাওয়া হয় সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে। একই সঙ্গে পুরনো কর্মকর্তাদের ফেরতের নোটিস দেয়া হয়। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। নতুনদের এগ্রিমো পাওয়া এবং পুরনোদের ফেরতের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ওই পাঁচ মাস সময় ব্যয় হয়েছে। পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, পরিবর্তনের ওই তালিকায় থাকা দিল্লিতে গত পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তারিক-এ করিম রয়েছেন। তার চুক্তির মেয়াদ জুলাইয়ে শেষ হয়েছে। তার বদলে সেখানে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। পেশাদার ওই কূটনীতিকের নিয়োগের বিষয়ে ইতিমধ্যে দিল্লির ক্লিয়ারেন্স পাওয়া গেছে। তার পদমর্যাদাও ঠিক হয়ে গেছে। বাকি শুধু গেজেট নোটিফিকেশন। তবে যেটুকু জানা গেছে, নতুন ওই হাই কমিশনার আগামী নভেম্বরের মধ্যে দায়িত্ব বুঝে নেবেন। গত সরকারের পুরো সময় ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা আকরামুল কাদেরের বদলে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ এম. জিয়াউদ্দিনকে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তিনি তার দায়িত্বও বুঝে নিয়েছেন। গত সরকারের আমলে পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালনকারী মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস শেষ সময়ে লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে বৃটিশ সরকারের সঙ্গে যে ধরনের সম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রত্যাশা করেছিল তা অর্জন করতে না পারায় সরকারের নীতি-নির্ধারকরা তার ওপর নাখোশ হন। তাছাড়া দেশটিতে থাকা বাংলাদেশী কমিউনিটির সঙ্গেও তিনি খুব একটি মিশতে পারেননি বলে অভিযোগ ওঠে। এসব বিবেচনায় তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ এবং নতুন মিশন ব্রাজিলে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মিজারুল কায়েসের বদলে লন্ডনে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান নবগঠিত সরকারের গুড বুকে স্থান পাওয়া রাষ্ট্রদূত আবুল হান্নান। তিনি জেনেভায় দীর্ঘ চার বছর স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সমপ্রতি তিনিও তার দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ও নতুন সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠনের অভিনন্দন আদায়ে তার বিশেষ অবদান ছিল। এসব কারণে লন্ডনে তার প্রাইজ পোস্টিং হয়েছে বলে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা আছে। ব্রাজিলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র্রদূত শামীম আহসানকে জেনেভায় স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনিও কাজ শুরু করেছেন বলে জানানো হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় গত সরকারের পুরো সময় রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী লে.জে. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর বদলে সেখানে নিয়োগ পেয়েছেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কাজী ইমতিয়াজ হোসেন। ব্যাংকক মিশনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (জাতিসংঘ) সাঈদা মুনা তাসনিম। মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমার মেয়াদ শেষ হওয়ায় সেখানে নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানো হয়েছে কলম্বো মিশনের রাষ্ট্রদূত মো. সুফিউর রহমানকে। তিনি এরই মধ্যে তার দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের রাষ্ট্র্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক তারিক আহসান। দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ মিশনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) আল্লামা সিদ্দিকী। অস্ট্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েছেন আরেক মহাপরিচালক আবু জাফর। কেবল রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার পদেই নয়, তাদের ডেপুটি পদেও বেশ পরিবর্তন আনা হয়েছে। লন্ডনে ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সরকারের চিফ অব প্রটোকল হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনকারী খন্দকার এম. তালহা। রিয়াদে উপ-রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন পররাষ্ট্র্র দপ্তরের মহাপরিচালক নজরুল ইসলাম। কিন্তু তার সেই নিয়োগ আদেশ বাতিল করতে হয়েছে একটি মিশনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রেক্ষিতে। বৈরুতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গৌসুল আজমকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। সেখানে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল যে সরকার তাকে ফেরত না আনলে তার বিরুদ্ধে লেবানন সরকার ব্যবস্থা নেবে এমন হুমকি ছিল। সেই মিশনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ঢাকা থেকে মহাপরিচালক নজরুল ইসলামকে পাঠানো হয়েছে। পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, বৈরুতের বিশৃঙ্খলা ঠেকানোর জন্য আপাতত নজরুল ইসলামকে সেখানেই থাকতে হচ্ছে। আর তাই তার রিয়াদের আদেশ বাতিল করা হয়েছে। গ্রিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের বিরুদ্ধে এক ভিনদেশী নারীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারে অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি এথেন্সে গিয়ে সেই অভিযোগ তদন্ত করেছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখনও আলোর মুখ দেখেনি। তবে পররাষ্ট্র দপ্তর সূত্রের দাবি, ওই রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে উত্থাপিত গুরুতর অভিযোগের তদন্তে গঠিত কমিটিতে একজন নারী কর্মকর্তাকেও রাখা হয়েছিল। তারও বক্তব্য নেয়া হয়েছে। ওই রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফেরত আসার নোটিস দেয়া হয়েছে জানিয়ে তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, তাকে ডাকা হলেও তিনি এখনই ফিরতে চান না। আরও কিছু সময় চান। অবশ্য সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে তাকে সময় দেয়ার জন্য পররাষ্ট্র দপ্তরে তদবির আছে বলেও দাবি করেন ওই কর্মকর্তা। অভিযুক্ত রাষ্ট্রদূত অবশ্য তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অসত্য বলে দাবি করেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের পেছনে সমপ্রতি গ্রিস ফেরত এক কূটনীতিকের হাত রয়েছে বলে পাল্টা অভিযোগ করেছেন তিনি। পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রশাসন অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে বলেন, কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ওঠে। তদন্ত হলে রহস্য বেরিয়ে আসে।
No comments