গাজায় আহত শিশুদের জন্য এক মহৎ প্রাণের সংগ্রাম
মহৎ এক মিশনে নেমেছেন ড. ইজ্জেলদিন
আবুয়েলাইশ। গাজায় ইসরাইলি বর্বরতায় আহত ১০০ শিশুকে চিকিৎসার জন্য তিনি নিয়ে
যেতে চান কানাডায়। কিছুদিন আগে ইসরাইলি বোমাবর্ষণ বিভীষিকার চিত্র
টেলিভিশনে দেখতে গিয়ে আর দশটা বিবেকবান মানুষের মতো তারও হৃদয় ভারাক্রান্ত
হয়ে ওঠে। তখনই এ পরিকল্পনা মাথায় আসে। নৃশংসতার এসব দৃশ্য আবারও ফিরিয়ে আনে
তার দুঃসহ অতীত স্মৃতি। গাজায় এর আগের যুদ্ধে ইজ্জেলদিন তার তিন কন্যা আর
এক ভাইঝিকে হারিয়েছিলেন। অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এই
শিশুদের মধ্যে আমি আমার মেয়েদের দেখতে পাই।’ তিনি আরও বলেন, ওদেরকে সারিয়ে
তোলার জন্য আমাদের অবশ্যই সাহায্য করতে হবে, যেন তারা পঙ্গুত্ব না বরণ করে।
আমি চাই এসব শিশুর কথা যেন সবাই শুনতে পায়। ইজ্জেলদিনের নিজের কাহিনী
একদিকে যেমন হৃদয়বিদারক অন্যদিকে তেমনি অনুপ্রেরণাদায়ক। গাজার জাবালিয়া
শরণার্থী ক্যাম্পে তার জন্ম। সেখানেই বেড়ে উঠেছেন। কঠোর পরিশ্রম করে
মেডিকেল স্কুল পাস করেছেন। অধ্যুষিত এলাকা, ইসরাইল ও অন্যান্য দেশে
গাইলোকোলোজিস্ট হিসেবে কয়েক বছর কাজ করেছেন। বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় তিনি একজন
বিশেষজ্ঞ। ইজ্জেলদিনের ওপর প্রথম বিশ্বের নজর পড়ে ২০০৮-০৯ সালে গাজায়
ইসরাইলি হামলার সময়। ১৬ই জানুয়ারির দুপুরে ইসরাইলের একটি বিমান হামলা আঘাত
হানে তার বাসায়। তার সন্তানদের শোয়ার ঘরের ওপর বিধ্বস্ত হয় বোমা। তিন
সন্তান বেসান (২১), মায়ার (১৫), আয়া (১৪) ও ১৭ বছরের ভাইঝি নুরের জীবনাবসান
হয় মুহূর্তেই। ওই ট্র্যাজেডির বিবরণ তিনি দিয়েছেন- ‘আই শ্যাল নট হেট: এ
গাজা ডক্টরস্ জার্নি’ শীর্ষক তার হৃদয়স্পর্শী স্মৃতিকথায়। ‘বিকট এক
বিস্ফোরণ হলো... বুঝতে পারলাম বিস্ফোরণের শব্দটা আসছে আমার মেয়েদের ঘর
থেকে... আমার সামনে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, আমি আশা করবো দ্বিতীয় কোন
ব্যক্তিকে যেন তা প্রত্যক্ষ করতে না হয়... আমার মেয়েদের আর ভাইঝির শরীরের
ছিন্নভিন্ন অংশ।’ ক্রোধ আর তীব্র শোকের তাড়নায় সে তার বন্ধু শোমি এল্ডারকে
ফোন করে। এল্ডার ছিলেন ইসরাইলের চ্যানেল ১০-এ কর্মরত একজন সাংবাদিক।
ঘটনাক্রমে তিনি তখন স্টুডিওতে খবর সম্প্রচার করছিলেন। ইজ্জেলদিনের কলটি
সম্প্রচার চলাআলে সরাসরি নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এল্ডার। স্পষ্টত হতবিহ্বল,
ক্রন্দনরত ইজ্জেলদিনের কণ্ঠে ছিল সাহায্যের আকুল আহ্বান। তার সেই
আর্তচিৎকার ইথার তরঙ্গ প্রবাহে সঞ্চারিত হলো সর্বত্র। হঠাৎই ইসরাইলি
দর্শকেরা যুদ্ধের প্রাণঘাতী মূল্য নিয়ে একজন ফিলিস্তিনির কণ্ঠ শুনতে পেলো।
এরপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। ইজ্জেলদিন এখন গাজা উপত্যকা থেকে অনেক দূরে।
কানাডার টরোন্টোতে তার কার্যালয়। সেখানের দেয়ালগুলোতে তার সন্তানদের ছবি আর
অসংখ্য সম্মাননা পুরস্কার। ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর দাল্লা লানা স্কুল অব
পাবলিক হেলথে বিশ্ব স্বাস্থ্য বিষয়ে তিনি একজন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। তিনি
নিজে একটি ফাউন্ডেশন স্থাপন করেছেন। সন্তানদের স্মৃতিতে নাম দিয়েছেন
ডটারস্ ফর লাইফ। তার এ ফাউন্ডেশন মধ্যপ্রাচ্যের মেয়ে ও নারীদের জন্য
শিক্ষা বৃত্তি দিয়ে থাকে। আর এখানে বৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা
কোন ধর্মের অনুসারী সেটা বিবেচ্য নয়। গত মাসে গাজায় সাম্প্রতিক লড়াই দেখে
সহায়তায় এগিয়ে আসার তাগিদ বোধ করেন তিনি। প্রায় রাতারাতি একটি খসড়া
পরিকল্পনা তৈরি করেন। চালু করেন ‘হিল ১০০ কিডস’ নামে একটি প্রকল্প। এ
উদ্যোগের অধীনে আহত ১০০ ফিলিস্তিনি শিশুকে চিকিৎসার জন্য কানাডায় নিয়ে আসতে
চান তিনি। অনেক দেশ ইতিমধ্যে আহত ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে
এগিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে রয়েছে তুরস্ক ও ভেনিজুয়েলা। তার এ পরিকল্পনায়
দ্রুতই সহায়তায় এগিয়ে আসে ওন্টারিও প্রদেশের একাধিক নামীদামি হাসপাতাল ও
স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এগিয়ে এসেছেন ওন্টারিওর প্রাদেশিক
স্বাস্থ্যমন্ত্রী এরিক হসকিন্স। মহতী এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে এখনও সব চেয়ে বড়
চ্যালেঞ্জ বাকি। সেটা হলো প্রয়োজনীয় ভিজিট ভিসা প্রদানে কানাডা সরকারের
সম্মতি পাওয়া।
No comments