ভাষাসেনাপতির বিদায় by সাযযাদ কাদির
ভাষাসৈনিক বলা হয় তাঁকে, আসলে তিনি ভাষাসেনাপতি। অন্যান্য সৈনিকের ভূমিকা, প্রচার প্রভৃতি দেখে শুনে জেনে এবং অন্য সকল বিষয় বিবেচনায় রেখে আমার মনে হয় বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের সৈনাপত্য তাঁরই ছিল। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ আন্দোলনকে গোটা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে তিনিই সৃষ্টি করেছিলেন ছাত্র-জনতার ভাষার লড়াই। এ লড়াইয়ের সূত্র ধরেই কালক্রমে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, স্বাধিকারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার লড়াই ও মহান মুক্তিযুদ্ধ। সবখানেই তাই দেখি ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা। বৃহত্তর জনসমাজকে আন্দোলন-সংগ্রামে এ রকম সম্পৃক্ত করার প্রেরণা ২৬ বছরের যুবক আবদুল মতিন পেয়েছিলেন অবশ্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই।
প্রাথমিক বিপর্যয়ের ফলে ১৯৪৮ সালে স্থগিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। এরপর নতুন ভাবে, নতুন উদ্যোগে, নতুন নেতৃত্বে এ আন্দোলনের যাত্রা শুরু ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ। এ যাত্রাই পরিণতি পেয়েছিল ১৯৫০-৫২ সালের কষ্টসাধ্য প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। শেষে ১৪৪ ধারা অমান্য করার মাধ্যমে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন, গুলিবর্ষণ ও মৃত্যুর প্রতিবাদে ২২শে ফেব্রুয়ারি গায়েবি জানাজা আহ্বান ও পালন এবং তার ফলে ২৩শে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত হয় ভাষা আন্দোলনের মহান বিজয়।
কি ঘটেছিল ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ? সেদিন ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চের আন্দোলন-সমাবেশের বার্ষিকী পালন উপলক্ষে ছাত্রসমাবেশ ঘটেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সেখানেই আবদুল মতিন বলেছিলেন, ‘গতানুগতিক বার্ষিকী উদযাপনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সাধারণ মানুষ ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যা চিন্তাভাবনা করে ও যা করতে বলে সেটা করাই হবে এই মুহূর্তের ভাষা আন্দোলনের জন্য সঠিক করণীয়। এই কাজটা ছাত্ররা করতে পারে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকামী ভাষাসংগঠনগুলোকে নিয়ে একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠনের মাধ্যমে। এই সংগ্রাম কমিটি দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুরূপ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলবে এবং ছাত্রদের সংগঠিত শক্তির মাধ্যমে আন্দোলনকে এমন ভাবে এগিয়ে নেবে যাতে জনগণ ধাপে-ধাপে শামিল হতে পারে এবং এই ভাবে ছাত্র ও জনগণের মিলিত শক্তিতে আন্দোলন এমন দুর্বার হয়ে উঠবে, যার কাছে শাসকরা মাথা নত করতে বাধ্য হবে। জনগণ, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ ছাত্ররা এটাই চায়, সুতরাং তাদের সে ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাকে এই ভাবে সংগঠিত করলে যে শক্তির উদ্ভব ঘটবে, তা হবে অপ্রতিরোধ্য ও অজেয়।
সেদিনের এ বক্তব্য সম্পর্কে পরে আবদুল মতিন লিখেছেন, ‘... সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাবের প্রেরণা ও সূত্র আমি পেয়েছিলাম ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চের কয়েক দিন আগে পুরাতন জাদুঘরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত নিম্ন বেতনভুক সরকারি কর্মচারীদের ব্যারাকগুলোর পার্শ্বস্থ এক চায়ের দোকানে কয়েকজন সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীর একান্ত নিজেদের মধ্যকার কথাবার্তার মধ্যে। সকালবেলার ওই চায়ের দোকানের এক টেবিলে তাঁরা আলোচনা করছিলেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে। তাঁদের মধ্যে একজন ছাত্ররা বাংলা ভাষার আন্দোলন অব্যাহত না রাখায় বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার জন্য সংগ্রাম শুরু করলেই তাঁরা ওই দাবিকে সমর্থন করে আন্দোলনে শামিল হতে পারেন। তাঁর কথাকে সমর্থন করে আর একজন বলছিলেন, বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার ওপরই নির্ভর করছে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ।... তাঁদের এই রকম ঘরোয়া কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আমি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের দিকনির্দেশ পেয়েছিলাম। তাঁদের কথাবার্তায় আমি ভালভাবে উপলব্ধি করেছিলাম যে, মানুষ কেবল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবেই চায় না, তারা তার জন্য আন্দোলনও করতে চায়। সে আন্দোলন কারা সূচনা করবে, কারা নেতৃত্বে দেবে সে সম্পর্কেও তাদের কথাবার্তায় ছিল সুস্পষ্ট আভাস।’
বস্তুত সেদিন আবদুল মতিনের প্রস্তাবমূলক বক্তব্যে সমবেত ছাত্ররা বিরাট সম্ভাবনা দেখতে পান ভাষা আন্দোলনের। তিনি লিখেছেন, ‘এইভাবে সাধারণ ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, উত্থাপিত প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে সমর্থনের ভিত্তিতে, সকল ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির সমন্বয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠিত হয়েছিল।’ এর পরের ঘটনা আজ বাংলা ও বাঙালির গর্বিত ইতিহাস।
আজ এই ভাষাসেনাপতি বিদায় নিয়েছেন তাঁর স্বপ্নসাধের প্রিয়ভূমি থেকে। বায়ান্ন’র রণাঙ্গনে বিজয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু রাজনীতির লড়াই নিয়ে যেতে পারেন নি রাজধানীতে। ছিলেন জনমানুষের সঙ্গে, তাই সিংহাসন তাঁর পাতা হয়েছিল আমজনতার দরবারে। আজ সেই দরবার থেকে তাঁকে জানাই বিপ্লবী অভিবাদন, কোটি-কোটি সালাম।
০৮.০৯.২০১৪
প্রাথমিক বিপর্যয়ের ফলে ১৯৪৮ সালে স্থগিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। এরপর নতুন ভাবে, নতুন উদ্যোগে, নতুন নেতৃত্বে এ আন্দোলনের যাত্রা শুরু ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ। এ যাত্রাই পরিণতি পেয়েছিল ১৯৫০-৫২ সালের কষ্টসাধ্য প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। শেষে ১৪৪ ধারা অমান্য করার মাধ্যমে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন, গুলিবর্ষণ ও মৃত্যুর প্রতিবাদে ২২শে ফেব্রুয়ারি গায়েবি জানাজা আহ্বান ও পালন এবং তার ফলে ২৩শে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত হয় ভাষা আন্দোলনের মহান বিজয়।
কি ঘটেছিল ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ? সেদিন ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চের আন্দোলন-সমাবেশের বার্ষিকী পালন উপলক্ষে ছাত্রসমাবেশ ঘটেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সেখানেই আবদুল মতিন বলেছিলেন, ‘গতানুগতিক বার্ষিকী উদযাপনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সাধারণ মানুষ ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যা চিন্তাভাবনা করে ও যা করতে বলে সেটা করাই হবে এই মুহূর্তের ভাষা আন্দোলনের জন্য সঠিক করণীয়। এই কাজটা ছাত্ররা করতে পারে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকামী ভাষাসংগঠনগুলোকে নিয়ে একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠনের মাধ্যমে। এই সংগ্রাম কমিটি দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুরূপ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলবে এবং ছাত্রদের সংগঠিত শক্তির মাধ্যমে আন্দোলনকে এমন ভাবে এগিয়ে নেবে যাতে জনগণ ধাপে-ধাপে শামিল হতে পারে এবং এই ভাবে ছাত্র ও জনগণের মিলিত শক্তিতে আন্দোলন এমন দুর্বার হয়ে উঠবে, যার কাছে শাসকরা মাথা নত করতে বাধ্য হবে। জনগণ, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ ছাত্ররা এটাই চায়, সুতরাং তাদের সে ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাকে এই ভাবে সংগঠিত করলে যে শক্তির উদ্ভব ঘটবে, তা হবে অপ্রতিরোধ্য ও অজেয়।
সেদিনের এ বক্তব্য সম্পর্কে পরে আবদুল মতিন লিখেছেন, ‘... সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাবের প্রেরণা ও সূত্র আমি পেয়েছিলাম ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চের কয়েক দিন আগে পুরাতন জাদুঘরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত নিম্ন বেতনভুক সরকারি কর্মচারীদের ব্যারাকগুলোর পার্শ্বস্থ এক চায়ের দোকানে কয়েকজন সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীর একান্ত নিজেদের মধ্যকার কথাবার্তার মধ্যে। সকালবেলার ওই চায়ের দোকানের এক টেবিলে তাঁরা আলোচনা করছিলেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে। তাঁদের মধ্যে একজন ছাত্ররা বাংলা ভাষার আন্দোলন অব্যাহত না রাখায় বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার জন্য সংগ্রাম শুরু করলেই তাঁরা ওই দাবিকে সমর্থন করে আন্দোলনে শামিল হতে পারেন। তাঁর কথাকে সমর্থন করে আর একজন বলছিলেন, বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার ওপরই নির্ভর করছে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ।... তাঁদের এই রকম ঘরোয়া কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আমি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের দিকনির্দেশ পেয়েছিলাম। তাঁদের কথাবার্তায় আমি ভালভাবে উপলব্ধি করেছিলাম যে, মানুষ কেবল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবেই চায় না, তারা তার জন্য আন্দোলনও করতে চায়। সে আন্দোলন কারা সূচনা করবে, কারা নেতৃত্বে দেবে সে সম্পর্কেও তাদের কথাবার্তায় ছিল সুস্পষ্ট আভাস।’
বস্তুত সেদিন আবদুল মতিনের প্রস্তাবমূলক বক্তব্যে সমবেত ছাত্ররা বিরাট সম্ভাবনা দেখতে পান ভাষা আন্দোলনের। তিনি লিখেছেন, ‘এইভাবে সাধারণ ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, উত্থাপিত প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে সমর্থনের ভিত্তিতে, সকল ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির সমন্বয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠিত হয়েছিল।’ এর পরের ঘটনা আজ বাংলা ও বাঙালির গর্বিত ইতিহাস।
আজ এই ভাষাসেনাপতি বিদায় নিয়েছেন তাঁর স্বপ্নসাধের প্রিয়ভূমি থেকে। বায়ান্ন’র রণাঙ্গনে বিজয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু রাজনীতির লড়াই নিয়ে যেতে পারেন নি রাজধানীতে। ছিলেন জনমানুষের সঙ্গে, তাই সিংহাসন তাঁর পাতা হয়েছিল আমজনতার দরবারে। আজ সেই দরবার থেকে তাঁকে জানাই বিপ্লবী অভিবাদন, কোটি-কোটি সালাম।
০৮.০৯.২০১৪
No comments