শব্দহীন তাঁতপল্লী
ব্যস্ত দোহার উপজেলার তাঁতপল্লী এখন ঝিমিয়ে পড়েছে। কাঁক ডাকা ভোর থেকে গভীর রাত খুটখাট তাঁতের শব্দ এখন আর নেই। আধো ঘুমে কাজ করছেন তাঁতিরা এই দৃশ্য চোখে পড়ে না। ঈদে দোহারের জয়পাড়ার লুঙ্গির চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় দিগুণ। যার ফলে এই সময়টায় কঠোর পরিশ্রম করেন তাঁতি পরিবার। ইকরাশী সড়ক পাড় গ্রামের তাঁতি আনোয়ার হোসেন জানান, পরিশ্রম অনুযায়ী সারা বছর তেমন একটা লাভ না হলেও ঈদে লুঙ্গির চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়ায় লাভ হয় বেশি। তাঁতিপল্লীর নারী কারিগররা জানান, শিশুকাল থেকে বাবার বাড়িতে কাজ শিখে এসে স্বামী সংসারের উন্নয়নে নিজেরাও তাঁতের ঘরোয়া কাজ করছেন। নিজেদের কাজ শেষে পরের বাড়ির তাঁতের কাজ করে নিজেদের হাত খরচও চালাচ্ছেন তাঁতপল্লীর গৃহিণীরা। উত্তর জয়পাড়া গ্রামের জাহানারা বেগম বলেন, ‘ব্যস্ততার মাঝে ঠিকমতো রান্নাবান্নার সময়ও পাই না।’ ঈদের পর এমনটি আর নেই। যারা তাঁতের কাজ করেন স্থানীয় ভাষায় এদের বলা হয় ‘কারিকর’। মূলত ‘কারিগর’ শব্দটি মৌখিক ভাষায় বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ‘কারিকর’-এ রূপান্তরিত হয়েছে বলে জানা যায়। স্থানীয় কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুতার মূল্য বৃদ্ধি, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, পাওয়ার লুম যন্ত্র স্থাপনের ফলে জয়পাড়া এলাকার অনেক তাঁতি পরিবারই তাঁতের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। যারা এখনও বাপ-দাদার এ পেশা ধরে রেখেছেন তাদের এই একটি মাসই বসন্তকাল। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দোহার উপজেলার জয়পাড়ার লুঙ্গি দেশ-বিদেশে সমানভাবে জনপ্রিয়। জয়পাড়ার লুঙ্গির চাহিদা ও সুনাম বিশ্বজুড়ে। জয়পাড়ার লুঙ্গির বৃহৎ বাজার ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইল। সেখান থেকে বিভিন্ন বড় ব্যবসায়ীর মাধ্যমে জয়পাড়ার লুঙ্গি ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। এছাড়া দোহার উপজেলার দুই-তৃতীয়াংশ কর্মজীবী মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করায় জয়পাড়ার লুঙ্গির কদর দেশের সীমানা ছাড়িয়েছে বহু দিন আগেই। প্রায় চার দিন ৮০ ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তৈরি হয় এক ভিম (ছয়টি) লুঙ্গি। এরপর ঐতিহ্যবাহী জয়পাড়া হাটে ও স্থানীয় মহাজনদের মাধ্যমে তবুও ন্যায্যমূল্য লুঙ্গি বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হয় বলে অভিযোগ করেন তাঁতিরা। সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, দোহার উপজেলার চর-জয়পাড়া, উত্তর জয়পাড়া, খালপাড়, বৌ-বাজার, লটাখোলা, আন্তা বাহ্রা, ধোয়াইর, ইকরাশী, মেঘুলা, নারিশা গ্রামের তাঁতি সম্প্রদায় মহাব্যস্ত লুঙ্গি তৈরির কাজে। পরিবারের ছোট ছোট বাচ্চারাও বাবা-মাকে লুঙ্গি তৈরিতে সাহায্য করছেন। স্থানীয় কারিগরদের অভিযোগ, সুতার মূল্য ও শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ। সে হিসেবে বাড়েনি লুঙ্গির দাম। ফলে ঈদের এই একটি দিন ছাড়া এ ব্যবসায় সুবিধা করতে পারছে না তাঁতশিল্প মালিকরা।
No comments