দেশে-বিদেশে রাজনীতিতে মিস্টার বেপরোয়া! by কামাল আহমেদ
একজন রাজনীতিকের নাম যদি হয় বেপরোয়া,
তাহলে বিষয়টা কেমন দাঁড়ায়? একবার ভেবে দেখুন তো। কথাটা যে বহুল বিতর্কিত
রাজনীতিক লতিফ সিদ্দিকীকে ঘিরেই মনে এসেছে, তা গোড়াতেই স্বীকার করে
নেওয়া ভালো। বিষয়টি কাকতালীয় কি না জানি না। তবে মার্ক রেকলেস
(‘বেপরোয়া’ কথাটির আক্ষরিক ইংরেজি প্রতিশব্দ) নামের একজন রাজনীতিক
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে সত্যি সত্যিই বেপরোয়া এক কাণ্ড করে ব্রিটেনের
রাজনীতিতে আলোড়ন তুলেছেন। তিনি ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান শরিক
কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক সাংসদ। ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রের সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর বার্ষিক সম্মেলন, যেখানে দলের
তৃণমূলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোয় দলের
নীতিনির্ধারণ করে থাকেন। আগামী বছরের মে মাসে অনুষ্ঠেয় ব্রিটিশ সাধারণ
নির্বাচনের প্রাক্কালে শেষ সম্মেলনটি নির্বাচনী কৌশল ও প্রচারণার আবহ তৈরির
জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের
পুনর্নির্বাচনের জন্য এবারের সম্মেলনটি যেভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করা
হয়েছিল, তাতে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের আশাবাদ তৈরি হয় যে তাঁরা
এক নতুন নির্দেশনা নিয়ে ভবিষ্যৎ বিজয়ের ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হবেন।
কিন্তু সম্মেলনের ঠিক আগের রাতে ২৭ সেপ্টেম্বর সবকিছু এলোমেলো করে দেন
মার্ক রেকলেস। তিনি কনজারভেটিভ পার্টি ছেড়ে কট্টর ডানপন্থী ও ইউরোপীয়
সংহতিবিরোধী রাজনীতিক নাইজেল ফারাজের দল ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টিতে
(ইউকেআইপি) যোগ দিয়ে সাংসদ পদ ত্যাগ করেন এবং নতুন করে ভোটারদের ম্যান্ডেট
চাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। কট্টর ইংলিশ জাতীয়তাবাদী ধারার যেসব রাজনীতিক এত
দিন কনজারভেটিভ পার্টির ছায়ায় জোটবদ্ধ থেকে দলটিকে ইউরোপীয়
ইউনিয়নবিরোধী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের মধ্যে রেকলেস
হলেন দ্বিতীয় সাংসদ, যিনি প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের নেতৃত্বের প্রতি
অনাস্থা প্রকাশ করলেন। ফলে রক্ষণশীল রাজনীতিতে অনৈক্য ও ভাঙনের সুর
ক্যামেরনের প্রতি এক নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
ব্রিটিশ রাজনীতিতে মি. ‘বেপরোয়া’র এই তাক লাগানো অঘটন যেদিন ঘটল, তার পরদিন নিউইয়র্কে চমক দেখালেন আমাদের বাংলাদেশি মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। লাগামছাড়া বক্তব্য-বিবৃতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি এবং সরকারি কর্মকর্তা, বিদেশি কূটনীতিক ও সমাজের শ্রদ্ধাস্পদ ব্যক্তিদের প্রতি অশোভন আচরণের জন্য বিতর্কিত মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী এবার ধর্ম ও প্রধানমন্ত্রী-তনয় সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করে বিতর্কের এক নতুন মাত্রা রচনা করলেন। গত বছরের রাজনৈতিক ডামাডোলের সময় হরতাল আহ্বানকারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হত্যার আহ্বান জানানোর পরও তাঁর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আস্থায় কোনো ঘাটতি হয়নি। ফলে ভোটারবিহীন নির্বাচনে সরকারের বৈধতার বিতর্কিত নবায়নের পর তাঁকে আবারও মন্ত্রিত্বের পদে দেখা যায়। এরপর প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক ফোরামেও তাঁকে সফরসঙ্গী করেন। সেই সরকারি সফরসূচির ফাঁকে ২৮ সেপ্টেম্বর তাঁর এলাকাবাসীর সঙ্গে আলোচনায় লাগামছাড়া মন্তব্য করে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেমন উত্তাপ ছড়িয়েছেন, তেমনি জন্ম দিয়েছেন নানা ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের।
ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে বিশ্বাসীদের অনেকের ধারণা, সরকারকে বিপদে ফেলতেই লতিফ সিদ্দিকীর এই বেফাঁস মন্তব্য। হত্যার উসকানি, সরকারি কর্মকর্তাদের শারীরিকভাবে নাজেহাল করা কিংবা কূটনৈতিক শালীনতা লঙ্ঘন করে একজন বিদেশি কূটনীতিককে চিঠি লিখে সরকারকে বিব্রত করার ঘটনাগুলোর কথা হয়তো তাঁরা ভুলে গেছেন। গৃহপালিত পশুপাখিদের আশকারা দিলে তারাও যেমন সময়-অসময়ে গৃহে বিপত্তি ডেকে আনে, মানুষের ক্ষেত্রেও তেমনটিই তো স্বাভাবিক। প্রতিটি সরকারকেই নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে চলতে হয় এবং সম্ভাব্য সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হয়। কিন্তু যে সরকার এসব গুরুতর অসদাচরণ ও অপরাধ আমলেই নেয় না, তাদের জন্য বাড়তি ঝুঁকি সৃষ্টির দায়িত্ব তো তাদেরই।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশন এবং যুক্তরাষ্ট্র সফরের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সংবাদ সম্মেলন করেন, সেখানে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সরকার পরিচালনায় নানা বিধিবিধান মেনে চলার গুরুত্বটা সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। (এখানে অবশ্য বলে নেওয়া ভালো যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সংবাদমাধ্যমের সামনে যতটা হাজির হন, তাঁর পূর্বসূরি কখনোই তেমনটি করেননি।) রুলস অব বিজনেস অনুসরণ করে মন্ত্রীকে অপসারণে কেন একটু বেশি সময় লাগছে, তার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, যে হজ সম্পর্কে লতিফ সিদ্দিকী আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন, সেই হজের সুবাদেই তাঁর পদচ্যুতি বিলম্বিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যায়, রাষ্ট্রপতি হজ থেকে না ফেরা পর্যন্ত তাঁকে অপসারণ করা সম্ভব ছিল না। প্রধানমন্ত্রী এমনকি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের হজে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন। অবশ্য তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বলেছিলেন কি না, সে বিষয়টি তিনি খোলাসা করেননি। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে অবশ্য অন্য অনেক প্রশ্নেরই জবাব মেলেনি। যেমন রাষ্ট্রপতি হজে গেছেন ১ অক্টোবর—সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কথিত অপরাধের দুই দিন পর। তাহলে ওই দুই দিনে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারার কারণ কী? সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এই বিতর্কিত মন্তব্যের পর লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রী হিসেবেই সরকারি কাজে অন্য আরেকটি দেশ মেক্সিকোতে গিয়েছিলেন। যদিও পরে তাঁর বদলে প্রতিমন্ত্রীকে দেশের পক্ষে পুরস্কার গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল এবং সেটাই হয়েছে। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে যে মন্ত্রীর সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ ছিল এবং তাঁকে পুরস্কার নিতে মানা করা হয়েছিল। সুতরাং তাঁর পদত্যাগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার কথা এবং তাঁকে দেশে ফেরার নির্দেশনা দেওয়া যে সম্ভব ছিল না, তেমনটা বলা চলে না। তাহলে কি বিতর্কিত এই মন্ত্রী সে রকম নির্দেশনা অমান্য করেছেন? সে কারণে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাঁকে অপসারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে?
অতীতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী মোতায়েনের অনুরোধ করলে প্রধানমন্ত্রী (প্রতিরক্ষামন্ত্রী) দেশে না থাকায় তা সম্ভব হয়নি বলে একধরনের গোঁজামিলপূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছিল, দেশের বিদ্যমান শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে কেউ ভারপ্রাপ্ত হন না কেন। লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় বিলম্বের পর সেই প্রশ্নটিই কি আবারও ফিরে আসছে না? এর আগে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকারের সেই দায়িত্ব পালনের কথা সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেওয়ার নজির আছে। তাহলে রাষ্ট্রপতির হজে যাওয়ার সময়ে এবার কি স্পিকার সেই দায়িত্বে আসীন ছিলেন না? প্রশাসনে ঈদের ছুটির একটা প্রভাব সব সময়ই পড়ে থাকে, সেটা ঠিক। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে উৎসব বা ছুটির দিনগুলোয় রাষ্ট্রযন্ত্র বা সরকার সচল থাকে না। মন্ত্রী পর্যায়ের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১০ দিনেও যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না যায়, তাহলে তা কি ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রের সামর্থ্যের দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হবে?
লতিফ সিদ্দিকী নিউইয়র্কের ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কেও কিছুটা তাচ্ছিল্যের ভাষা ব্যবহার করায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রণালয় পরিচালনা-সম্পর্কিত কোনো মতভিন্নতা এর জন্য দায়ী কি না, এমন প্রশ্নই উঠে এসেছে সেসব আলোচনায়। প্রশ্ন উঠেছে, সজীব ওয়াজেদ জয়ের তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক দায়িত্বের বিষয়টি সর্বত্র আলোচিত হলেও সরকারি ওয়েবসাইটে মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের তালিকায় তাঁর নাম নেই কেন? অবশ্য একই প্রশ্ন ওঠে সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর ক্ষেত্রেও। তিনি কি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা, নাকি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর উপদেষ্টা? দলীয় প্রধানের উপদেষ্টা হলে তাঁদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার অবকাশ নেই। কিন্তু সরকারি দায়িত্বের ক্ষেত্রে তাঁদের বিষয়ে রাষ্ট্রের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনই সাধারণ নাগরিকদেরও সে বিষয়ে তথ্য জানার অধিকার রয়েছে।
রাজনীতির সঙ্গে সম্ভবত বেয়াড়াপনার একটা ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বেপরোয়া কর্তৃত্ব করে থাকে নিজের ক্ষমতার দাপট দেখাতে, আবার কেউ কেউ তা করে থাকে নির্বুদ্ধিতার কারণে, আর তৃতীয় আরেক দল এটি করে থাকে সুযোগ বুঝে কাউকে বেকায়দায় ফেলে শিক্ষা দেওয়ার মানসে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তৃত্ববাদী শীর্ষ নেতারা যে দলের ভেতরে-বাইরে মাঝেমধ্যে কিছুটা বেপরোয়া বা চরম পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন, তাতে কেউ তেমন একটা বিস্মিত হন না। কেননা, সেগুলো দলের ভেতরে তাঁদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক সময় অপরিহার্য বলেই মনে হয়। এসব দলে গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে বিষয়টি নিশ্চয়ই অন্য রকম হতো। কোনো মি. রেকলেস সরকারকে বেকায়দায় ফেললেও তাঁকে ঘিরে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ডালপালা বিস্তৃত হতো না। বরং বিতর্কটি হতো রাজনৈতিক মতাদর্শগত।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
No comments