অর্থ কেলেঙ্কারির ত্বরান্বিত বিচার by আলী ইদরিস

সমাজে যত অপরাধ সংঘটিত হয় তার বেশির ভাগের পেছনে অন্তর্নিহিত কারণ থাকে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন। যেমন চুরি-চামারি, পকেটমারা, ছিনতাই, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ইত্যাদি। অভাবের তাড়নায় হোক বা লোভে হোক এরা সবাই অর্থের জন্যই অপরাধগুলো ঘটায়। এরা হলো ছোট বা খুচরা চোর বা ক্ষুদ্র অপরাধী। সাধারণত দণ্ডবিধির আওতায় তাদের বিচার হয়। আর বড় চোর হলো যারা বিভিন্ন অসৎ উপায়ে ব্যাংকের বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বা জনসাধারণের বড় অংকের  অর্থ আত্মসাৎ করে অথবা বিদেশে পাচার করে- এরাও অপরাধী, কিন্তু বড় অংকের পাইকারি চোর। তাদের বিচারও দণ্ডবিধির আওতায় হয়। এখানে আমার বিনীত প্রস্তাব হলো যেহেতু বড় অর্থ আত্মসাতে বা কেলেঙ্কারিতে জাতীয় বা জনসাধারণের অর্থ ও স্বার্থ  জড়িত, রাষ্ট্রীয় সুশাসনের প্রশ্ন জড়িত, দণ্ডবিধির আওতায় বিচার কার্যক্রমে সাক্ষী-সাবুদ দিয়ে প্রমাণ করার ব্যাপারে দীর্ঘ সময়ের প্রশ্ন জড়িত, সেহেতু দ্রুত বিচার আদালত বা অন্যান্য  ট্রাইব্যুনালের মতো অর্থ কেলেঙ্কারি বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালের অধীনে তাদের বিচার হওয়া উচিত। তাতে বড় বড় দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনাও কমে আসতো। চার বছর আগে সংঘটিত শেয়ারবাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ  লুটের বিচার, ডেসটিনি কর্তৃক নিরীহ মানুষের অর্থ আত্মসাতের বিচার, সোনালী ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের বিচার আরও অনেক অপরাধের বিচার এখনও হয়নি। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান যেমন মানুষের বাঁচার জন্য অপরিহার্য, তেমনি সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ত্বরান্বিত বিচারও অপরিহার্য। অর্থ লোভ যেমন সর্বনাশ করে, অর্থ হারানোর ব্যথাও তেমনি অসহনীয়। শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দু’ একজন  অর্থ হারিয়ে আত্মহত্যা করেছে, ডেসটিনির কোন কোন বিনিয়োগকারী  সর্বস্ব হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিচার পাওয়া জনগণের মৌলিক অধিকার। দু’ চার দিন কিছু না খেয়েও মানুষ বাঁচতে পারে, অপরাধের বিচার না পেলে সাধারণ মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাই যুগে যুগে সমাজ ও রাষ্ট্র অপরাধের যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে কাজী, পঞ্চায়েত, আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে বিচারের ব্যবস্থা করেছে। আজ দেশে বড় অংকের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে  ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকেই  অর্থের লোভে অর্থ আত্মসাতের  দুর্নীতিতে মত্ত  হয়ে উঠেছে। সবশেষে বেসিক  ব্যাংকের  অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ব্যাংকের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হলো কিন্তু তাকে আইনের আওতায় বিচার করা হয়নি। সরকারি মালিকানাধীন এই ব্যাংকের মূলধন জনগণের করের অর্থ থেকে পরিশোধিত। শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হলো, সেটা সাধারণ নিরীহ জনগণের টাকা, সোনালী ব্যাংকের লুণ্ঠিত  টাকা জনসাধারণের করের টাকা, ডেসটিনি কর্তৃক লুণ্ঠিত অর্থ নিরপরাধ জনগণের টাকা, এ রকম আরও অনেক পুরানো অপরাধের বিচার হয়নি, হয়তো কোন কোনটার বিচার চলছে। কিন্তু অর্থ হারিয়ে যারা আত্মহত্যা করলো তারা বিচার দেখে যেতে পারে নি, এখন যারা অর্থের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে, তারা কি বিচার দেখতে পারবে? অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব সময়মতো বিচার সম্পন্ন করে ভুক্তভোগীর অর্থ ফিরিয়ে দেয়া। যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুট বা আত্মসাৎ করেছে তারা দেশের সর্বনাশ করেছে। এ অর্থ দিয়ে সরকার উন্নয়ন কর্ম করতে পারতো, বেকারত্ব, দারিদ্র্য দূর করতে পারতো, তাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতো। তাই এখন সময় এসেছে যারা জনসাধারণের বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ অবৈধ উপায়ে আত্মসাৎ করবে তাদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। অর্থ ঋণ আদালত  ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে, তারপরও ঋণ আদায় হয় না। বর্তমানে দেশের ব্যাংকসমূহের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০,০০০ কোটি টাকায়। অর্থ ঋণ আদালতের  ব্যর্থতার  কারণেই অর্থ কেলেঙ্কারির  অপরাধীদের জন্য আরও ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা প্রয়োজন। যে সরকারই ক্ষমতায়  অধিষ্ঠিত থাকুক, আইনের শাসন ছাড়া অর্থ কেলেঙ্কারি,  দুর্নীতি, সন্ত্রাস, খুন-খারাবি দমন করা সম্ভব হবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় ত্বরান্বিত বিচার দ্বারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও  বিচার বিভাগের হাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ দু’টি বিভাগই মানুষের সুখ-শান্তি, জান-মালের নিরাপত্তা, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি ইত্যাদি অর্থাৎ সত্যিকারের সুশাসন দিতে পারে। মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যেন সুশাসন পেতে পারি সে কামনায় সরকারের কাছে নিবেদন থাকবে অর্থ কেলেঙ্কারি সহ সমস্ত  অপরাধের বিচার পদ্ধতি আরও ত্বরান্বিত করুন, তাহলে অপরাধ নির্মূল না হোক, অন্তত নিয়ন্ত্রিত হবে।
০৯-১০-২০১৪

No comments

Powered by Blogger.