পিলখানা ট্র্যাজেডি- আর হারাতে চাই না! by মো. ইমামুল হক

বাংলাদেশের ইতিহাস কখনোই ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় ঘটে যাওয়া বিডিআর বিদ্রোহ নামের সেই ভয়াবহ ঘটনাটির কথাটি ভুলতে পারবে না, যেখানে দেশমাতৃকার সেবায় অর্পিত দায়িত্ব পালনকালে প্রাণ দিতে হয়েছিল ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে।

একটি ঘটনায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে এত অধিকসংখ্যক উচ্চ প্রশিক্ষিত মেধাবী সেনা কর্মকর্তার হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর একটিও নেই। আইন তার নিজের গতিতেই চলেছে। আদালত অভিযুক্ত ৮০০ জনের মধ্যে ১৫০ জনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। যদিও এই বিচার অনেক শহীদ পরিবারকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, সেই বীভৎস ঘটনার প্রকৃত কারণ
এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি। তবু এই বিচার হয়তো বা কিছু শহীদ পরিবারের সদস্যদের মনের কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা হিসেবে কাজ করবে।
এর পরও যাঁরা একসঙ্গে এত বিশালসংখ্যক দক্ষ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার হত্যার বিষয়টি কোনোভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারেন না, তাঁদের সবার কাছে সব সময় একটা বড় প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, কেন এই ঘটনা ঘটল? তাঁরা নেপথ্যের কারণগুলো জানতে চান। আদালতের রায় ঘোষণার পরও সেই সব প্রশ্ন থেমে থাকেনি। এই বিদ্রোহের অনেক কিছুই দেশবাসীর কাছে অজানা। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই এর প্রকৃত কারণ এবং নেপথ্য ব্যক্তিদের সত্যের আলোয় আনতে হবে। আমাদের আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে সামাজিক নৈতিকতার প্রতি আমাদের বাধ্যবাধকতাও আছে। আমরা যদি আইনের শাসন ও সামাজিক নৈতিকতা থেকে দূরে থাকি, তার মানে হবে আমরা আমাদের মাতৃভূমির নিরাপত্তাকেই বিপন্ন করছি।
এত বড় একটি বিদ্রোহ কি কেবল বিডিআরের কয়েকজন ডিএডি সমমানের কর্মকর্তার পরিকল্পনা হতে পারে? তাঁরা কি বাইরের কোনো শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হননি? সরকারকে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে এবং সেগুলোকে গ্রহণযোগ্য উপায়ে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে হবে।
চলে যাওয়ার সময় আমাদের শহীদ ভাইয়েরা আমাদের বিহ্বল মানসিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করে গেছেন। সময়মতো তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় কাজটুকু আমরা করতে পারিনি। জীবদ্দশায় নানা উপলক্ষে দেশে-বিদেশে তাঁরা আমাদের দেশকে গর্বিত করে গেছেন, তাঁরা তাঁদের বিক্রম দেখিয়েছেন, মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন, সহকর্মীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের প্রয়োজনের সময় আমরা তাঁদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। কেন এই দুঃখজনক ঘটনাগুলো ঘটল, কেন আমরা সময়মতো তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারলাম না, সেগুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। ভুল থেকে, দুঃখজনক সেই ঘটনা থেকে আমরা কী শিক্ষাটাই নিতে পেরেছি, সেটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে।
এসব বীর শহীদের অনেক বন্ধু, সহকর্মী এবং পরিবারের সদস্যরা শোক আর ক্ষোভকে সঙ্গে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চান। এ রকম একটি উদ্যোগই গ্রহণ করেছে কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট, যার মূল উদ্দেশ্য হলো কর্নেল মুজিবসহ সব শহীদ ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। ২০০৯ সালে ভয়ানক সেই ঘটনার পরপরই ঘটনার অন্যতম শহীদ কর্নেল মুজিবুল হকের নামে শহীদ কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট গঠিত হয়।
কর্নেল মুজিব ট্রাস্টের পক্ষ থেকে প্রতিবছর ২৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে আমরা যে শান্তিপূর্ণ মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচির আয়োজন করি, তা আমাদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতে, জাতিকে গৌরবোজ্জ্বল করতে ওই শহীদদের জীবন উৎসর্গের প্রতীকী রূপকে উপস্থাপন করে। একটি মোমবাতি নিজেকে পুড়িয়ে আমাদের আলো দেয়, একইভাবে শহীদ ভাইয়েরা আমাদের আলোকিত করার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ওই সব স্বর্গীয় আত্মার স্বপ্ন ছিল সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের, যেখানে আমরা সবাই মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করব।
আমাদের মহান দায়িত্ব আজ তাঁদের সেই স্বপ্ন পূরণে কাজ করা। তাঁদের পরিকল্পনা ও স্বপ্ন পূরণ এবং মূল্যবোধ ধারণে আমাদের অবশ্যই অঙ্গীকার করতে হবে। সেই সঙ্গে তাঁদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, বীরত্ব এবং দায়িত্ববোধ আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায় আমাদের। ২৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ সেনা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট আমাদের শহীদ ভাইদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় কাজটি করতে চায়।
জাতি হিসেবে আমরা এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারি না যে আমরা শুধু এই মূল্যবান জীবনগুলোকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি তা নয়, বরং দেশের জন্য এই বীরদের মূল্যবান অবদানকে যথাযথ স্বীকৃতি দিতে পারিনি। যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তাঁরা আত্মত্যাগ করলেন, সেই প্রতিষ্ঠানটিও যেন আজ দ্বিধান্বিত, নয়তো কেন আজও ২৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে পালিত হয় না। এই জাতির ইতিহাস আত্মত্যাগের ইতিহাস। এ জাতি জানে কীভাবে শহীদদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হয়। আজ শহীদ সেনা দিবসের পঞ্চম বার্ষিকী পালন কালে আসুন আমরা যথোপযুক্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে আমাদের বীরদের স্মরণ করি।


মো. ইমামুল হক: জাতিসংঘের একজন সাবেক কর্মকর্তা ও শহীদ কর্নেল মুজিবুল হকের ভাই
Emamul.haque@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.