মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর-বিদেশিদের সম্মাননার শুভ উদ্যোগ
ইংরেজিতে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে, 'বেটার লেট দ্যান নেভার'_ একেবারে না হওয়ার চাইতে দেরিতে হওয়া ভালো। বিদেশি হয়েও ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে যারা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে ছিলেন তাদের সম্মান জানানোর একটি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
স্বাধীনতার ৪০তম বছরে এই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এ সম্মাননা জানানো হবে। এক কথায় এ উদ্যোগটি শুভ। তবে অনেকেই বলবেন, আরও আগে এমন একটি উদ্যোগ গৃহীত হলে ভালো হতো। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু তথা বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুদের চিনতে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে চেনাতে আগে এমন উদ্যোগ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু এবারই প্রথম রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সম্মাননার ঘটনা ঘটছে। দেরিতে হলেও এটি শুভ উদ্যোগ। একথা সত্য, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে। এ দেশের আপামর মানুষের অন্তরে যে মুক্তির গান অনুরণিত হয়েছিল তাই তাদের হাতের মুঠোয় একটি স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছিল। কিন্তু এ কথাও সত্য, সেদিন মুক্তির যে আস্বাদ আমরা পেয়েছিলাম_ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সে যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হতে পারত, আরও রক্তক্ষয়ী, নির্মম ও সুদূরপ্রসারী হতে পারত। আমাদের কষ্ট আরও মারাত্মক হতে পারত। যে সময় আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম সে সময়ে পৃথিবী ছিল ঠাণ্ডা যুদ্ধের আবহে বিভক্ত। পৃথিবীর বৃহৎ জাতিগুলোর মধ্যে বিভক্তি যেমন ছিল, তেমনি ছিল প্রভাব বিস্তারের নানা সর্বনাশা আয়োজনও। সেদিন প্রতিবেশী ভারত যদি আমাদের পাশে না দাঁড়াত, শরণার্থীদের আশ্রয় না দিত, আমাদের প্রবাসী সরকারকে আশ্রয় না দিত, আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য না করত, তবে আমাদের সংগ্রাম অনেক কষ্টসাধ্য হতো। আবার ভারতের পক্ষে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন দান সহজ হতো না, যদি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এর প্রভাব বলয়ের দেশগুলো ভারত এবং বাংলাদেশের পক্ষে না দাঁড়াত। স্নায়ুযুদ্ধের সেই নির্মম সময়ে যখন দেশে দেশে গোপন ও প্রকাশ্য সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চলছিল, তখন এখানেও তেমন আগ্রাসন ও হস্তক্ষেপের আশঙ্কা ছিল। তেমন হস্তক্ষেপ ঘটলে যুদ্ধ সম্প্রসারিত হতে পারত, আরও বেশি রক্তাক্তও হয়ে উঠত। যুদ্ধ যে সেদিকে যায়নি তার পেছনে সোভিয়েত আশীর্বাদ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, যেসব দেশের সরকার আমাদের মুক্তির বিরোধিতা করেছিল সেসব দেশের মুক্তিকামী মানুষ আমাদের সমর্থন জানিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানকার সাংবাদিক, রাজনীতিক, শিল্পীরা বাংলাদেশের পক্ষে দঁাঁড়িয়েছিলেন শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। তাদের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করা দরকার। তেমনি স্মরণ করা দরকার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, কূটনীতিক ও সাধারণ মানুষকেও। এবার তেমন একটি অবকাশ দেশবাসী পেতে যাচ্ছে। এটি আগে হতে পারত। স্বাধীনতার প্রথম দশকেই যদি এমন উদ্যোগ আসত, তবে দেশের নতুন প্রজন্ম স্পষ্টভাবে বুঝত কারা আমাদের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে ছিল। অগ্রগতির পথ অনেক স্পষ্ট হতো। সেটি হতে পারেনি। শুধু বিদেশিদের অবদানের স্বীকৃতিই যে মেলেনি বহুকাল তা নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তর্কাতীত নেতাদের অবদানকেও খাটো করা হয়েছে। আমরা মনে করি, সে যুগের অন্ত ঘটেছে আজ। উদাত্ত চিত্তে যার যতটুকু অবদান তা সগর্বে উচ্চারণ করে প্রাপ্য সম্মান বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আজ আমরা প্রস্তুত। অপরকে সম্মান জানাবার এই উদ্যোগ আমাদের সামনে চলার পথকে মহিমান্বিক করুক, সেটিই আজকের কামনা।
No comments