বেপরোয়া মোটরসাইকেল-গতি চাই, নিরাপত্তা তারও আগে
নগরীর রাজপথে কিংবা মফস্বলের রাস্তায় ক্রমবর্ধমান 'ছোট যান' এবং এর 'বড় ঝুঁকি' নিয়ে সোমবার সমকালের যে বিশেষ আয়োজনে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের নিত্য অভিজ্ঞতা।
যানজট, গণপরিবহনের অপ্রতুলতা ও রাস্তাঘাটের অবস্থাই বিপুলসংখ্যক নাগরিককে মোটরসাইকেলের মতো সুলভ ও দ্রুতগতিসম্পন্ন যানবাহনের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। ষাট-সত্তর দশকের রোমান্টিকতা এবং আশি-নব্বই দশকের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ছাপিয়ে মোটরসাইকেল এখন জীবনের প্রকট প্রয়োজনীয়তা। বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে সমকাল এর ঝুঁকির দিকটিও নির্দেশ করতে চেয়েছে। বেপরোয়া চালনার কারণে এর চালক যেমন নিজেকে, তেমনই বিপন্ন করে তুলছেন অন্যদেরও। সমকালের প্রতিবেদনেই রয়েছে, ডিসেম্বর মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে রাজধানীসহ সারাদেশে অন্তত ১৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৬ শতাংশই ঘটে এই যানবাহনটির কারণে। এই হার কেবল উদ্বেগজনক নয়, সম্ভবত বিশ্বেও বিরল। এর দায় মূলত চালকের। উল্টো দিকে চলা, নিষিদ্ধ বাঁকে মোড় নেওয়া, বিপজ্জনক গতিসীমা, হেলমেট ব্যবহার না করা, দুইয়ের অধিক আরোহী_ এই দৃশ্য আমাদের রাজপথে হামেশাই চোখে পড়ে। এমনকি ফুটপাতও নিরাপদ নয়। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পথচারীকে আতঙ্কিত করে মোটরসাইকেল চলতে দেখি আমরা। মোটরসাইকেলের বেপরোয়া চলাচল বন্ধ করতেই হবে। লেন, গতিসীমা, আরোহীসংখ্যা মেনে চললেই দুর্ঘটনার হার অনেক কমে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। একই সঙ্গে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া জোরদার করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। 'অন টেস্ট' লিখে বছরের পর বছর পাড়ি দেওয়ার নজির আর আমরা দেখতে চাই না। নিবন্ধন নিশ্চিত করা গেলে মোটরসাইকেল ব্যবহার করে ছিনতাই এবং চোরাই বাজার নিয়ন্ত্রণে আসতে বাধ্য। দুর্ঘটনার একটি কারণ অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অদক্ষ চালক। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার বিষয়টিও মোটরযান অধ্যাদেশ পরিপালিত হলে নিয়মের মধ্যে আসবে। কমবে রাজনৈতিক শোভাযাত্রায় কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে মোটরসাইকেলের যথেচ্ছ ব্যবহার। আশার কথা হচ্ছে, ক্রেতার কাছে মোটরসাইকেল পেঁৗছার আগেই নিবন্ধন নিশ্চিত করতে বিক্রয়কারী এজেন্ট বা ডিলারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে বিআরটিএ। এটি কতটা কার্যকর হয়, নজর রাখা জরুরি। মনে রাখতে হবে, মোটরসাইকেল নিবন্ধনের হার বাড়লে নিরাপত্তার পাশাপাশি রাজস্ব আয়ও বাড়বে। মোটরসাইকেল নিয়ে জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ে নৈরাজ্য আরও প্রকট। সমকালের বিশেষ আয়োজনে এর খণ্ডচিত্র প্রকাশ পেয়েছে। আমরা আশা করি, এই আয়োজন নীতিনির্ধারকদের চিন্তা ও তৎপরতার খোরাক জোগাবে। এটা ঠিক, মোটরসাইকেল চালনা নিয়মের মধ্যে আনতে কর্তৃপক্ষের তৎপরতা গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে খোদ চালকদের সচেতনতা, ট্রাফিক আইন জানা আর মানাও জরুরি। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পাশাপাশি পরিবহন, নগর উন্নয়ন ও সড়ক দুর্ঘটনা ক্ষেত্রে কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে আসতে পারে। স্বল্প দূরত্বে হাঁটার মানসিকতাও কিন্তু মোটরসাইকেলের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। অস্বীকার করা যাবে না যে এই যানবাহনটির সম্প্রসারণে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে। কেবল নির্মাণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে নয়, গ্রামীণ অনেক জনপদে 'ভাড়া মোটরসাইকেল' এখন বেকার তরুণদের জীবিকার উপকরণ। তবে নিরাপত্তা সবচেয়ে বড় বিবেচনা হওয়া উচিত। জীবনে জীবিকা কিংবা গতির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু নিরাপত্তা চাই সবার আগে।
No comments