পদোন্নতি বাগিয়ে নিতে সুযোগসন্ধানীরা তৎপর প্রশাসনে by তপন বিশ্বাস

সরকারের মেয়াদের শেষদিকে পদোন্নতি বাগিয়ে নেয়া, ভাল পোস্টিং নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেয়া, সুযোগ সন্ধানীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন প্রকার কর্মকা- নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।


বঞ্চিতরাও পদোন্নতি পেতে অস্থির হয়ে উঠেছে। ওএসডি থাকা আমলারা পোস্টিং পেতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছে জনপ্রশাসনে। এছাড়া আইজিপিকে সচিবের চেয়ে উচ্চ মর্যাদা প্রদান, পুলিশের আরও চার কর্মকর্তাকে সচিবের মর্যাদা প্রদানের উদ্যোগসহ নানা কারণেও ক্ষোভ বাড়ছে প্রশাসনে।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে হতাশ হয়ে পড়েছেন। যোগ্যতা থাকার পরও এঁদের অনেকে পদোন্নতি বঞ্চিত রয়েছেন। বঞ্চিতদের কেউ কেউ আবার নিজেকে সরকারপন্থী বলেও দাবি করেন। কিন্তু পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ায় তাঁরা সরকারের ওপর চরমভাবে নাখোশ। তাদের অনেকে বলেন, জামায়াত-বিএনপিপন্থী কর্মকর্তারা রীতিমতো পদোন্নতি পাচ্ছেন, এমনকি তাঁরা অনেকেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগও পাচ্ছেন।
মহাজোট সরকার সাড়ে তিন বছর পার করলেও এর মধ্যে কোন কোন কর্মকর্তা দু’দফা পদোন্নতি পেয়েছেন। আবার অনেকে পেয়েছেন একদফা পদোন্নতি। এঁরা সকলে চান সরকারের শেষদিকে অন্তত আরও একটি পদোন্নতি বাগিয়ে নিতে। এ লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের অধিকাংশ আলোচনায় এ বিষয়টি প্রাধান্য পায়। তারা সব সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দিকে নজর ও খোঁজখবর রাখেন। শেষদিকে সুযোগ সন্ধানী কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের শেষ সময় তাঁরা বিভিন্ন সুযোগসুবিধা হাতিয়ে নিতে এই চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। আবার সৎ, যোগ্য ও দক্ষ কিছু কর্মকর্তা যে একেবারেই বে-মানান হয়ে পড়েছেন এ যুগে এসে। যথাযথভাবে কাজ করে গেলেও তাঁরা বরাবরই সরকারের নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। যোগ্য ও দক্ষতার অহঙ্কারে কারও কাছে কোন লবিং বা তদ্বির না করায় তারা সব সময় থেকে যাচ্ছেন আড়ালে।
ওএসডি থাকা শতাধিক কর্মকর্তা পদায়নের জন্য ইতোমধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। মহাজোট সরকারের শুরুতে রাজনৈতির রং মিশিয়ে কিছু যোগ্য কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তি আক্রশের শিকারও হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জাতীয় কোন কোন কর্মকর্তাকেও সচিবালয়ে বেশি পরিমাণ ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। আবার সরকারবিরোধী মনোভাবাপন্ন কর্মকর্তাদের আনাগোনাও বেড়ে গেছে। সম্প্রতি তাদের সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে।
পুলিশের মর্যাদা বৃদ্ধিতে সিভিল প্রশাসনে ব্যাপক ক্ষোভ পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইতোপূর্বে আইজিপিকে সিনিয়র সচিবের মর্যাদা দিয়ে তাদের সচিবের ওপরে উঠানো হয়েছে। এতে পুলিশ প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসনের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। আর এই দূরত্বের কারণে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইজিপিকে সিনিয়র সচিবের সমান মর্যাদা দানের পর কথা উঠেছিল তিনি স্বরাষ্ট্র সচিবেরও ওপরে। পরে অবশ্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিবকে সরিয়ে একজন সিনিয়র সচিবকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু এই সিনিয়র সচিব মন্ত্রণালয়ে যোগদান করার পর পুলিশ প্রশাসন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে স্বাগত জানানো হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে পুলিশের আরও চার কর্মকর্তাকে সচিবের মর্যাদা প্রদানের কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে সাবেক এক আইজিপিকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পদায়ন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে রয়েছে পুলিশের অপর এক কর্মকর্তা। এ নিয়েও ক্ষোভ বাড়ছে সিভিল প্রশাসনে। তারা বলছেন, পুলিশের মর্যাদা বাড়িয়ে কাউকে সচিবের সমান আবার কাউকে সচিবের ওপরে নেয়ার খেসারত দেশবাসীকে দিতে হবে। এতে মূলত দেশেরই ক্ষতি হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কেউ থাকছে না। তাদের কোন জবাবদিহিতাও থাকছে না। কর্মকর্তারা বলেন, মন্ত্রণালয়ের কাজ নীতি-নির্ধারণী এবং কেবিনেটকে সহায়তা করা। আর পুলিশ মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ একটি বিভাগ। তারা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত নীতি বাস্তবায়ন করবে পুলিশ-আনসার ভিডিপি-বিজিপি। কিন্তু পুলিশের শীর্ষ পদ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদের সমান বা তার ওপরে স্থান দিলে তারা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। তাদের মতে, সরকারের এই নীতিতে কোন অবস্থায় প্রশাসনকে গতিশীল করা যাবে না। এতে আরও স্থবির হয়ে উঠবে প্রশাসন। এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের ক্ষমতা বাড়ানোর কারণে এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তারা পাত্তা দেয় না। এ কারণে রামুর ঘটনার পর ড. কামাল হোসেন বলেন, পুলিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা শুনছে না।
প্রশাসনের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশকে এত ক্ষমতা দেয়ার নজির কোথাও নেই। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কসহ সকল দেশেই পুলিশকে সিভিল প্রশাসনের আওতায় রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, অতীতে আমাদের দেশে পুলিশকে সিভিল প্রশাসনের অধীনে রাখায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। তিনি বলেন, পুলিশের মর্যাদা না বাড়িয়ে তাদের ঝুঁকিভাতা বাড়ানো যেতে পারে। অবশ্য সরকার তাদের রেশন, মোবাইল, গাড়িসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছে।
অভিযোগ উঠেছে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি প্রশাসনের চার সচিবের দফতর বদল করা হয়েছে। পুলিশের ডিআইজি পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে ২০ কর্মকর্তাকে। এতে যাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন তাঁদেরও ক্ষোভ বাড়ছে। পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চিতরা রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে।
অস্থিরতা রোধে মন্ত্রীদের যে পরিমাণ দক্ষতা, কমিটমেন্ট ও আন্তরিকতা থাকা দরকার তা না থাকায় বেশিরভাগ মন্ত্রণালয় চলছে আমলাদের ইচ্ছামাফিক। মন্ত্রণালয়গুলো ক্রমান্বয়ে মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। সুযোগ সন্ধানী আমলারা মন্ত্রীদের কম গুরুত্বপূর্ণ সভা-সেমিনারের মাধ্যমে অহেতুক ব্যস্ত রেখে সুযোগমতো বিভিন্ন সুবিধা হাসিল করছেন।
কেবল প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া সচিবালয়ে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী কাজ যথাযথভাবে এগোচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা এই সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে অনেকটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
মহাজোট সরকার দায়িত্বগ্রহণের পর এ পর্যন্ত ১৫ দফা পদোন্নতি দিয়েছে। এতে মোট ১ হাজার ৯শ’ ১৬ কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে এতে প্রায় এক হাজারের মতো কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা পদোন্নতি পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ইতোপূর্বে পদোন্নতিপ্রাপ্তরা চাচ্ছেন সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে অন্তত আরও একটি পদোন্নতি বাগিয়ে নিতে। এ নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ক্রমান্বয়ে অস্থির হয়ে উঠছেন।

No comments

Powered by Blogger.