আখের বিকল্প হতে পারে সুগারবিট

কিছু কিছু পণ্য আছে যেগুলোর দাম বাড়লে মানুষের চিন্তার শেষ থাকে না। এই রকম একটি পণ্যদ্রব্য হচ্ছে চিনি। আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় চিনি অপরিহার্য উপাদান। মস্তিষ্কের যথাযথ বিকাশ ও পূর্ণ কার্যকারিতার জন্য চিনি একটি আবশ্যকীয় উপাদান।


মাত্রাতিরিক্ত চিনি খাওয়া যেমন শরীরের নান রোগ সৃষ্টির কারণ তেমনি চিনি কম খেলে নানা রোগ সৃষ্টি হয়। চিনি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বুদ্ধি বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষের বছরে কমপক্ষে ১৩ কেজি চিনি বা গুড় গ্রহণ করা উচিত। সেক্ষেত্রে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বছরে কমপক্ষে ২০ লাখ ৮০ হাজার টন চিনি বা গুড় প্রয়োজন। সার্কভুক্ত দেশ পাকিস্তানে বছরে জনপ্রতি চিনিভোগের পরিমাণ ২৩ ও ভারতে ১৯ কেজি। তারা তাদের চিনির এই বিশাল চাহিদা পূরণ করতে সমর্থ হলেও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আমরা আমাদের চিনির চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। বাংলাদেশের মানুষের চিনির বিশাল চাহিদা পূরণ ও মান নিশ্চিতকরণের জন্য আছে অনেকগুলো চিনি প্রস্তুতকারী কারখানা, চিনি গবেষণাকেন্দ্রসহ সংশ্লিষ্ট নানামুখী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু নানামুখী সমস্যার কারণে প্রতিবছরেই আমাদেরকে প্রচুর পরিমাণ চিনি আমদানি করতে হয়। যার ফলে ব্যয় হয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশে বর্তমানে চালু ১৫টি চিনিকলের বার্ষিক চিনি উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার ৪৪ টন। ২০১১-১২ মাড়াই মৌসুমে চিনি উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার ৩০৮ টন। চিনিকলগুলো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চিনি উৎপাদন করতে পারছে না মূলত আখের ওপর অধিক নির্ভরশীলতার কারণে।
আখ, সুগারবিট, তাল, খেজুর এবং গোলপাতা গাছের রস থেকে সব ধরনের চিনি ও গুড় উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত চিনির বেশিরভাগই আসে আখ থেকে। সুগারবিট, তাল, খেজুর ও গোলপাতা গাছের রস থেকেও সামান্য পরিমাণ চিনি ও গুড় উৎপাদন হয়। একসময় আমাদের দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে প্রচুর আখের চাষ হলেও বর্তমানে আখ চাষের পরিমাণ ক্রমাগত কম হচ্ছে। আখের জমিতে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের ফলে চিনিকল এলাকায় আখের চাষ কমে যাচ্ছে ক্রমেই। তাছাড়া আখ চাষে যে সময় লাগে সেই একই সময়ে একই জমি থেকে ধান, আলু ও ভুট্টার মতো তিনটি ফসলের চাষ করে আখের চেয়ে বেশি আয় করা যায়। এই কারণে চাষীরাও নিরুৎসাহিত হচ্ছে। যেখানে আগে মিল জোন এলাকায় প্রায় ২ দশমিক ৫ লাখ একর জমিতে আখের চাষ হতো সেখানে বিগত তিন বছর ধরে তা ১ দশমিক ৭ লাখ একরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। চিনিকলবহির্ভূত এলাকায়ও একইভাবে কমছে আখের জমি। তাছাড়া গুড় চাষীরা কৃষকদের থেকে বেশি দামে আখ ক্রয় করে নিয়ে যায়, ফলে চিনিকলগুলোতে দেখা যায় আখের সঙ্কট এবং এর ফলশ্রুতিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এবং চিনিকলকে বাঁচিয়ে রাখতে আখের বিকল্প সুগারবিটের চাষ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
সুগারবিট মূলত শীতপ্রধান অঞ্চলের ফসল হলেও এখন সময়ের প্রয়োজনে উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেও এর চাষ হচ্ছে। পাকিস্তানে সুগারবিট থেকে চিনি উৎপাদন হচ্ছে। ভারতে গ্রীষ্মকালীন সুগারবিট চাষাবাদ শুরু হয় ২০০৭ সালে। দেশটির মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুতে সুগারবিট আবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে। এই অঞ্চলগুলোর প্রায় ১২ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের জমিতে সুগারবিটের চাষ হচ্ছে। মিসর, সুদানসহ প্রভৃতি আফ্রিকান দেশেও সুগারবিট চাষ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট গ্রীষ্মকালীন সুগারবিট নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করছে। ২০১০-১১ রোপণ মৌসুমে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা খামার ঈশ্বরদী ছাড়াও আঞ্চলিক ইক্ষু গবেষণা খামার, ঠাকুরগাঁও ও কেরু এ্যান্ড কোং দর্শনা, চুয়াডাঙ্গায় সুগারবিট চাষের জন্য গবেষণা প্লট স্থাপন করা হয়। প্রত্যেক স্থানে স্থাপিত গবেষণা প্লটেই সুগারবিটের আশাতীত ফলন পাওয়া গেছে। সরকার সুগারবিট থেকে চিনি উৎপাদনের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প অনুমোদন করেছে। ওই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১১-১২ রোপণ মৌসুমে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের ১২টি চিনিকলের পরীক্ষামূলক খামারসহ ১৭টি বিভিন্ন এলাকায় গ্রীষ্মকালীন সুগারবিটের ওপর গবেষণা প্লট স্থাপন করেছে। সবগুলোতেই ফলন অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
আলু, গাজর ও মুলার মতো সুগারবিট একটি মূলজাতীয় ফসল। এ ফসল সহজেই উৎপাদন করা যায়। যদি চিনিকলগুলো সুগারবিট ন্যায্য মূল্যে কেনে, তাহলে কৃষকরা সুগারবিট উৎপাদন করতে আগ্রহী। যেহেতু সুগারবিটের বীজের দাম বেশি, তাই প্রথম অবস্থায় সরকার সুগারবিটের বীজের ওপর চাষীদের ভর্তুকি দিয়ে চাষে প্রেরণা যোগাতে পারে। সুগারবিট চাষের সুবিধাগুলো হলো চাষাবাদে সময় কম লাগে, ফলন বেশি, উৎপাদন কলাকৌশল সহজ, আমাদের দেশের মাটি ও জলবায়ু সুগারবিট চাষের জন্য উপযোগী, আখের চেয়ে সুগারবিটের চিনি আহরণ হার বেশি ও সুগারবিটের পাল্প পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। চিনি ছাড়াও সুগারবিট থেকে বায়োফুয়েল, চকলেট ও সিরাপ উৎপাদন করা সম্ভব। আমাদের বিদ্যমান চিনিকলে কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংযোজন করে আখ থেকে চিনি উৎপাদন শেষে সুগারবিট থেকেও চিনি উৎপাদন করা সম্ভব ফলে এর জন্য আলাদা কোন মিল দেয়ার প্রয়োজন পড়বে না। এতসব সুবিধার কারণে আশা করা যাচ্ছে দেশে সুগারবিটের চাষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। আখের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে চিনিকলগুলোতে সুগারবিটের উপর গুরুত্ব দেয়া হবে।
সুগারবিট একটি সম্ভাবনাময় ফসল। বর্তমানে অনেক দেশে সুগারবিটের ওপর নানারকম গবেষণা চলছে। উত্তরোত্তর এর উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও এই সুগারবিট নিয়ে কৃষিবিদ ও গবেষকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে এবং তারা সবাই সুগারবিট যে আখের বিকল্প হিসেবে চিনি শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে এই ব্যাপারে আশাবাদী। চিনিকল এলাকায় সুগারবিট সাফল্যজনকভাবে আবাদ করা সম্ভব। সুগারবিট একটি লবণাক্ততা সহনশীল ফসল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে ধান, গম ও শাকসবজিসহ সব ফসলের ফলন ব্যাপকভাবে কমছে। তাই উপকূল অঞ্চলের বিশ লাখ হেক্টর জমির একটা বিরাট অংশে এবং দেশের চরাঞ্চলের দুই লাখ হেক্টর জমিতে সুগারবিট চাষ করা গেলে ওই সব এলাকার চাষীরাও লাভবান হবেন এবং দেশের চিনি-গুড়ের চাহিদাও অনেকটা পূরণ করা সম্ভব হবে। সুগারবিটের ওপর ভিত্তি করে দেশে অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে চকলেট ও ওষুধ কারখানা। আমাদের দেশের মাটি সুগুারবিট চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী । তাই চাষীদের যদি সুগারবিট চাষের জন্য উৎসাহ দেয়া যায় এবং চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া যায় তবে তারা এটির চাষে উৎসাহিত হবে। এতে চিনিকলগুলোতে আখের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে যে ভোগান্তির শিকার হতে হয় সেই প্রবণতাও কমে যাবে। আশা করা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে সুগারবিটের মাধ্যেমেই আমরা আমাদের চিনির উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হব যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে সাশ্রয় ঘটাবে। তাই সরকারকে সুগারবিট চাষ ব্যাপক আকারে শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা, কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

মোঃ আরিফুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.