একুশ শতক- আইসিটি নীতিমালা নাকি ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা by মোস্তাফা জব্বার
॥ দুই ॥ আমার ধারণার নীতিমালা : শুরুটা শিরোনাম থেকে হতে পারে। আমি মনে করি, এখন এই নীতিমালাটির নাম তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা নয়, হওয়া উচিত ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা। যেহেতু এটি ২০১২ সালে প্রণীত হচ্ছে, সেহেতু এর সালটাও শিরোনামে থাকা উচিত।
ফলে নীতিমালার প্রথম সংশোধনী হতে হবে এ রকম :
শিরোনাম : এই নীতিমালাটির শিরোনাম হওয়া উচিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা ২০১২।’
এর পরপরই নীতিমালার প্রস্তাবনার বিষয়টি আসবে। এই অংশটি যেভাবে ২০০৯ সালের নীতিমালায় লেখা হয়েছে সেটি আমূল বদলে ফেলতে হবে। সেটি হতে পারে এ রকম :
ক. প্রস্তাবনা : ২৬ মার্চ ১৯৭১ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার অনুপ্রেরণায় বাঙালী জাতি একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করার লড়াইয়ে জয়ী হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সংবিধানের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির আলোকে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এই রাষ্ট্র হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা। স্বাধীনতার পর থেকেই এই সংগ্রাম অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলছে। এরই মাঝে আমরা স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রম করেছি এবং আমাদের অগ্রগতিও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই সাধারণ অগ্রগতিতে দুনিয়াব্যাপী যে পরিবর্তন হচ্ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করে মানব সভ্যতা যে ডিজিটাল যুগে পা ফেলেছে এবং তার জন্য যে ডিজিটাল রূপান্তর করছে সেই পদ্ধতি এই জাতিকেও অনিবার্যভাবে গ্রহণ করতে হবে। সারা পৃথিবী এক সময়কার কৃষিযুগ ও পরের শিল্পযুগ অতিক্রম করে এখন ডিজিটাল যুগে পা ফেলেছে। দুনিয়ার সেই সংগ্রাম হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানব সভ্যতার ডিজিটাল রূপান্তর করা এবং সেই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি সামিটে বারবার বিশ্ববাসী এই অঙ্গীকার করে যাচ্ছে। আমরাও সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের স্বাক্ষরকারী। সেই হিসেবে আমাদের লড়াই বিশ্ববাসীর সঙ্গে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
সারা বিশ্বের রূপান্তরের অঙ্গীকার ও একটি নতুন সভ্যতার বিষয়কে মাথায় রেখে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তার দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সেই অঙ্গীকারের প্রেক্ষিতে তিনি, তার দল ও জোট দেশের মানুষের বিপুল সমর্থন পেয়ে সরকার গঠন করেন এবং সরকার গঠনের প্রথম দিন থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল সময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আরও একবার সরকার পরিচালনা করেছিলেন তখন এই দেশটির ডিজিটাল রূপান্তরের ব্যাপক প্রয়াস গ্রহণ করেন। তার কয়েকটি মাইলফলক কাজের মধ্যে কম্পিউটার ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার, দেশে প্রোগ্রামারের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা, সফটওয়্যার ও আইসিটি সেবার রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা, মোবাইলের মনোপলি ভাঙ্গা, অনলাইন ইন্টারনেট প্রচলন করা, তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য ৪০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ করা, ইইএফ ফান্ড প্রবর্তন ইত্যাদি রয়েছে। তার সেই সরকার দেশের ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ১০ মে ১৯৯৯ তারিখে জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি গ্রহণ করে। (প্রজ্ঞাপন নং-বিপ্রম/শা-৯/এনসিএসটি-১/৯৯/৯০ তারিখ ১০ মে ১৯৯৯) এরপর সেই সরকার নীতিমালাটির খসড়া প্রস্তুত করে এবং জনগণের মতামত সংগ্রহ করে। ২০০১ সালে সেই সরকারের মেয়াদ শেষ হবার সময় পর্যন্ত নীতিমালাটি চূড়ান্ত করার কার্যক্রম অব্যাহত থাকে, কিন্তু শেষ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সরকার বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি সম্মেলনে যোগ দিয়ে ২০০৬ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার করলেও তেমন কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়নি। তবে তারা তাদের শাসনকালে জনসমর্থনহীন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে যা সেই সময়কালেই অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সেই সরকার নীতিমালাটির কোন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেনি বা সেই নীতিমালার আলোকে কোন কর্মউদ্যোগও গ্রহণ করেনি। এই খাতের সংগঠনগুলো সকলেই সেই নীতিমালাটির পর্যালোচনা ও পরিবর্তনের দাবি তুলে। সেই বিবেচনায় ২০০৮ সালে তৎকালীন সরকার সেই অকার্যকর নীতিমালাটিকে সংশোধন করার জন্য একটি রিভিউ কমিটি গঠন করে (সূত্রবিতযোপ্রম/শাখা-১৩/আইটি-৭/১৯৯৯/অংশ-২/১০৮ তারিখ ৪-৫.২০০৮। গেজেট বিজ্ঞপ্তি; ভলিউম ২৯: জুলাই ১৭, ২০০৮ প্রকাশিত)। সেই কমিটি একটি খসড়া প্রণয়ন করে। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হবার পরপরই সেই খসড়া নীতিমালাটিকে একটি কার্যকর দলিলে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেই নীতিমালায় তৎকালীন প্রেক্ষিত ও প্রবণতার আলোকে অনুসৃত রীতি ও কাঠামোর ভিত্তিতে রূপকল্প, উদ্দেশ্য ও কৌশলগত বিষয় বর্ণনা করে ৩০৬টি কর্মপরিকল্পনাসহ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা মন্ত্রী পরিষদের ৩০ মার্চ ২০০৯-এর সভায় অনুমোদন ও গ্রহণ করা হয়। সূত্র: বিতযোপ্রম/শাখা-১৩/আইটি-৭/৯৯(অংশ-৩)/১২৫ তারিখ ০১ জুন ২০০৯।
সেই নীতিমালার স্বত্বাধিকার, তদারকি ও রিভিউ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “নীতিমালায় বর্ণিত কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন অবস্থা যাচাই, করণীয় বিষয়সমূহের পরিবর্তন এবং অগ্রাধিকার নিরূপণের জন্য প্রতিবছর করণীয বিষয়সমূহ পর্যালোচনা করা হবে।” নীতিমালার এই অংশটির সাথে সঙ্গতি রাখার জন্য সরকার তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০০৯ পর্যালোচনা করার জন্য বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালককে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি গঠন করে। (সূত্র নং ৩৯.০১৩.০২২.০১.০০.০২৭.০০৯-৫৭ তারিখ ০৯ মার্চ ২০১০) সেই কমিটি নিজেরা পর্যালোচনা করা ছাড়াও মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সুশীল সমাজ ও জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করে গ্রহণযোগ্য সুপারিশের আলোকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০০৯-এর ওপর ভিত্তি করে তার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা ২০১২’ নামাকরণ করে এর খসড়া সরকারের কাছে পেশ করে এবং সরকার সেটি গ্রহণ করে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা ২০১২-এর রূপকল্প ও উদ্দেশ্যসমূহের আলোকে এর কৌশলগত বিষয়গুলো অনুসরণ করে প্রণীত কর্মপরিকল্পনাসমূহ সফলভাবে বাস্তবায়ন করার ফলে এই নীতিমালায় উল্লেখিত সময়ের মাঝেই বা তার আগে এই জাতির প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। প্রস্তাবনার পর নীতিমালা প্রণয়নের যৌক্তিক ভিত্তিটি কি, সেটি থাকা উচিত। এটিও পুরোই বদলে ফেলতে হবে। সেই অংশটি হতে হবে এ রকম : ক. ১ ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালার যৌক্তিক ভিত্তি : যেহেতু এই জাতি একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্য-দুর্নীতিহীন, সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছে, সরকার ও প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে এবং বিগত চার দশক যাবত সমগ্র জাতির লড়াই অব্যাহত আছে এবং যেহেতু ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানবসভ্যতার ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করার পাশাপাশি সারা দুনিয়ার মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি স্তরে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, প্রতিটি নাগরিকের কাছে ডিজিটাল প্রযুক্তি পৌঁছানো, এর ব্যবহারে সমান সুযোগ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা তথা পুরো রাষ্ট্রের ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য একটি নীতিমালা প্রণীত হওয়া দরকার সেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা ২০১২ প্রণীত হলো যাতে এর রূপকল্প, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা রয়েছে।
এই নীতিমালা রাষ্ট্রের সব পরিকল্পনাবিদ, নির্বাহী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট সবার জন্য একটি অবশ্য পালনীয় নির্দেশিকা। একই সাথে এটি দেশের সকল নাগরিকের জন্য একটি অবশ্য অনুসরণীয় গাইড লাইন।
নীতিমালার বর্তমান প্রেক্ষাপট ও প্রবণতা অংশটি এমন হতে পারে : ক. ২ বর্তমান প্রেক্ষাপট ও প্রবণতা : ২০০৩ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব তথ্যসমাজ সম্মেলন ও ২০০৫ সালে তিউনিসে অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনের ফলোআপসহ অনেক সম্মেলনে বিশ্বসমাজ একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল রূপান্তরের যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, সারা দুনিয়াতে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ ও উন্নয়ন যেভাবে হচ্ছে এবং তারই ফলশ্রুতিতে দুনিয়ার প্রতিটি দেশে একটি ডিজিটাল লাইফ স্টাইল গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল রূপান্তরের একটি বিপ্লবী ধারার প্রবাহ দেখা যাচ্ছ। বিশ্বের তাবত দেশ ডিজিটাল প্রযুক্তিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্তির জন্য, দুর্নীতি ও বৈষম্য উচ্ছেদের জন্য, সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, দক্ষতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তথা জাতীয় আয় বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার এই লড়াই থেকে বাঙালী জাতি দূরে থাকতে পারে না। বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ এই বিবর্তন ও বিপ্লব থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পরে না। কৃষি যুগের উন্নত এই দেশটি শিল্পায়নের যুগে পিছিয়ে পড়ার ফলে এখন তার সার্বিক অগ্রগতির জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা সবচেয়ে জরুরী একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৬৪ সালে দেশে কম্পিউটার এলেও পরবর্তীতে সঠিকভাবে এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার তার প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল) ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ও ব্যবহরের লক্ষ্যে উদ্যোগ নিয়ে এই প্রযুক্তিকে জাতীয় উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ববহার করা শুরু করে। এবার এই সরকারের ঘোষণা হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। সরকারের বিগত দিনগুলোতে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম ব্যাপকভাবে এগিয়েছে এবং সর্বত্র ডিজিটাল রূপান্তরের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। সেই লক্ষ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
ঢাকা, ১৯ অক্টোবর ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক ॥ ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net
শিরোনাম : এই নীতিমালাটির শিরোনাম হওয়া উচিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা ২০১২।’
এর পরপরই নীতিমালার প্রস্তাবনার বিষয়টি আসবে। এই অংশটি যেভাবে ২০০৯ সালের নীতিমালায় লেখা হয়েছে সেটি আমূল বদলে ফেলতে হবে। সেটি হতে পারে এ রকম :
ক. প্রস্তাবনা : ২৬ মার্চ ১৯৭১ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার অনুপ্রেরণায় বাঙালী জাতি একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করার লড়াইয়ে জয়ী হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সংবিধানের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির আলোকে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এই রাষ্ট্র হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা। স্বাধীনতার পর থেকেই এই সংগ্রাম অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলছে। এরই মাঝে আমরা স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রম করেছি এবং আমাদের অগ্রগতিও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই সাধারণ অগ্রগতিতে দুনিয়াব্যাপী যে পরিবর্তন হচ্ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করে মানব সভ্যতা যে ডিজিটাল যুগে পা ফেলেছে এবং তার জন্য যে ডিজিটাল রূপান্তর করছে সেই পদ্ধতি এই জাতিকেও অনিবার্যভাবে গ্রহণ করতে হবে। সারা পৃথিবী এক সময়কার কৃষিযুগ ও পরের শিল্পযুগ অতিক্রম করে এখন ডিজিটাল যুগে পা ফেলেছে। দুনিয়ার সেই সংগ্রাম হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানব সভ্যতার ডিজিটাল রূপান্তর করা এবং সেই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি সামিটে বারবার বিশ্ববাসী এই অঙ্গীকার করে যাচ্ছে। আমরাও সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের স্বাক্ষরকারী। সেই হিসেবে আমাদের লড়াই বিশ্ববাসীর সঙ্গে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
সারা বিশ্বের রূপান্তরের অঙ্গীকার ও একটি নতুন সভ্যতার বিষয়কে মাথায় রেখে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তার দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সেই অঙ্গীকারের প্রেক্ষিতে তিনি, তার দল ও জোট দেশের মানুষের বিপুল সমর্থন পেয়ে সরকার গঠন করেন এবং সরকার গঠনের প্রথম দিন থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল সময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আরও একবার সরকার পরিচালনা করেছিলেন তখন এই দেশটির ডিজিটাল রূপান্তরের ব্যাপক প্রয়াস গ্রহণ করেন। তার কয়েকটি মাইলফলক কাজের মধ্যে কম্পিউটার ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার, দেশে প্রোগ্রামারের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা, সফটওয়্যার ও আইসিটি সেবার রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা, মোবাইলের মনোপলি ভাঙ্গা, অনলাইন ইন্টারনেট প্রচলন করা, তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য ৪০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ করা, ইইএফ ফান্ড প্রবর্তন ইত্যাদি রয়েছে। তার সেই সরকার দেশের ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ১০ মে ১৯৯৯ তারিখে জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি গ্রহণ করে। (প্রজ্ঞাপন নং-বিপ্রম/শা-৯/এনসিএসটি-১/৯৯/৯০ তারিখ ১০ মে ১৯৯৯) এরপর সেই সরকার নীতিমালাটির খসড়া প্রস্তুত করে এবং জনগণের মতামত সংগ্রহ করে। ২০০১ সালে সেই সরকারের মেয়াদ শেষ হবার সময় পর্যন্ত নীতিমালাটি চূড়ান্ত করার কার্যক্রম অব্যাহত থাকে, কিন্তু শেষ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সরকার বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি সম্মেলনে যোগ দিয়ে ২০০৬ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার করলেও তেমন কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়নি। তবে তারা তাদের শাসনকালে জনসমর্থনহীন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে যা সেই সময়কালেই অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সেই সরকার নীতিমালাটির কোন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেনি বা সেই নীতিমালার আলোকে কোন কর্মউদ্যোগও গ্রহণ করেনি। এই খাতের সংগঠনগুলো সকলেই সেই নীতিমালাটির পর্যালোচনা ও পরিবর্তনের দাবি তুলে। সেই বিবেচনায় ২০০৮ সালে তৎকালীন সরকার সেই অকার্যকর নীতিমালাটিকে সংশোধন করার জন্য একটি রিভিউ কমিটি গঠন করে (সূত্রবিতযোপ্রম/শাখা-১৩/আইটি-৭/১৯৯৯/অংশ-২/১০৮ তারিখ ৪-৫.২০০৮। গেজেট বিজ্ঞপ্তি; ভলিউম ২৯: জুলাই ১৭, ২০০৮ প্রকাশিত)। সেই কমিটি একটি খসড়া প্রণয়ন করে। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হবার পরপরই সেই খসড়া নীতিমালাটিকে একটি কার্যকর দলিলে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেই নীতিমালায় তৎকালীন প্রেক্ষিত ও প্রবণতার আলোকে অনুসৃত রীতি ও কাঠামোর ভিত্তিতে রূপকল্প, উদ্দেশ্য ও কৌশলগত বিষয় বর্ণনা করে ৩০৬টি কর্মপরিকল্পনাসহ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা মন্ত্রী পরিষদের ৩০ মার্চ ২০০৯-এর সভায় অনুমোদন ও গ্রহণ করা হয়। সূত্র: বিতযোপ্রম/শাখা-১৩/আইটি-৭/৯৯(অংশ-৩)/১২৫ তারিখ ০১ জুন ২০০৯।
সেই নীতিমালার স্বত্বাধিকার, তদারকি ও রিভিউ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “নীতিমালায় বর্ণিত কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন অবস্থা যাচাই, করণীয় বিষয়সমূহের পরিবর্তন এবং অগ্রাধিকার নিরূপণের জন্য প্রতিবছর করণীয বিষয়সমূহ পর্যালোচনা করা হবে।” নীতিমালার এই অংশটির সাথে সঙ্গতি রাখার জন্য সরকার তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০০৯ পর্যালোচনা করার জন্য বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালককে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি গঠন করে। (সূত্র নং ৩৯.০১৩.০২২.০১.০০.০২৭.০০৯-৫৭ তারিখ ০৯ মার্চ ২০১০) সেই কমিটি নিজেরা পর্যালোচনা করা ছাড়াও মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সুশীল সমাজ ও জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করে গ্রহণযোগ্য সুপারিশের আলোকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০০৯-এর ওপর ভিত্তি করে তার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা ২০১২’ নামাকরণ করে এর খসড়া সরকারের কাছে পেশ করে এবং সরকার সেটি গ্রহণ করে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা ২০১২-এর রূপকল্প ও উদ্দেশ্যসমূহের আলোকে এর কৌশলগত বিষয়গুলো অনুসরণ করে প্রণীত কর্মপরিকল্পনাসমূহ সফলভাবে বাস্তবায়ন করার ফলে এই নীতিমালায় উল্লেখিত সময়ের মাঝেই বা তার আগে এই জাতির প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। প্রস্তাবনার পর নীতিমালা প্রণয়নের যৌক্তিক ভিত্তিটি কি, সেটি থাকা উচিত। এটিও পুরোই বদলে ফেলতে হবে। সেই অংশটি হতে হবে এ রকম : ক. ১ ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালার যৌক্তিক ভিত্তি : যেহেতু এই জাতি একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্য-দুর্নীতিহীন, সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছে, সরকার ও প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে এবং বিগত চার দশক যাবত সমগ্র জাতির লড়াই অব্যাহত আছে এবং যেহেতু ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানবসভ্যতার ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করার পাশাপাশি সারা দুনিয়ার মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি স্তরে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, প্রতিটি নাগরিকের কাছে ডিজিটাল প্রযুক্তি পৌঁছানো, এর ব্যবহারে সমান সুযোগ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা তথা পুরো রাষ্ট্রের ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য একটি নীতিমালা প্রণীত হওয়া দরকার সেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা ২০১২ প্রণীত হলো যাতে এর রূপকল্প, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা রয়েছে।
এই নীতিমালা রাষ্ট্রের সব পরিকল্পনাবিদ, নির্বাহী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট সবার জন্য একটি অবশ্য পালনীয় নির্দেশিকা। একই সাথে এটি দেশের সকল নাগরিকের জন্য একটি অবশ্য অনুসরণীয় গাইড লাইন।
নীতিমালার বর্তমান প্রেক্ষাপট ও প্রবণতা অংশটি এমন হতে পারে : ক. ২ বর্তমান প্রেক্ষাপট ও প্রবণতা : ২০০৩ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব তথ্যসমাজ সম্মেলন ও ২০০৫ সালে তিউনিসে অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনের ফলোআপসহ অনেক সম্মেলনে বিশ্বসমাজ একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল রূপান্তরের যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, সারা দুনিয়াতে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ ও উন্নয়ন যেভাবে হচ্ছে এবং তারই ফলশ্রুতিতে দুনিয়ার প্রতিটি দেশে একটি ডিজিটাল লাইফ স্টাইল গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল রূপান্তরের একটি বিপ্লবী ধারার প্রবাহ দেখা যাচ্ছ। বিশ্বের তাবত দেশ ডিজিটাল প্রযুক্তিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্তির জন্য, দুর্নীতি ও বৈষম্য উচ্ছেদের জন্য, সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, দক্ষতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তথা জাতীয় আয় বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার এই লড়াই থেকে বাঙালী জাতি দূরে থাকতে পারে না। বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ এই বিবর্তন ও বিপ্লব থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পরে না। কৃষি যুগের উন্নত এই দেশটি শিল্পায়নের যুগে পিছিয়ে পড়ার ফলে এখন তার সার্বিক অগ্রগতির জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা সবচেয়ে জরুরী একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৬৪ সালে দেশে কম্পিউটার এলেও পরবর্তীতে সঠিকভাবে এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার তার প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল) ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ও ব্যবহরের লক্ষ্যে উদ্যোগ নিয়ে এই প্রযুক্তিকে জাতীয় উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ববহার করা শুরু করে। এবার এই সরকারের ঘোষণা হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। সরকারের বিগত দিনগুলোতে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম ব্যাপকভাবে এগিয়েছে এবং সর্বত্র ডিজিটাল রূপান্তরের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। সেই লক্ষ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
ঢাকা, ১৯ অক্টোবর ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক ॥ ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net
No comments