জয় বাংলা স্লোগানে মঞ্চ মাতালেন জোয়ান ডাইন

“বাংলাদেশ চিরদিন আমাদের হৃদয়ে ছিল, থাকবে। আমাদের নিজেদের এই ভূ-খ-ের অংশ মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে আমরা যে যার পক্ষ থেকে ভূমিকা রেখেছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন


পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিলেও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বাংলাদেশের জনগণকেই সমর্থন দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য তাঁর স্বামী স্টেট ডিপার্টমেন্টের চাকরির চুক্তির মেয়াদ আর বৃদ্ধি করেননি। আশাকরি মানবতাকে আর সে সময়ের মতো অমানবিক কর্মকা- দেখতে হবে না।” স্বাধীনতার ৪১ বছর পর হলেও মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শনিবার বর্ণিল আয়োজনে এমন বিরল ও বীরত্বপূর্ণ সম্মাননা প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে আবেগাপ্লুত মার্কিন রাজনীতিবিদ ও সমাজ সেবক জোয়ান ডাইন এসব কথা বলেন। বাংলাদেশের শুভ কামনা করে মুক্তিযুদ্ধকালীন রণাঙ্গনের রণধ্বনী ‘জয় বাংলা’ বলে জোয়ান তাঁর বক্তব্য শেষ করার মুহূর্তে পুরো অনুষ্ঠানস্থলের পরিবেশই পাল্টে যায়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীও মঞ্চে দাঁড়িয়ে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ‘জয় বাংলা’ সেগান দেন। সঙ্গে সঙ্গে মিলনায়তনে উপস্থিত সবাই ‘জয় বাংলা’ বলে ওঠলে পুরো অনুষ্ঠানস্থল প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও বাংলাদেশ তাঁর অকৃত্রিম বন্ধুদের ভোলেনি, এর জন্য যেন কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না সম্মাননা নিতে আসা ‘যুদ্ধবন্ধু’দের। বলেন, একাত্তরে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে পেরেছিলেন বলে তাঁরা নিজেরাই ধন্য, গর্বিতও। স্বাধীনতার ৪১ বছর পর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন বীরত্বপূর্ণ সম্মান দেখানোই সম্মাননা নিতে আসা বিদেশী অতিথিদের সবার কন্ঠেই ছিল বাংলাদেশের জনগণের প্রতি বিনম্র কৃতজ্ঞতা।
শনিবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন দেশের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সম্মাননাপ্রাপ্ত বিদেশী বন্ধুরা তাঁদের এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অবদান রাখা বিদেশী বন্ধুদের আজও ভোলেনি বাঙালী। ভুলতে পারে না এই দেশ। কারণ, সব ঋণ শোধ হওয়ার নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখা বিশিষ্ট বিদেশী ব্যক্তিদের জন্য তাই এবার তৃতীয় পর্যায়ের সম্মাননার আয়োজন। এরা জাতিতে বাংলাদেশের কেউ নয়, অথচ বাংলাদেশে গণহত্যার খবর শুনে নিজ দেশের সীমানা ডিঙিয়ে ওরা চলে এসেছিলেন সম্মুখ-সমরে। এমন পরার্থপর বন্ধুত্বের নিদর্শন আর কোন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেই।
রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষ থেকে লালগালিচা সংবর্ধনা আর বীরত্বপূর্ণ সম্মাননা পেয়ে কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না আজ থেকে ৪১ বছর আগে বাংলাদেশ জন্মের সহায়তা প্রদানকারী বিদেশী ‘যুদ্ধবন্ধু’দের কণ্ঠে। অনুষ্ঠানের শুরুতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সম্মাননাপ্রাপ্ত সবার অবদানের কথা উল্লেখ করে ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক মার্ক টালির নাম উচ্চারণ করলে পুরো মিলনায়তনে উপস্থিত অতিথিরা দীর্ঘ সময় করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানান।
এমন বীরত্বপূর্ণ সন্মান প্রদানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ এ দেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, এ বিরল সম্মানে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। এ জাতি বীরের জাতি। বাংলাদেশ আগামীতেও অবশ্যই ভাল করবে, সমৃদ্ধি অর্জন করবে।
একই অবস্থা হয় ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ ও ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানগুলোর রচয়িতা গোবিন্দ হালদার এবং ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি’- অমর এই গানটির রচয়িতা গৌরি প্রসন্ন মজুমদারের অবদানের কথা যখন পড়ে শোনান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এ সময় বিরামহীনভাবে করতালি দিতে থাকেন উপস্থিত অতিথিরা। একই অবস্থা হয় বাবার পক্ষে শাবানা আজমী যখন সম্মাননা দিতে আসেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে।
আবেগাপ্লুত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাও। বক্তব্যের শুরুতে তিনি বলেন, আমার একটা লিখিত বক্তব্যে আছে, সেটি পঠিত বলে গণ্য হবে। আজ আমি এখানে মনের কথা বলতে চাই। বুকে হাত রেখে তিনি বিদেশী বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আপনাদের সম্মান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের নিজেদেরও সম্মান জানাচ্ছি। যারা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছিল- তাঁদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “বলতে গেলে আপনারাও এক ধরনের মুক্তিযোদ্ধা।”
দেশ জন্মের সঙ্গে জড়িত বিদেশী ‘যুদ্ধবন্ধু’দের সম্মাননা জানাতে লাল-সবুজের উজ্জ্বল-উচ্ছ্বাসে সাজানো হয় গোটা রাজধানীকে। পুরো ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দ্বীপে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকা, মুক্তিযুদ্ধের ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রদানের নানা প্রতিকৃতি দিয়ে অপরূপভাবে সাজানো হয়েছিল। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি এসব মোড়ে বাজানো হয়েছে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যোগাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার গান। এমনকি সম্মাননাস্থল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সামনের এলাকায় সবুজ জমিনের ওপর লালের গাঢ় রক্ত যেন ঢেলে দেয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এসব ‘যুদ্ধবন্ধু’ অসহায় বাঙালি জাতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। যে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সে মুক্ত দেশেই রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ সম্মান পেয়ে তাঁরা যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন সেই ভয়াল একাত্তরে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিমাখা চেনা মানুষগুলোকে খুঁজে ফেরেন সবসময়। স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও বাংলাদেশ তার অকৃত্রিম বন্ধুদের ভোলেনি, এর জন্য যেন কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না সম্মাননা নিতে আসা ‘যুদ্ধবন্ধু’দের। তাঁদের কণ্ঠে ছিল কৃতজ্ঞতা, বলেন, একাত্তরে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে পেরেছিলেন বলে তাঁরা নিজেরাই ধন্য, গর্বিতও। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় স্মৃতিচারণ করেছেন কেউ কেউ।
সন্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ব্যাপক আয়োজন করা হয়। মূল ভবন থেকে মিলনায়তন পর্যন্ত লাল গালিচা ছিল। অতিথিরা এই লাল গালিচার ওপর দিয়ে হেঁটেই মিলনায়তনে প্রবেশ করেন। মিলনায়তনের স্থায়ী মঞ্চের থেকেই আয়তনে দ্বিগুণের চেয়েও বড় মঞ্চ তৈরি করা হয়। মঞ্চের পেছনে বাংলাদেশের পতাকার ওপর জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। সঙ্গে ছিল বিলাস একটি ডিজিটাল পর্দা। ওই পর্দায় পুরো অনুষ্ঠান চলাকালে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য সময়ের আলোকচিত্র প্রদর্শন করা হয়। মঞ্চের মাঝে ছিল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর বসার স্থান। আর, দু’পাশে বসেন সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং তাদের প্রতিনিধিরা।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ক্যাবিনেট ডিভিশন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে তৃতীয় পর্বে ৬১জন বিদেশী নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.