৫০ বছরে সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় by ডা. সুব্রত ঘোষ
সীমান্তবর্তী জেলা শহর সাতক্ষীরা। এ শহরের প্রাণকেন্দ্রে খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের গা-ঘেঁষে মনোমুগ্ধকর পরিবেশে অবস্থিত সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়। সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে রয়েছে দুটি দ্বিতল ভবন (বর্তমানে আংশিক তিন তলা করা হয়েছে)।
১৯৬২ থেকে ২০১২ সাল। ৫০টি বছর। দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমায় এ বিদ্যালয়ে তৈরি করেছে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মেধাবী। প্রতিষ্ঠার এই সুর্বণ জয়ন্তী উপলক্ষে আগামী ২৮ অক্টোবর জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
সাতক্ষীরার আধুনিক জীবনাচার শুরু হয়েছিল জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরীর হাত ধরে। অনেক জনহিতকর কাজের পাশাপাশি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পি.এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। শহরের দক্ষিণ প্রান্তের এই স্কুল ছিল শহর ও শহরতলি অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের একমাত্র ভরসা। নিরুপায় হয়ে শহরের অন্যপ্রান্তের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য অনেক দূর থেকে আসতে হতো। এ বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন হলো যখন, তখনকার কথা। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ধুমধাম করে স্কুলটির শতবর্ষ উদযাপন করল। সাতক্ষীরা মহাকুমার প্রশাসক হিসেবে তখন দায়িত্বে ছিলেন এ.কে.এন. সিদ্দিক উল্লাহ। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মহকুমা প্রশাসককে এই আয়োজন থেকে যথাসাধ্য দূরে রাখলেন। অনুষ্ঠান নিয়ে মহকুমা প্রশাসকের মনে একটা দাগ কেটে গেল। সে দাগ অভিমান আর বেদনার। অবশেষে বেদনা থেকে জন্ম নিল নতুন চিন্তা। নতুন আর একটা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার করে একটি বিদ্যালয়ের অহমিকা দূর করার চিন্তা। সমমনা শিক্ষানুরাগী সমাজসেবকদের সঙ্গে তিনি এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সাতক্ষীরা শহরের উত্তর প্রান্তে একটি হাইস্কুল স্থাপন জরুরী।
মহকুমা প্রশাসক এ.কে.এন সিদ্দিক উল্লাহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আহ্বান জানালেন নতুন একটি বিদ্যালয় স্থাপনের। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত হয় সাতক্ষীরা টাউন হাই স্কুল। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই উদ্যোক্তাদের আবেগের কমতি না থাকলেও আর্থিক সঙ্গতি তেমন ছিল না। অনেকেই তাঁদের স্ত্রির গহনা বিক্রি এবং বন্ধক রেখে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক খরচের টাকা যোগাড় করেন। স্কুল প্রতিষ্ঠায় বিশেষ সহায়তা প্রদান করেন খুলনা জেলার তৎকালীন এডিসি আব্দুর রব চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন সচিব ও প্রাক্তন সাংসদ এবং বর্তমানে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও সরকারের এমিকাস কিউরি।
১ জুলাই ১৯৬২ তারিখ থেকে নতুন এই বিদ্যালয়ের পাঠদান শুরু হয়। গঠন করা হয় বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি।
বিদ্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল প্রধান সড়কের পূর্ব পাশে প্রধান শিক্ষকের বর্তমান বাসভবন এলাকায়। চাঁচের বেড়া আর গোলপাতার ছাউনি বিশিষ্ট শ্রেণী কক্ষে। এ বিদ্যালয়টির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আলী আহম্মদ। বিদ্যালয়টির মোট জমির পরিমাণ ৯ একর ৫৬ শতক। এর মধ্যে ৭ একর ২ শতক জমি স্থানীয় বিভিন্ন জনের কাছ থেকে আত্মীকরণ করা। অবশিষ্ট ২ একর ৫৪ শতক এর মধ্যে ৮৭ শতক জমি দান করেন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন সম্পাদক মো. সোলায়মান। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য আহম্মদ মিয়া দান করেন ২ বিঘা জমি। সভাপতির অনুরোধক্রমে আত্মীকরণকৃত ৭ একর ২ শতক জমির টাকা আব্দুল গফুর, এম.এন.এ (বাটকেখালী) ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দান করেন। প্রতি বিঘা জমির দাম ধরা হয়েছিল ৭১৫ টাকা। বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন শেখ আব্দুল করিম। তারপর পর্যায়ক্রমে প্রতাপচন্দ্র (পি.সি) পাটওয়ারি, শেখ গহর আলী, মো. আবুল হোসেন, এরপর ১৯৬৮ সালে বিদ্যালয় সরকারী হলে আজিজুর রব প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। যাদের কাছ থেকে জমি আত্মীকরণ করা হয় তারা হলেন ফুটবল মাঠ এলাকা আব্দুল আলি দালাল, বর্তমান বিদ্যালয় ভবন এলাকা জনাব দীনেশচন্দ্র দত্ত (কর্মকার), বিদ্যালয়ের সম্মুখ ভাগ অর্থাৎ দক্ষিণ পাশের মাঠ আবেদার রহমান ও আনন্দ।
সাতক্ষীরা মহকুমার একটি বিদ্যালয় সরকারীকরণের প্রস্তাব এলে বিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের কর্তারা কেউ কেউ তাদের কর্তৃত্ব হারাবার এবং শিক্ষকদের অনেকেই চাকরি হারাবার আশঙ্কা করতে থাকেন। পি.এন হাইস্কুল এবং টাউন হাইস্কুল দুটো স্কুলের মধ্যেই এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। এ সময় টাউন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মোঃ আবুল হোসেন। আবুল হোসেন, তখনকার সহকারী শিক্ষক হাবিবুল হুসাইন ও পরিচালনা পর্ষদের কিছু সদস্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১ মে ১৯৬৮ সালে সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুল সরকারীকরণ হয়। ১৯৬৮ সালের এক বছর বিদ্যালয়টি টাউন সরকারী বিদ্যালয় নামে চলে। পরে সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ হয়। বিদ্যালয় সরকারী হলে প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেব যোগ দেন আজিজুর রব। আজিজুর রব স্যারের পরে আসেন আব্দুর রশিদ স্যার তারপর আবার আবুল হোসেন স্যার প্রধান শিক্ষক হন। বিদ্যালয়টি সরকারী হলে কোন শিক্ষক-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হননি। বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সম্পাদক মো. সোলায়মান (পলাশপোল) ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বৃহত্তর খুলনা জেলার প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক। সাতক্ষীরার প্রথম বইয়ের দোকান নিউ বুক হাউজ ছিল তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
সে সময়ে পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন খুলনার খান এ সবুর। সে সময়ে তিনি এই স্কুলের নতুন ভবনের জন্য বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করেন এবং পরিদর্শন করতে আসেন।
অনেক মধুর স্মৃতির পাশাপাশি অনেক বেদনার সস্মৃতি জড়িয়ে আছে বিদ্যালয়কে ঘিরে। মনে পড়ে সাদা জামা আর সবুজ প্যান্টের সেই স্কুল ড্রেসের কথা। নিজের অবচেতন মন হয়তবা আবারও ফিরে যেতে চায় সেই দিনে। কালের আবর্তনে হয়তবা একদিন এই স্মৃতিগুলোও ঝাপসা হয়ে যাবে। এভাবে নতুনদের জায়গা দিতে পুরনোকে বিদায় নিতে হয় চিরতরে। সবচেয়ে বেদনার স্মৃতি ১৯৯৯ সালের ৯ মে আমার সহপাঠী দেবব্রত মল্লিকের সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু। ওর মৃত্যুর মাত্র ক’দিন পরই আমাদের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিল। দেবব্রতের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আরেকবার মনে করিয়ে দেয় নিরাপদ সড়কের কথা। গত কয়েক বছর যাবত বিদ্যালয়ের এসএসসি ব্যাচ ’৯৯-এর ছাত্র সহকারী জজ আনিস এবং আরও কিছু বন্ধুদের উদ্যোগে সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্য থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য প্রতিটি বিভাগে একজন করে মেধাবী ছাত্রকে দেবব্রত মল্লিক স্মৃতি বৃত্তি প্রদান সহপাঠীদের প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
মনে পড়ে স্কুলে পড়ুয়া অবস্থায় নওশের আলী স্যারের মৃত্যু। মনে পড়ে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা জামায়েত আলী স্যারের কথা। যিনি দুটি পা হারিয়ে আজ অচল। স্যারের মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে ক্লাসের ভেতরই কেমন যেন শিহরিত হয়ে উঠতাম আমরা। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠা হয়তবা তাঁর অনুপ্রেরণাতেই। মাজেদ স্যার, যাঁর বিজ্ঞান চিন্তা এবং গবেষণাধর্মী অনুসন্ধিৎসু মন আমাদের অজানাকে জানার আগ্রহকে বাড়িয়ে তুলত অনেকাংশে। মনে পড়ে রাজ্জাক স্যারের ইংরেজী পড়ানো। তিনি যেন তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ইংরেজীর মতো দুর্বোধ্য ভাষাকে অতি সহজেই আমাদের আত্মস্থ করাতেন। হাবিবুল হুসাইন স্যার, স্কুলের সঙ্গেই বাড়ি হওয়াতে এবং আমার বাবার স্যার হবার সুবাদে কারণে-অকারণেই তাঁর বাসায় গিয়ে হাজির হলে একটুও বিরক্ত হতে দেখিনি। ইউনুস আলী স্যার এবং সুরাত আলী স্যার, সেই ৩য় শ্রেণী থেকেই আমাকে পরম ¯েœহে আগলে রাখতেন আর ডাক্তার বলে ডাকতেন। আব্দুর রহমান স্যার- স্কুলে ভর্তি হবার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর বিদায় নেয়া আমাকে পরিচিত করিয়েছিল ‘ফেয়ারওয়েল’ শব্দটির সঙ্গে। মরহুম খোদা বখ্শ স্যার, নিজের স্বমহিমায় নিজের পঙ্গুত্বকে কখনই বুঝতে দেননি যিনি। স্যারের যে একটি পা নেই তা বুঝতেই আমাদের কেটে গিয়েছিল অনেক বছর। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, আমার শিক্ষাজীবনের প্রথম প্রধান শিক্ষক। গল্পে শোনা বা বইতে পড়া হেড মাস্টার চরিত্রের সঙ্গে তাকে মেলাতে চেষ্টা করতাম বার বার। মনোরঞ্জন রিশ্বাস, এক কঠোর প্রধান শিক্ষকের প্রতিকৃতি। ১৯৯৬ সালে অষ্টম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় বিদ্যালয়ের নিয়মবহির্ভূত কার্যকলাপের জন্য সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলাম। হতভম্ব হয়ে স্যার শুধু বলেছিলেন, ‘তোর কাছ থেকে কখনও এটা আশা করিনি।’ রণজিৎ কুমার রায়, একটি মানুষ একাধারে কঠোর, একাধারে বন্ধু; তার এক অনন্য উদাহরণ। পড়া না পারলে রেগে গিয়ে তিনি বলতেন, ‘হবি নি তো চোর, খাবি নি তো চুরি করে।’ আজও তাঁর কথাগুলো আমার কানে বাজে। হরি নারায়ণ চক্রবর্তী, প-িত স্যার নামের মাঝে বলতে গেলে হারিয়েই গিয়েছিল তার আসল নামটি। হয়তবা এই মধুর নামের সম্বোধনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি। মাত্র কিছুদিন আগে তিনি পরলোকগমন করেন। ৫০ বছর পূর্তি উৎসবটি দেখে যেতে পারলেন না তিনি। তার ক্লাসে ‘মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’এর মতো দূর কোন কল্পলোকে হারিয়ে যেতাম অবচেতন মনে। মনে পড়ে দশম শ্রেণীতে ইমু কবিতাটি দিনের পর দিন মুখস্থ না করতে পারায় কতবার জোড়া বেতের বাড়ি খেয়ে হাত লাল করেছি কবির স্যারের কাছে। আমার চরম দুর্দিনের সময় আমার প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থনে তার প্রতি আমার সকল ক্ষোভ প্রশমিত হয়ে যায়। খুঁজে পাই নতুন এক কবির আহমেদকে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির এক জলন্ত উদাহরণ কোরবান আলী স্যার। পবিত্র হজ থেকে ফিরে বিদ্যালয়ে সৌদি থেকে খোরমা এনে খেতে দিলেন। প্রথমটির গৌরবময় অংশীদার ছিলাম আমি। বাংলা সাহিত্যের ক্লাসগুলোতে জাদুকরের মতো বশীভূত করে রাখতেন আবুল কাশেম (১) স্যার। আবুল কাশেম (২), বিদ্যালয়ে তিনি আসার আগে আর একজন আবুল কাসেম শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকায় ২ নং কাশেম স্যার হিসেবে পরিচিতি পেলেও কাজে কর্মে ব্যক্তিত্বে তিনি ছিলেন নাম্বার ১। ‘এবার থাম এক দো!!!’ শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে যার হাতে মার খেতাম প্রায়ইÑশরীরচর্চা শেষে ‘ছুটির জন্য প্রস্তুত ছু———টি’। সেই ছুটিতে আছেন প্রভাস চন্দ্র বিশ্বাস স্যার। পড়া না পারলে সুন্দর করে কান দুটো টেনে দুই গালে দুটো থাপ্পড় মেরে ইংরেজী গ্রামার বইটা হাতে ধরিয়ে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতেন পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক হওয়া নূর মোহাম্মদ স্যার। এখন বুঝি স্যারের মার না খেলে হয়তবা ইংরেজী মাধ্যমে পড়াটাই হতো না। সদাহাস্য মতিউর রহমান স্যার, হাসি মুখে বিদ্যালয় ক্যাম্পাসটিকে ভরিয়ে রাখতেন সারাক্ষণ। আমিনুর রহমান স্যার, স্যারকে হাসতে দেখেছে এমন লোকের সংখ্যা হাতেগোনা, তবে আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। তবে আমিনুর রহমান স্যার ছিলেন পড়া লেখার সঙ্গে নো কম্প্রোমাইজ প্রকৃতির। আবুল খায়ের স্যার, ছোট হুজুর নামের ভারে আসল নামটি চাপা পড়ে গিয়েছিল। কৃষি শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন মোস্তফা খাইরুল আরবার স্যার। সাঈদ স্যারের রসায়ন ক্লাসে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় টেস্টটিউব ফেটে শ্রেণীকক্ষের ছাদে উৎপাদ লেগে যাবার ঘটনা আজও মনে পড়ে। তার ক্লাসে ফাঁকি দেওয়া যেত বলে আমরা তাকে খুব ভালবাসতাম- অপেক্ষায় থাকতাম ওনার ক্লাসের। আনিসুর রহমান স্যারের সামাজিক বিজ্ঞান ক্লাসগুলোর কথা আজও ভুলিনি। কিছুদিনের জন্য ইংরেজী আর গণিতের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম মাহবুবুর রহমান স্যারকে যদিও তিনি অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন। আরিফুল ইসলাম স্যার, আমরা পেয়েছি ইংরেজী শিক্ষক হিসেবে পরবর্তীতে। তিনি সাতক্ষীরা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অসম্ভব রোমান্টিক মনের মানুষ স্যার। স্যারের রোমান্টিকতা সম্পর্কে অনেক কিছুই আমি এবং আমরা জানি কিন্তু জনসমক্ষে বলা যাবে না। একমাত্র মহিলা শিক্ষক সুহেলী সুলতানা ম্যাডাম। আমাদের হাজার খানেক পুরুষের মাঝে তিনি একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি যিনি প্রতিনিধিত্ব করতেন মহিলা সমাজের। মায়ের পরম মমতা দিয়ে আমাদের ভালবাসতেন ম্যাডাম। অলক চন্দ্র তরফদার স্যার, শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন জানি না তবে তার ভয়েস ছিল, মানে গর্জন ছিল এটুকুই বলব। যদিও স্যারের ক্লাস খুব বেশি পাইনি আমি তাই তার সংস্পর্শেও খুব বেশি যাবার সৌভাগ্য হয়নি আমার। আবুল হাসান স্যার, এ সহপাঠীকে সমান্য আঘাত করলে তার নালিশে স্কুলে প্রথম দিন এসেই আমাকে বেত মেরে নিজের উপস্থিতির জানান দিয়েছিলেন। স্যারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ কারণ তিনিই প্রথম আমাকে বিউটি বোন (কলার বোন) চিনিয়েছিলেন। ২ জন শিক্ষকের কথা একটু বিশেষভাবে বলব। মননে যাঁদের রেখেছি আদর্শ করে। তাঁদের কাছ থেকে আদর আর অবহেলা না পেলে আমি হয়ত এত দূর আসতেই পারতাম না। রমেশ চন্দ্র বিশ্বাস স্যার ও কিশোরী মোহন সরকার স্যার। হ্যাঁ, তাঁরা আমাকে অসম্ভব আদর করতেন, ভালবাসতেন এ কথা কখনই অস্বীকার করব না তবে কিছু কারণে তাঁদের প্রতি আমার একটা নীরব অভিমান রয়ে গেছে আজও। তবে তাঁদের বিশেষভাবে স্মরণ করে অন্য শিক্ষকদের একটুও ছোট করছি না।
মনে পড়ে পিয়ন আব্দুল আলীমের কথা। তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজী আর হাস্যরসবোধ আমাদের আনন্দ দিত সারাক্ষণ। দারোয়ান আবুল কাশেম ভাইকে ভোলার নয়। নৈশপ্রহরী তরতাজা যুবক অকালে মৃত্যুবরণকারী আব্দুর রউফ আর বয়স-সংসারের ভারে ন্যুব্জ ব্দ্ধৃ ছমিরউদ্দিন চাচার কথাও ভুলিনি। মনে পড়ে ঝাড়ুদার ঊষা রানী শীল দিদি আর মালী সালেহা আপার কথা। মনে পড়ে চটপটি আর সিঙাড়া বিক্রেতা কালাম ভাইয়ের কথা।
আমার সহপাঠীদের মনে করার চেষ্টা করছি। পারছি না সবার চেহারাকে মনের মধ্যে আনতে। মাত্র ক’বছরেই ভুলতে বসেছি তাদের কথা। জানি না তারা কে কাথায় আছে? কেমন আছে? আমি তোমদের স্মরণ করছি বন্ধুরা। তোমাদের কি আমার কথা মনে আছে? ক্লাসের সবচেয়ে ডানপিটে ছেলেটার কথা? বন্ধুরা এসো শত ব্যস্ততা ভুলে একটু সময় করে একে অপরকে স্মরণ করি যে যেখানেই বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকি না কেন। আসুন সবাই মিলে সাতক্ষীরার অবহেলিত-দুঃখী মানুষগুলোর জন্য কিছু করি। সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় পরিবারের প্রাক্তন ও বর্তমান সকলের মঙ্গল কামনা করছি।
লেখক : সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র
সাতক্ষীরার আধুনিক জীবনাচার শুরু হয়েছিল জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরীর হাত ধরে। অনেক জনহিতকর কাজের পাশাপাশি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পি.এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। শহরের দক্ষিণ প্রান্তের এই স্কুল ছিল শহর ও শহরতলি অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের একমাত্র ভরসা। নিরুপায় হয়ে শহরের অন্যপ্রান্তের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য অনেক দূর থেকে আসতে হতো। এ বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন হলো যখন, তখনকার কথা। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ধুমধাম করে স্কুলটির শতবর্ষ উদযাপন করল। সাতক্ষীরা মহাকুমার প্রশাসক হিসেবে তখন দায়িত্বে ছিলেন এ.কে.এন. সিদ্দিক উল্লাহ। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মহকুমা প্রশাসককে এই আয়োজন থেকে যথাসাধ্য দূরে রাখলেন। অনুষ্ঠান নিয়ে মহকুমা প্রশাসকের মনে একটা দাগ কেটে গেল। সে দাগ অভিমান আর বেদনার। অবশেষে বেদনা থেকে জন্ম নিল নতুন চিন্তা। নতুন আর একটা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার করে একটি বিদ্যালয়ের অহমিকা দূর করার চিন্তা। সমমনা শিক্ষানুরাগী সমাজসেবকদের সঙ্গে তিনি এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সাতক্ষীরা শহরের উত্তর প্রান্তে একটি হাইস্কুল স্থাপন জরুরী।
মহকুমা প্রশাসক এ.কে.এন সিদ্দিক উল্লাহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আহ্বান জানালেন নতুন একটি বিদ্যালয় স্থাপনের। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত হয় সাতক্ষীরা টাউন হাই স্কুল। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই উদ্যোক্তাদের আবেগের কমতি না থাকলেও আর্থিক সঙ্গতি তেমন ছিল না। অনেকেই তাঁদের স্ত্রির গহনা বিক্রি এবং বন্ধক রেখে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক খরচের টাকা যোগাড় করেন। স্কুল প্রতিষ্ঠায় বিশেষ সহায়তা প্রদান করেন খুলনা জেলার তৎকালীন এডিসি আব্দুর রব চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন সচিব ও প্রাক্তন সাংসদ এবং বর্তমানে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও সরকারের এমিকাস কিউরি।
১ জুলাই ১৯৬২ তারিখ থেকে নতুন এই বিদ্যালয়ের পাঠদান শুরু হয়। গঠন করা হয় বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি।
বিদ্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল প্রধান সড়কের পূর্ব পাশে প্রধান শিক্ষকের বর্তমান বাসভবন এলাকায়। চাঁচের বেড়া আর গোলপাতার ছাউনি বিশিষ্ট শ্রেণী কক্ষে। এ বিদ্যালয়টির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আলী আহম্মদ। বিদ্যালয়টির মোট জমির পরিমাণ ৯ একর ৫৬ শতক। এর মধ্যে ৭ একর ২ শতক জমি স্থানীয় বিভিন্ন জনের কাছ থেকে আত্মীকরণ করা। অবশিষ্ট ২ একর ৫৪ শতক এর মধ্যে ৮৭ শতক জমি দান করেন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন সম্পাদক মো. সোলায়মান। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য আহম্মদ মিয়া দান করেন ২ বিঘা জমি। সভাপতির অনুরোধক্রমে আত্মীকরণকৃত ৭ একর ২ শতক জমির টাকা আব্দুল গফুর, এম.এন.এ (বাটকেখালী) ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দান করেন। প্রতি বিঘা জমির দাম ধরা হয়েছিল ৭১৫ টাকা। বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন শেখ আব্দুল করিম। তারপর পর্যায়ক্রমে প্রতাপচন্দ্র (পি.সি) পাটওয়ারি, শেখ গহর আলী, মো. আবুল হোসেন, এরপর ১৯৬৮ সালে বিদ্যালয় সরকারী হলে আজিজুর রব প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। যাদের কাছ থেকে জমি আত্মীকরণ করা হয় তারা হলেন ফুটবল মাঠ এলাকা আব্দুল আলি দালাল, বর্তমান বিদ্যালয় ভবন এলাকা জনাব দীনেশচন্দ্র দত্ত (কর্মকার), বিদ্যালয়ের সম্মুখ ভাগ অর্থাৎ দক্ষিণ পাশের মাঠ আবেদার রহমান ও আনন্দ।
সাতক্ষীরা মহকুমার একটি বিদ্যালয় সরকারীকরণের প্রস্তাব এলে বিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের কর্তারা কেউ কেউ তাদের কর্তৃত্ব হারাবার এবং শিক্ষকদের অনেকেই চাকরি হারাবার আশঙ্কা করতে থাকেন। পি.এন হাইস্কুল এবং টাউন হাইস্কুল দুটো স্কুলের মধ্যেই এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। এ সময় টাউন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মোঃ আবুল হোসেন। আবুল হোসেন, তখনকার সহকারী শিক্ষক হাবিবুল হুসাইন ও পরিচালনা পর্ষদের কিছু সদস্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১ মে ১৯৬৮ সালে সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুল সরকারীকরণ হয়। ১৯৬৮ সালের এক বছর বিদ্যালয়টি টাউন সরকারী বিদ্যালয় নামে চলে। পরে সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ হয়। বিদ্যালয় সরকারী হলে প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেব যোগ দেন আজিজুর রব। আজিজুর রব স্যারের পরে আসেন আব্দুর রশিদ স্যার তারপর আবার আবুল হোসেন স্যার প্রধান শিক্ষক হন। বিদ্যালয়টি সরকারী হলে কোন শিক্ষক-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হননি। বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সম্পাদক মো. সোলায়মান (পলাশপোল) ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বৃহত্তর খুলনা জেলার প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক। সাতক্ষীরার প্রথম বইয়ের দোকান নিউ বুক হাউজ ছিল তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
সে সময়ে পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন খুলনার খান এ সবুর। সে সময়ে তিনি এই স্কুলের নতুন ভবনের জন্য বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করেন এবং পরিদর্শন করতে আসেন।
অনেক মধুর স্মৃতির পাশাপাশি অনেক বেদনার সস্মৃতি জড়িয়ে আছে বিদ্যালয়কে ঘিরে। মনে পড়ে সাদা জামা আর সবুজ প্যান্টের সেই স্কুল ড্রেসের কথা। নিজের অবচেতন মন হয়তবা আবারও ফিরে যেতে চায় সেই দিনে। কালের আবর্তনে হয়তবা একদিন এই স্মৃতিগুলোও ঝাপসা হয়ে যাবে। এভাবে নতুনদের জায়গা দিতে পুরনোকে বিদায় নিতে হয় চিরতরে। সবচেয়ে বেদনার স্মৃতি ১৯৯৯ সালের ৯ মে আমার সহপাঠী দেবব্রত মল্লিকের সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু। ওর মৃত্যুর মাত্র ক’দিন পরই আমাদের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিল। দেবব্রতের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আরেকবার মনে করিয়ে দেয় নিরাপদ সড়কের কথা। গত কয়েক বছর যাবত বিদ্যালয়ের এসএসসি ব্যাচ ’৯৯-এর ছাত্র সহকারী জজ আনিস এবং আরও কিছু বন্ধুদের উদ্যোগে সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্য থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য প্রতিটি বিভাগে একজন করে মেধাবী ছাত্রকে দেবব্রত মল্লিক স্মৃতি বৃত্তি প্রদান সহপাঠীদের প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
মনে পড়ে স্কুলে পড়ুয়া অবস্থায় নওশের আলী স্যারের মৃত্যু। মনে পড়ে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা জামায়েত আলী স্যারের কথা। যিনি দুটি পা হারিয়ে আজ অচল। স্যারের মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে ক্লাসের ভেতরই কেমন যেন শিহরিত হয়ে উঠতাম আমরা। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠা হয়তবা তাঁর অনুপ্রেরণাতেই। মাজেদ স্যার, যাঁর বিজ্ঞান চিন্তা এবং গবেষণাধর্মী অনুসন্ধিৎসু মন আমাদের অজানাকে জানার আগ্রহকে বাড়িয়ে তুলত অনেকাংশে। মনে পড়ে রাজ্জাক স্যারের ইংরেজী পড়ানো। তিনি যেন তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ইংরেজীর মতো দুর্বোধ্য ভাষাকে অতি সহজেই আমাদের আত্মস্থ করাতেন। হাবিবুল হুসাইন স্যার, স্কুলের সঙ্গেই বাড়ি হওয়াতে এবং আমার বাবার স্যার হবার সুবাদে কারণে-অকারণেই তাঁর বাসায় গিয়ে হাজির হলে একটুও বিরক্ত হতে দেখিনি। ইউনুস আলী স্যার এবং সুরাত আলী স্যার, সেই ৩য় শ্রেণী থেকেই আমাকে পরম ¯েœহে আগলে রাখতেন আর ডাক্তার বলে ডাকতেন। আব্দুর রহমান স্যার- স্কুলে ভর্তি হবার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর বিদায় নেয়া আমাকে পরিচিত করিয়েছিল ‘ফেয়ারওয়েল’ শব্দটির সঙ্গে। মরহুম খোদা বখ্শ স্যার, নিজের স্বমহিমায় নিজের পঙ্গুত্বকে কখনই বুঝতে দেননি যিনি। স্যারের যে একটি পা নেই তা বুঝতেই আমাদের কেটে গিয়েছিল অনেক বছর। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, আমার শিক্ষাজীবনের প্রথম প্রধান শিক্ষক। গল্পে শোনা বা বইতে পড়া হেড মাস্টার চরিত্রের সঙ্গে তাকে মেলাতে চেষ্টা করতাম বার বার। মনোরঞ্জন রিশ্বাস, এক কঠোর প্রধান শিক্ষকের প্রতিকৃতি। ১৯৯৬ সালে অষ্টম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় বিদ্যালয়ের নিয়মবহির্ভূত কার্যকলাপের জন্য সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলাম। হতভম্ব হয়ে স্যার শুধু বলেছিলেন, ‘তোর কাছ থেকে কখনও এটা আশা করিনি।’ রণজিৎ কুমার রায়, একটি মানুষ একাধারে কঠোর, একাধারে বন্ধু; তার এক অনন্য উদাহরণ। পড়া না পারলে রেগে গিয়ে তিনি বলতেন, ‘হবি নি তো চোর, খাবি নি তো চুরি করে।’ আজও তাঁর কথাগুলো আমার কানে বাজে। হরি নারায়ণ চক্রবর্তী, প-িত স্যার নামের মাঝে বলতে গেলে হারিয়েই গিয়েছিল তার আসল নামটি। হয়তবা এই মধুর নামের সম্বোধনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি। মাত্র কিছুদিন আগে তিনি পরলোকগমন করেন। ৫০ বছর পূর্তি উৎসবটি দেখে যেতে পারলেন না তিনি। তার ক্লাসে ‘মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’এর মতো দূর কোন কল্পলোকে হারিয়ে যেতাম অবচেতন মনে। মনে পড়ে দশম শ্রেণীতে ইমু কবিতাটি দিনের পর দিন মুখস্থ না করতে পারায় কতবার জোড়া বেতের বাড়ি খেয়ে হাত লাল করেছি কবির স্যারের কাছে। আমার চরম দুর্দিনের সময় আমার প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থনে তার প্রতি আমার সকল ক্ষোভ প্রশমিত হয়ে যায়। খুঁজে পাই নতুন এক কবির আহমেদকে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির এক জলন্ত উদাহরণ কোরবান আলী স্যার। পবিত্র হজ থেকে ফিরে বিদ্যালয়ে সৌদি থেকে খোরমা এনে খেতে দিলেন। প্রথমটির গৌরবময় অংশীদার ছিলাম আমি। বাংলা সাহিত্যের ক্লাসগুলোতে জাদুকরের মতো বশীভূত করে রাখতেন আবুল কাশেম (১) স্যার। আবুল কাশেম (২), বিদ্যালয়ে তিনি আসার আগে আর একজন আবুল কাসেম শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকায় ২ নং কাশেম স্যার হিসেবে পরিচিতি পেলেও কাজে কর্মে ব্যক্তিত্বে তিনি ছিলেন নাম্বার ১। ‘এবার থাম এক দো!!!’ শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে যার হাতে মার খেতাম প্রায়ইÑশরীরচর্চা শেষে ‘ছুটির জন্য প্রস্তুত ছু———টি’। সেই ছুটিতে আছেন প্রভাস চন্দ্র বিশ্বাস স্যার। পড়া না পারলে সুন্দর করে কান দুটো টেনে দুই গালে দুটো থাপ্পড় মেরে ইংরেজী গ্রামার বইটা হাতে ধরিয়ে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতেন পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক হওয়া নূর মোহাম্মদ স্যার। এখন বুঝি স্যারের মার না খেলে হয়তবা ইংরেজী মাধ্যমে পড়াটাই হতো না। সদাহাস্য মতিউর রহমান স্যার, হাসি মুখে বিদ্যালয় ক্যাম্পাসটিকে ভরিয়ে রাখতেন সারাক্ষণ। আমিনুর রহমান স্যার, স্যারকে হাসতে দেখেছে এমন লোকের সংখ্যা হাতেগোনা, তবে আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। তবে আমিনুর রহমান স্যার ছিলেন পড়া লেখার সঙ্গে নো কম্প্রোমাইজ প্রকৃতির। আবুল খায়ের স্যার, ছোট হুজুর নামের ভারে আসল নামটি চাপা পড়ে গিয়েছিল। কৃষি শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন মোস্তফা খাইরুল আরবার স্যার। সাঈদ স্যারের রসায়ন ক্লাসে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় টেস্টটিউব ফেটে শ্রেণীকক্ষের ছাদে উৎপাদ লেগে যাবার ঘটনা আজও মনে পড়ে। তার ক্লাসে ফাঁকি দেওয়া যেত বলে আমরা তাকে খুব ভালবাসতাম- অপেক্ষায় থাকতাম ওনার ক্লাসের। আনিসুর রহমান স্যারের সামাজিক বিজ্ঞান ক্লাসগুলোর কথা আজও ভুলিনি। কিছুদিনের জন্য ইংরেজী আর গণিতের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম মাহবুবুর রহমান স্যারকে যদিও তিনি অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন। আরিফুল ইসলাম স্যার, আমরা পেয়েছি ইংরেজী শিক্ষক হিসেবে পরবর্তীতে। তিনি সাতক্ষীরা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অসম্ভব রোমান্টিক মনের মানুষ স্যার। স্যারের রোমান্টিকতা সম্পর্কে অনেক কিছুই আমি এবং আমরা জানি কিন্তু জনসমক্ষে বলা যাবে না। একমাত্র মহিলা শিক্ষক সুহেলী সুলতানা ম্যাডাম। আমাদের হাজার খানেক পুরুষের মাঝে তিনি একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি যিনি প্রতিনিধিত্ব করতেন মহিলা সমাজের। মায়ের পরম মমতা দিয়ে আমাদের ভালবাসতেন ম্যাডাম। অলক চন্দ্র তরফদার স্যার, শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন জানি না তবে তার ভয়েস ছিল, মানে গর্জন ছিল এটুকুই বলব। যদিও স্যারের ক্লাস খুব বেশি পাইনি আমি তাই তার সংস্পর্শেও খুব বেশি যাবার সৌভাগ্য হয়নি আমার। আবুল হাসান স্যার, এ সহপাঠীকে সমান্য আঘাত করলে তার নালিশে স্কুলে প্রথম দিন এসেই আমাকে বেত মেরে নিজের উপস্থিতির জানান দিয়েছিলেন। স্যারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ কারণ তিনিই প্রথম আমাকে বিউটি বোন (কলার বোন) চিনিয়েছিলেন। ২ জন শিক্ষকের কথা একটু বিশেষভাবে বলব। মননে যাঁদের রেখেছি আদর্শ করে। তাঁদের কাছ থেকে আদর আর অবহেলা না পেলে আমি হয়ত এত দূর আসতেই পারতাম না। রমেশ চন্দ্র বিশ্বাস স্যার ও কিশোরী মোহন সরকার স্যার। হ্যাঁ, তাঁরা আমাকে অসম্ভব আদর করতেন, ভালবাসতেন এ কথা কখনই অস্বীকার করব না তবে কিছু কারণে তাঁদের প্রতি আমার একটা নীরব অভিমান রয়ে গেছে আজও। তবে তাঁদের বিশেষভাবে স্মরণ করে অন্য শিক্ষকদের একটুও ছোট করছি না।
মনে পড়ে পিয়ন আব্দুল আলীমের কথা। তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজী আর হাস্যরসবোধ আমাদের আনন্দ দিত সারাক্ষণ। দারোয়ান আবুল কাশেম ভাইকে ভোলার নয়। নৈশপ্রহরী তরতাজা যুবক অকালে মৃত্যুবরণকারী আব্দুর রউফ আর বয়স-সংসারের ভারে ন্যুব্জ ব্দ্ধৃ ছমিরউদ্দিন চাচার কথাও ভুলিনি। মনে পড়ে ঝাড়ুদার ঊষা রানী শীল দিদি আর মালী সালেহা আপার কথা। মনে পড়ে চটপটি আর সিঙাড়া বিক্রেতা কালাম ভাইয়ের কথা।
আমার সহপাঠীদের মনে করার চেষ্টা করছি। পারছি না সবার চেহারাকে মনের মধ্যে আনতে। মাত্র ক’বছরেই ভুলতে বসেছি তাদের কথা। জানি না তারা কে কাথায় আছে? কেমন আছে? আমি তোমদের স্মরণ করছি বন্ধুরা। তোমাদের কি আমার কথা মনে আছে? ক্লাসের সবচেয়ে ডানপিটে ছেলেটার কথা? বন্ধুরা এসো শত ব্যস্ততা ভুলে একটু সময় করে একে অপরকে স্মরণ করি যে যেখানেই বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকি না কেন। আসুন সবাই মিলে সাতক্ষীরার অবহেলিত-দুঃখী মানুষগুলোর জন্য কিছু করি। সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় পরিবারের প্রাক্তন ও বর্তমান সকলের মঙ্গল কামনা করছি।
লেখক : সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র
No comments