চরাচর-নয় কুড়ি কান্দার ছয় কুড়ি বিল by শামস শামীম

জল থৈথৈ হাওরের বুকে শাপলা-শালুক, হিজল-করচ, নলখাগড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ উদ্ভিদের মনোরম নৃত্য। মেঘনীল মেঘালয় পাহাড় দীর্ঘ ছায়ায় নৈসর্গিক রূপ ছড়িয়েছে হাওরে। ভরা বর্ষা রাতে আসমান ভাইঙ্গা পড়ে জোছনা; রুপা ছড়ায় কুচিকুচি ঢেউয়ে।


রাতে মাছধরা নৌকার কুপিবাতি আর জেলে মাঝির ভাটিয়ালি গান অন্য রকম পৃথিবীর সন্ধান দেয়। হেমন্তে সীমান্ত ছুঁয়ে আসা উত্তরে হাওয়া সারি সারি খাগড়ানল আর হিজল-করচের বাগ কান্দাকে করে সবুজের তোরণ। শীতে পাখিবন্যা নামে। লাখো পাখির কিচিরমিচির আর ডানা ঝাপটানো গানে মাতোয়ারা তখন হাওর। হাওরের সৌন্দর্য দেখতে বর্ষা-হেমন্ত-শীতে নামে পর্যটকের ঢল। আগতরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে বহু বর্ণিল স্থলজ-জলজ-উভচর জীববৈচিত্র্য দেখে মুগ্ধ হন। হাওরটির নাম টাঙ্গুয়ার হাওর।
টাঙ্গুয়ার হাওর দেশব্যাপী মাদার ফিশারিজ হিসেবে পরিচিত। সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক রামসারসাইট এলাকা হিসেবে দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে। অসংখ্য জীববৈচিত্র্যের কারণে ব্যাপক পরিচিতি পেলেও এলাকার মানুষের কাছে এটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল। ৯৭.২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের হাওরটি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধরমপাশা উপজেলার ছোট-বড় ৮৮টি গ্রাম বেষ্টিত। গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার জনসংখ্যার ৩০ ভাগ মৎস্যজীবী, ৬০ ভাগ কৃষিজীবী আর ১০ ভাগ মানুষ অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত। হাওরপাড়ের বিভিন্ন গ্রামে হাওর-ভাটির বৈচিত্র্যময় উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। হাওরে রয়েছে ৫২টি বিল, ১২০টি কান্দা-জাঙ্গাল। ১৪১ প্রজাতির মাছ, ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২১৯ প্রজাতির পাখি, ৯৮ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি, ১২১ প্রজাতির দেশি পখি, ২২ প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণীসহ অসংখ্য স্থল, জলচর প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য টাঙ্গুয়ার হাওরকে জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ করেছে। ২০১১ সালে এই হাওরে ৬৪ হাজার পাখির জরিপ সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে ৮৬ জাতির দেশি ও ৮৩ জাতের বিদেশি পাখি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। টাঙ্গুয়ার বিভিন্ন বিল-কান্দার নাম ভারি চমৎকার, কাব্যিক ও এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ভৌগোলিকতার প্রতিনিধিত্ব করে।
হাওরের সৌন্দর্য, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় হাওরের লেচুয়ামারা, বেরবেরিয়াসহ দুটি জলাশয়কে পাখির অভয়াশ্রম, চারটি জলাশয়কে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণ করেছে সরকার। গত কয়েক বছরে হাওরের বিভিন্ন কান্দায় কয়েক লাখ নলখাগড়া ও হিজল-করচ লাগানো হয়েছে। সরকার ২০০৩ সাল থেকে দাতা সংস্থা আইইউসিএন ও কয়েকটি দেশি এনজিওকে নিয়ে হাওর ব্যবস্থাপনায় রয়েছে।

শামস শামীম

No comments

Powered by Blogger.