রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলা ফেসবুক কতটা দোষী? by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলার পর দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এ ঘটনায় দোষী কে, তা নিয়ে ইতিমধ্যে পানিও অনেক ঘোলা হয়েছে। বিএনপি আর আওয়ামী লীগ সে ঘোলা পানিতে নেমে নিজেদের সুবিধামতো মাছটি ধরার চেষ্টাও করেছে। অনেকেই স্থানীয় প্রশাসনকে ঘটনায় নিষ্ক্রিয় থাকার দোষে অভিযুক্ত করেছে।


একটি জাতীয় দৈনিকে আবার ফেসবুক ব্যবহারকারীদেরও দোষারোপ করা হয়েছে। এ ঘটনা নিয়ে যত কলাম লেখা হয়েছে পত্রিকাগুলোতে, সেসব কলামে বেশির ভাগ কলামিস্টই লিখেছেন যে উত্তম বড়ুয়া নামে এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ট্যাগ করা একটি ছবিতে লাইক দেওয়ার ব্যক্তিগত ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধপল্লীতে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। আমার আপত্তিটা ঠিক এখানেই। প্রিয় পাঠক, আপাতদৃষ্টিতে কথাটিকে খুব নিরীহ মনে হবে; যখন আপনি কানে শুনে যাচ্ছেন অথবা লেখায় পড়ে যাচ্ছেন- উত্তম বড়ুয়া নামে এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ট্যাগ করা একটি ছবিতে লাইক দেওয়ার ব্যক্তিগত ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধপল্লীতে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। কিন্তু ফেসবুক যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁরা জানেন, ফেসবুক শেয়ারের নিয়মই হচ্ছে এই, ফেসবুকে ব্যক্তিগত বলে কিছুই নেই। ব্যক্তিগত একটি ঘটনা ফেসবুকে শেয়ার করার সঙ্গে সঙ্গে সেটি মুহূর্তেই অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
মুসলমানদের দৃষ্টিতে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিটিতে উত্তম বড়ুয়া লাইক দেওয়ার পর এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের ব্যবধানে সেটি তার বন্ধু, বন্ধুদের বন্ধু, তাদেরও বন্ধু- এভাবে করে, এ স্পর্শকাতর ছবি বা স্ট্যাটাসটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়েছে তার বন্ধু-বান্ধবের ভেতর- এ কথাটিকে বৌদ্ধপল্লীতে হামলার পেছনে একটি কার্যকারণ হিসেবে একেবারেই বিবেচনা করা হচ্ছে না সরকারের তরফ থেকে। রামুর বৌদ্ধপল্লী ও বৌদ্ধবিহারগুলোতে হামলার পেছনে কে বা কারা দায়ী, বিতর্কের সেসব শাখা-প্রশাখায় না গিয়ে, ঘটনার নেপথ্যে ফেসবুকের দোষ কতটা; সে ব্যাপারটাই এখানে আলোচনা করতে চাই।
ধরা যাক, নাইজেরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হোস্টেলে একটি মেয়েকে পাঁচজন পুরুষ পরপর ধর্ষণ করেছে- এই ফেসবুক ক্লিপটি সাড়া ফেলে দিয়েছে সর্বত্র। ১০ মিনিটের এই ক্লিপে দেখা যায়, মেয়েটি পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে, আমাকে তোমরা মেরে ফেলো। কিন্তু তার বদলে সে ধর্ষিত হয়। নাইজেরিয়ার এনজিওগুলো বলছে, তারা এ নিয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখবে; তাদের আন্দোলন আরো শক্তিশালী করবে ক্লিপটি, প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে যে নাইজেরিয়ার মতো দেশে প্রতিনিয়ত কত ধর্ষণ হয়। আর সে ব্যাপারে সরকার কতটা উদাসীন। এই প্রচার একটা বড় ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। যদিও অনেকে আপত্তি করেছেন- ওই মেয়েটার কী হবে? ধর্ষণের অত্যাচার, মানসিক যন্ত্রণা- সব যদি সে কাটিয়েও ওঠে; কিন্তু তার সবচেয়ে নৃশংস অসহায় মুহূর্তগুলো তো পাবলিকের হয়ে গেল। কিন্তু কথা হচ্ছে, কিসের বিনিময়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে? একজনের প্রতি একটা নৃশংস অন্যায়ের ওপর ভর করে?
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক বা ব্লগগুলোর নিয়মই হচ্ছে এমন : ধর্ষণের ক্লিপই হোক বা ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিই হোক, তাদের দোষী সাব্যস্ত করা যায় না এ কারণে যে কাঁধে অন্যের ভালো কিংবা মন্দের দায়িত্ব না থাকা সত্ত্বেও শুধু তথ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার দায়ে অন্যের ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, অন্যের ব্যক্তিগত অপমান, অন্যের ব্যক্তিগত জীবন পাবলিকের সামনে নিলাম করে ফেসবুক। ফেসবুক সব সময় ব্যক্তিগত তথ্যেই ভরপুর। কারো অসুখ হয়েছে, কেউ গাছে পানি দিল, কারো বাবা এখনই হার্ট অ্যাটাক করল, কেউ ধর্মে বিশ্বাস করে আবার কেউবা ধর্মবিরোধী- ক্ষণে ক্ষণে ব্যক্তিগত আপডেট। ফেসবুকের প্রতি মুহূর্তের আপডেট, প্রশংসা আর সহানুভূতি- ফেসবুক ব্যবহারকারীদের জীবনকে তাই আলোড়িত করে রাখে।
আর সে জন্যই ফেসবুকে বন্ধুরা পরস্পর পরস্পরের ব্যাপারগুলোতে শেয়ার করে।
কথাটা হলো, শেয়ার করতে হয় কেন? নিজের কথাটা যদি স্রেফ নিজের কথা হয়, চেঁচিয়েমেচিয়ে সাততলার ছাদ থেকেও তো বলা যায়। কিন্তু ফেসবুকে নিজের কথায় সব সময় অন্যের অনুভূতি জড়িয়ে থাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, নাইজেরিয়ার ধর্ষিত মেয়েটির ক্লিপ যারা ফেসবুকে প্রচার করেছে, অথবা উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তার বন্ধু যে ছবিটি ট্যাগ করেছে, তা কি অন্যের সাংঘাতিক ক্ষতি করবে বলে করেছে? উত্তর হচ্ছে, হয়তো না।
তবে কথা হচ্ছে, ফেসবুক না থাকলে হয়তো নাইজেরিয়ার ধর্ষিত মেয়েটির যন্ত্রণাটা কেবল তারই থাকত, কয়েক কোটি লোকের কাছে প্রদর্শনী হয়ে যাওয়ার লাঞ্ছনাটা তাকে সহ্য করতে হতো না। রামুর বৌদ্ধপল্লীতেও হয়তো হামলা হতো না। ফেসবুক যেমন অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে আমাদের, তেমনই 'ব্যক্তিগত'কে দলেপিষে মণ্ড বানিয়ে দিয়েছে। এ আসলে একটা পাঁচ বছরের ছেলের হাতে বন্দুক ধরিয়ে দেওয়ার মতোই। প্রাণ সব সময় হাতে। আমি তো ফেসবুকে নেই, আমি তো কারো সম্পর্কে কিছু বলিনি, আমি তো কারো খারাপ করিনি- এসব কোনো কারণ নয়। এসব যুক্তির একটাই উত্তর, তুমি দিনযাপন করছো ফেসবুক যুগে। অতএব 'তুমি' যখন-তখন উন্মোচিত হতে পার। ফেসবুকে 'ব্যক্তিগত'র আরেক নাম হলো 'উন্মোচিত'। জীবন এখানে খোলা পাতা। একেকটা ক্লিপে, একেকটা স্ট্যাটাসে হাজির সব দলিল-দস্তাবেজ। কিছু কারোই ব্যক্তিগত নয়। আমি, আপনি, উত্তম বড়ুয়া- সবাই ফেসবুকের কাছে 'ব্যক্তিগত' গচ্ছিত রেখেছি। আমার ব্যক্তিগত কখন, কার, কোন ইচ্ছার বশে 'সবার' হয়ে যাবে কেউ জানে না? আর তেমন কিছু ঘটতে পারে এ আশঙ্কায় বন্ধু, প্রেমিক, চাচা, দূরসম্পর্কের আত্মীয়- সবার সঙ্গে সম্পর্কছেদ করে যদি চিলেকোঠায় খিল দিয়ে বসে থাকতে হয়, সেটা তো জীবন নয়।
তাই বলছি- প্রেম, বন্ধুত্ব, শেয়ারিং, কেয়ারিং, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, কাদা ছোড়াছুড়ি, গালাগাল, সাম্প্রদায়িক হামলার আশঙ্কা- দেটস অল ইন দ্য ফেসবুক গেম। সব কিছুর জন্য তৈরি থাকতে হবে। ফেসবুকের নিয়ম-কানুনই এটা। উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ট্যাগ করা ছবির পরিপ্রেক্ষিতে বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ঘটনায় ফেসবুককে যাঁরা দোষারোপ করছেন, তাঁদের উদ্দেশে সব শেষে একটি কথা, 'ফুটবল খেলতে গিয়ে গোল দেওয়ার কৃতিত্ব নেবেন; কিন্তু খেলায় ফাউল হলে তার দায় নেবেন না, এমনটি কী করে সম্ভব?'
লেখক : গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত
shahnewazbiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.