রফতানি সম্প্রসারণে প্রয়োজন উদ্যোগ
বাংলাদেশের রফতানি খাত খুবই সীমিত। মাত্র কয়েকটি প্রাইমারি পণ্য আমরা রফতানি করে থাকি। শিল্প উৎপাদিত পণ্যের সংখ্যাও তেমন বেশি নয়। প্রাথমিক পণ্য তালিকায় রয়েছে ফ্রোজেন ফুড, চা, কৃষিজাতপণ্য, কাঁচা পাট ও
অন্যান্য। প্রাইমারি পণ্যসামগ্রী ২০০৮-০৯ সালে রফতানি হয় ৮৭.০১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৯-১০ সালে রফতানি হয় ১৬২০৪.৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১০-১১ সালে রফতানি হয় ২২৯২৪.৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১১-১২ সালে রফতানি হয় ১৭৮৮৬.০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। শিল্পে উৎপাদিত পণ্যসমূহের মধ্যে রয়েছে ওভেন গার্মেন্টস, নিটওয়ার, লেদার, পাটজাত দ্রব্য, সার ও কেমিক্যাল জাতীয় পণ্য, জুতা, সিরামিক, ওষুধ, প্রকৌশল শিল্প পণ্য, পেট্রোলিয়াম বাই প্রোডাক্ট, হস্তশিল্প পণ্য ও বিবিধ। সেবামূলক খাতে রয়েছে জনশক্তি রফতানি ও বিশেষজ্ঞ বিদেশে প্রেরণ প্রভৃতি। ২০০৮-২০০৯ সালে শিল্প পণ্য রফতানি হয় ১৪ হাজার ৬শ’ ৯৫ দশমিক শূন্য ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ মূল্য। ২০০৯-১০ সালে হয় ১৫৫১৭.১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১০-১১ সালে রফতানি হয় ২১৯৬৫.৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৮-০৯ সালে সর্বমোট রফতানি ১৫,৫৬৫.১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০০৯-১০ সালে ১৬২০৪.৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১০-১১ সালে ২২৯৯৪.৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আমাদের প্রধান প্রধান রফতানিকারক দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, জাপান এবং অন্য অল্প কিছুু দেশ। এছাড়া সার্কভুক্ত দেশসমূহে আমরা রফতানি করছি তা হচ্ছে আফগানিস্তান, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। আমাদের রফতানির পরিমাণ যেমন কম, তেমনি রফতানিকারক দেশের সংখ্যাও অনেক কম। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে আমাদের বিশাল ঘাটতি রয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করা বড়ই কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতি বছর এই বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের রফতানি বৃদ্ধি করা ছাড়া দেশকে উন্নত দেশে নিয়ে যাওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তাই বাণিজ্য তথা রফতানি বাণিজ্য বৃদ্ধির উপায় নিয়ে আজকের আলোচনা।
আমাদের রফতানির প্রধানতম বাধাসমূহ কি তা চিহ্নিত করতে হবে। এই বাধাসমূহ কিভাবে দূর করা যাবে, তার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের রফতানি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য প্রয়োজন শিল্প খাত ঠিক করা, শিল্প স্থাপনের জন্য স্থান নির্ধারণ করা ইত্যাদি। আর শিল্প কারখানার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা। বিগত ৭ বছর ধরে দেশে শিল্পায়ন প্রায় বন্ধ রয়েছে। দেশী বিদেশী বিনিয়োগ সন্তোষজনক নয়। ধুঁকে ধুঁকে বর্তমান স্থাপিত শিল্পকারখানাগুলো কোনক্রমে টিকে রয়েছে। তাই বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
বিদ্যুত আজ আমাদের জাতীয় সমস্যা। দেশে প্রতিদিন ১০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু শিল্প খাত নয়, সেবা খাত, শিক্ষা খাত, আবাসন খাত সকল খাতই বিদ্যুতের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম। দেশে বর্তমানে বিদ্যুত উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু এই মুহূর্তে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট। সরকার স্বল্পমেয়াদী ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেও তাতে তেমন কোন উন্নতি হয়নি। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাগুলোর তেমন অগ্রগতি নেই। তাই সরকারকে ৭টি বিভাগে ৫ হাজার মেগাওয়াট করে মোট ৩৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে। বিদ্যুতের স্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধান হলে দেশে শিল্পায়ন এগিয়ে যাবে। রফতানি বৃদ্ধি পাবে ও সম্প্রসারিত হবে।
বিদ্যুত সমস্যার পর সবচেয়ে বেশি আলোচিত সমস্যা হচ্ছে গ্যাস সমস্যা। গ্যাসের চাপের অভাবে হাজার হাজার শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে। উৎপাদন অনেক ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে। দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ২৫০ কোটি ঘনফুট কিন্তু গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে হলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পেট্রোবাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। দেশে কি পরিমাণ গ্যাস মজুদ রয়েছে তার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের কাছে নেই। প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে গ্যাসের ব্যাপারে নির্ভরতা কতটুকু করা হবে তা জাতিকে জানানো উচিত। যদি গ্যাসের সত্যিকার চিত্র পাওয়া যায় দেশে শিল্পায়ন করার জন্য শিল্প উদ্যোক্তাগণ প্রকৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারবে। তখনই দেশ সত্যিকার অর্থে রফতানিমুখী শিল্প স্থাপনে সুপরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারবে। বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা না করে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারকে অগ্রসর হওয়া উচিত।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ও সম্প্রসারণ খুবই জরুরী। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মাধ্যমে আমরা বিরাট সংখ্যক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। প্রয়োজন সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া।
রফতানি সম্প্রসারণের জন্য নতুন নতুন দেশে নতুন নতুন পণ্য রফতানির সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে দক্ষ জনশক্তি রফতানি করে আমরা দ্বিগুণ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারি। এর জন্য দেশে জনশক্তি দক্ষ করে তৈরি করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করে যে ফল পাব দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করে দ্বিগুণেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আমরা আয় করতে পারি। সরকারকে এই ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন আজ খুবই জরুরী। এই সব ট্রেনিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে এবং বিদেশে দক্ষ জনশক্তির বাজার সৃষ্টি হবে।
দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রফতানি বৃদ্ধি ও বেশি বেশি শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজন দেশী বিদেশী বিনিয়োগ। এর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য সরকার ও বিরোধী দলসমূহকে দেশের স্বার্থে সহনশীল হতে হবে। তবেই বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে রফতানি বৃদ্ধি পাবে।
রফতানি সম্প্রসারণের জন্য আমাদের ব্যাংকসমূহের নীতিমালার পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু লাভের জন্যই ব্যাংকিং এই ধারণার পরিবর্তন আনতে হবে। “দেশের অর্থ, বাণিজ্য, শিল্প কারখানার বিকাশের স্বার্থে ব্যাংকিং এই নীতিতে ব্যাংকসমূহকে পরিচালিত করতে হবে। ২০ শতাংশ হারে সুদ/লভ্যাংশ প্রদান করে কোন ব্যবসা হতে পারে না। রফতানি তো কখনও সম্ভব নয়। তাই ব্যাংকিং খাতের সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে।
তৈরি পোশাক শিল্প খাত ও আইটির জন্য আলাদা শিক্ষা অঞ্চল অবিলম্বে গড়ে তোলা দরকার। সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক ও আইটি খাতের সম্ভাবনা অনেক বেশি। জাপান, চীনের বাজার আমরা যদি ধরতে পারি তাহলে তৈরি পোশাক শিল্পে বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটবে। আইটির জন্য কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরাট বাজার আমাদের জন্য পড়ে রয়েছে। সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুততার সঙ্গে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আইটির জন্য অঞ্চল তৈরির ভূমি অধিকরণ করা হয়েছে অনেক আগে কিন্তু ভূমি সম্প্রসারণ করে আইটি শিল্প অঞ্চল গড়ার জন্য অবশিষ্ট অবকাঠামো তৈরির কাজ দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন। এতে রফতানি খাতের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। রফতানি আয় বৃদ্ধি করতে হলে দেশে শিল্প অঞ্চলের প্রয়োজন রয়েছে। নতুন নতুন শিল্প অঞ্চল তৈরি করা ছাড়া রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাবে না। তাই এই চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটিকে একটি দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্লানের আওতায় আনা প্রয়োজন।
এখন অপরিকল্পিতভাবে দেশে শিল্পায়ন হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে আবাসন এলাকা গড়ে উঠছে। পরিকল্পনার অভাবে খাদ্য উৎপাদনশীল জমিতে কোথাও আবাসন হচ্ছে, কোথাও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন হচ্ছে। সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী সুচিন্তিত পরিকল্পনায় পুরো দেশকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিতে হবে। দেশের কোন কোন স্থানে শিল্প অঞ্চল হবে, কোন কোন স্থানে আবাসন এলাকা হবে, কোন কোন স্থানে বনজ অঞ্চল হবে। কোন কোন স্থানে নদী, রাস্তা, জলাশয় থাকবে এইভাবে পরিকল্পিত ইন্টার্নশিপ, গ্রাম- অঞ্চল, শিল্প অঞ্চল গড়ে তোলার মাস্টার প্লান গ্রহণ করতে হবে। আমাদের একটি উন্নত জাতি হতে হলে দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্লান নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। রফতানি খাত বৃদ্ধির জন্য এই কাজটি খুব জরুরী। দুর্নীতিমুক্ত, উন্নত সভ্য ও সৎ জাতি গড়ার জন্য রফতানিমুখী শিল্প বিপ্লব ঘটাতে হবে। সেই সুন্দর জীবনের জন্য অপেক্ষা করছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম।
আবুল কাসেম হায়দার
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহ-সভাপতি এফবিসিসিআই
আমাদের প্রধান প্রধান রফতানিকারক দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, জাপান এবং অন্য অল্প কিছুু দেশ। এছাড়া সার্কভুক্ত দেশসমূহে আমরা রফতানি করছি তা হচ্ছে আফগানিস্তান, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। আমাদের রফতানির পরিমাণ যেমন কম, তেমনি রফতানিকারক দেশের সংখ্যাও অনেক কম। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে আমাদের বিশাল ঘাটতি রয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করা বড়ই কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতি বছর এই বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের রফতানি বৃদ্ধি করা ছাড়া দেশকে উন্নত দেশে নিয়ে যাওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তাই বাণিজ্য তথা রফতানি বাণিজ্য বৃদ্ধির উপায় নিয়ে আজকের আলোচনা।
আমাদের রফতানির প্রধানতম বাধাসমূহ কি তা চিহ্নিত করতে হবে। এই বাধাসমূহ কিভাবে দূর করা যাবে, তার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের রফতানি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য প্রয়োজন শিল্প খাত ঠিক করা, শিল্প স্থাপনের জন্য স্থান নির্ধারণ করা ইত্যাদি। আর শিল্প কারখানার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা। বিগত ৭ বছর ধরে দেশে শিল্পায়ন প্রায় বন্ধ রয়েছে। দেশী বিদেশী বিনিয়োগ সন্তোষজনক নয়। ধুঁকে ধুঁকে বর্তমান স্থাপিত শিল্পকারখানাগুলো কোনক্রমে টিকে রয়েছে। তাই বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
বিদ্যুত আজ আমাদের জাতীয় সমস্যা। দেশে প্রতিদিন ১০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু শিল্প খাত নয়, সেবা খাত, শিক্ষা খাত, আবাসন খাত সকল খাতই বিদ্যুতের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম। দেশে বর্তমানে বিদ্যুত উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু এই মুহূর্তে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট। সরকার স্বল্পমেয়াদী ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেও তাতে তেমন কোন উন্নতি হয়নি। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাগুলোর তেমন অগ্রগতি নেই। তাই সরকারকে ৭টি বিভাগে ৫ হাজার মেগাওয়াট করে মোট ৩৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে। বিদ্যুতের স্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধান হলে দেশে শিল্পায়ন এগিয়ে যাবে। রফতানি বৃদ্ধি পাবে ও সম্প্রসারিত হবে।
বিদ্যুত সমস্যার পর সবচেয়ে বেশি আলোচিত সমস্যা হচ্ছে গ্যাস সমস্যা। গ্যাসের চাপের অভাবে হাজার হাজার শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে। উৎপাদন অনেক ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে। দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ২৫০ কোটি ঘনফুট কিন্তু গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে হলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পেট্রোবাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। দেশে কি পরিমাণ গ্যাস মজুদ রয়েছে তার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের কাছে নেই। প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে গ্যাসের ব্যাপারে নির্ভরতা কতটুকু করা হবে তা জাতিকে জানানো উচিত। যদি গ্যাসের সত্যিকার চিত্র পাওয়া যায় দেশে শিল্পায়ন করার জন্য শিল্প উদ্যোক্তাগণ প্রকৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারবে। তখনই দেশ সত্যিকার অর্থে রফতানিমুখী শিল্প স্থাপনে সুপরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারবে। বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা না করে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারকে অগ্রসর হওয়া উচিত।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ও সম্প্রসারণ খুবই জরুরী। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মাধ্যমে আমরা বিরাট সংখ্যক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। প্রয়োজন সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া।
রফতানি সম্প্রসারণের জন্য নতুন নতুন দেশে নতুন নতুন পণ্য রফতানির সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে দক্ষ জনশক্তি রফতানি করে আমরা দ্বিগুণ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারি। এর জন্য দেশে জনশক্তি দক্ষ করে তৈরি করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করে যে ফল পাব দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করে দ্বিগুণেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আমরা আয় করতে পারি। সরকারকে এই ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন আজ খুবই জরুরী। এই সব ট্রেনিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে এবং বিদেশে দক্ষ জনশক্তির বাজার সৃষ্টি হবে।
দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রফতানি বৃদ্ধি ও বেশি বেশি শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজন দেশী বিদেশী বিনিয়োগ। এর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য সরকার ও বিরোধী দলসমূহকে দেশের স্বার্থে সহনশীল হতে হবে। তবেই বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে রফতানি বৃদ্ধি পাবে।
রফতানি সম্প্রসারণের জন্য আমাদের ব্যাংকসমূহের নীতিমালার পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু লাভের জন্যই ব্যাংকিং এই ধারণার পরিবর্তন আনতে হবে। “দেশের অর্থ, বাণিজ্য, শিল্প কারখানার বিকাশের স্বার্থে ব্যাংকিং এই নীতিতে ব্যাংকসমূহকে পরিচালিত করতে হবে। ২০ শতাংশ হারে সুদ/লভ্যাংশ প্রদান করে কোন ব্যবসা হতে পারে না। রফতানি তো কখনও সম্ভব নয়। তাই ব্যাংকিং খাতের সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে।
তৈরি পোশাক শিল্প খাত ও আইটির জন্য আলাদা শিক্ষা অঞ্চল অবিলম্বে গড়ে তোলা দরকার। সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক ও আইটি খাতের সম্ভাবনা অনেক বেশি। জাপান, চীনের বাজার আমরা যদি ধরতে পারি তাহলে তৈরি পোশাক শিল্পে বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটবে। আইটির জন্য কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরাট বাজার আমাদের জন্য পড়ে রয়েছে। সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুততার সঙ্গে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আইটির জন্য অঞ্চল তৈরির ভূমি অধিকরণ করা হয়েছে অনেক আগে কিন্তু ভূমি সম্প্রসারণ করে আইটি শিল্প অঞ্চল গড়ার জন্য অবশিষ্ট অবকাঠামো তৈরির কাজ দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন। এতে রফতানি খাতের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। রফতানি আয় বৃদ্ধি করতে হলে দেশে শিল্প অঞ্চলের প্রয়োজন রয়েছে। নতুন নতুন শিল্প অঞ্চল তৈরি করা ছাড়া রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাবে না। তাই এই চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটিকে একটি দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্লানের আওতায় আনা প্রয়োজন।
এখন অপরিকল্পিতভাবে দেশে শিল্পায়ন হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে আবাসন এলাকা গড়ে উঠছে। পরিকল্পনার অভাবে খাদ্য উৎপাদনশীল জমিতে কোথাও আবাসন হচ্ছে, কোথাও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন হচ্ছে। সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী সুচিন্তিত পরিকল্পনায় পুরো দেশকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিতে হবে। দেশের কোন কোন স্থানে শিল্প অঞ্চল হবে, কোন কোন স্থানে আবাসন এলাকা হবে, কোন কোন স্থানে বনজ অঞ্চল হবে। কোন কোন স্থানে নদী, রাস্তা, জলাশয় থাকবে এইভাবে পরিকল্পিত ইন্টার্নশিপ, গ্রাম- অঞ্চল, শিল্প অঞ্চল গড়ে তোলার মাস্টার প্লান গ্রহণ করতে হবে। আমাদের একটি উন্নত জাতি হতে হলে দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্লান নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। রফতানি খাত বৃদ্ধির জন্য এই কাজটি খুব জরুরী। দুর্নীতিমুক্ত, উন্নত সভ্য ও সৎ জাতি গড়ার জন্য রফতানিমুখী শিল্প বিপ্লব ঘটাতে হবে। সেই সুন্দর জীবনের জন্য অপেক্ষা করছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম।
আবুল কাসেম হায়দার
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহ-সভাপতি এফবিসিসিআই
No comments