অহিংসার মন্দিরে হিংসার আগুন by কামরুল হাসান
খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে কপিলাবস্তুর রাজপুত্র সিদ্ধার্থ ভোগবিলাসের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে জীবনের গভীরতর সত্যানুসন্ধানে সুন্দরী স্ত্রী, প্রাণপ্রিয় ছেলে, প্রমোদে পরিপূর্ণ রাজপ্রাসাদ এবং রাজা হওয়ার লোভ বিসর্জন দিয়ে গভীর অরণ্যে চলে গিয়েছিলেন। মানুষের দ্বারে দ্বারে অন্নভিক্ষা করে কঠিন জীবনধারণ করে তিনি খুঁজেছিলেন
জীবন-জিজ্ঞাসার জটিল উত্তর। বোধিবৃক্ষতলে ধ্যানে বসে জীবন, জগৎ, মৃত্যু, পরকাল প্রভৃতি বিষয়ের সত্য আবিষ্কার করে 'বুদ্ধ' বা বোধিপ্রাপ্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর সেই সত্যের আলোকে পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর শতকোটি মানুষ আলোকিত হয়ে উঠেছে। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর আড়াই হাজার বছর পার হয়ে গেছে, তাঁর অনুসারীরা আজও দীক্ষা নিচ্ছেন বুদ্ধের জ্ঞান ও উপলব্ধির আলোক থেকে। কত ঝলমলে রাজপুত্র, কত প্রতাবশালী সম্রাট কালের অতলে হারিয়ে গেছেন; কিন্তু মানবজাতিকে অমরালোকের দীক্ষা দিয়ে গৌতম বুদ্ধ টিকে আছেন, টিকে থাকবেন গ্রহটির শেষপ্রহর পর্যন্ত।
যিনি শিক্ষা দিয়ে গেছেন 'অহিংসাই পরম ধর্ম', 'সকল জীবে দয়া করো'। তাঁর অনুসারীদের শিকার হতে হলো এক উন্মত্ত হিংসার। কাণ্ডজ্ঞানহীন হিংসার আগুনে তাদের মন্দির ভাঙল, ঘরবাড়ি জ্বলল, লুট হলো সম্পদ; অহিংসার প্রতীক গৌতম বুদ্ধের মূর্তিও ভাঙচুর করল একদল দুর্বৃত্ত, মূর্খ উন্মাদ। রামু ও উখিয়ায় যা ঘটল তা কেবল একদল বোধশূন্য, অবিবেচক মানুষের কাণ্ড নয়, এর পেছনে রয়েছে গভীরতর ষড়যন্ত্র! সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ধূলিসাৎ করাও এর একটি অংশ। তবে এর ভেতরে রয়েছে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের সেই পুরনো লোভ, যা সাম্প্রতিককালে সাতক্ষীরায়ও আমরা দেখেছি, হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিতে পারলে তাদের ভিটে-মাটি, পুকুর-দীঘি, জমিজমা হস্তগত করা যাবে- এই হচ্ছে মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বিরোধী দুই শিবিরই সমান তৎপর। এ ছাড়া রয়েছে আগামী নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোটের হিসাব। সুতরাং এটি যে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অবমাননায় হঠাৎ খেপে ওঠা জিহাদি জনতার ধর্মযুদ্ধ নয়- সেটা বোঝা যায়। হামলাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত, গানপাউডার, কেরোসিন আর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা তো তা-ই প্রমাণ করে। সন্ধ্যারাতে উত্তেজনা প্রশমিত করে দেওয়ার পর মধ্যরাতে সংঘবদ্ধ হয়ে, ট্রাক ভাড়া করে সেই ট্রাকে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণকারীদের হামলা প্রমাণ করে, এটি পূর্বপরিকল্পিত।
আশ্চর্য যে অসাম্প্রদায়িক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন অবস্থায় এমনি একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল। সাম্প্রদায়িক উসকানির ও আক্রমণের এমন প্রলয়ঙ্করী নিন্দাজনক ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর ঘটেনি। এর মাত্রা ছিল ভয়াবহ। পরদিন উখিয়ায় দিনদুপুরে বিভিন্ন প্যাগোডা ও বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছে। পটিয়ায় একটি জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের জঙ্গিবাদী শ্রমিকরা বৌদ্ধ প্যাগোডায় ভাঙচুর চালায়। রামুতে মধ্যরাতে যখন ওই তাণ্ডব চলছিল, তখন স্থানীয় দারোগা ঘুমাচ্ছিলেন, তিনি চার ঘণ্টা ফোন ধরেননি। ঘুমাচ্ছিলেন রামু থানার টিএনও। নিকটবর্তী কক্সবাজার থেকে তিন ঘণ্টায়ও এসে পৌঁছায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য কোনো দল। অর্থাৎ পুরো প্রশাসনই ঘুমাচ্ছিল। শত শত লোক হৈচৈ করে, আগুন জ্বালিয়ে ভাঙচুর করে কয়েক ঘণ্টা ধরে লুটপাট করল আর উনারা টেরই পেলেন না। পেলেও এগিয়ে এলেন না। আজকের মোবাইল ফোনের জমানায় খবর পাঠানো যায় মুহূর্তেই। সুতরাং এটা যে ইচ্ছাকৃত অবহেলা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর দায় কি সরকার ও আওয়ামী লীগ এড়াতে পারবে?
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের ওই অঞ্চলটি শিক্ষা-দীক্ষায় যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে আছে, সেখানে বিদ্যালয়ের চেয়ে মাদ্রাসার সংখ্যা বেশি। বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনে তারা জামায়াত-বিএনপির প্রতিনিধি পাঠিয়েছে সংসদে। সুতরাং বিচিত্র নয় যে মৌলবাদী সংগঠনগুলো অন্ধবিশ্বাসে পরিপূর্ণ লোকালয়টিকে তাদের অভয়ারণ্য বানিয়েছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো সেখানে এসে ঠাঁই নিয়েছে মিয়ানমার থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মিয়ানমারের বৌদ্ধরা এই সংখ্যালঘু মুসলমানদের সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক আচরণ করেনি, তাদের আক্রমণ করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে; প্রাণ বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে এসে ঠাঁই নিয়েছে। সংগত কারণেই বৌদ্ধদের প্রতি এই রোহিঙ্গাদের একটি আক্রোশ রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বসবাসরত বৌদ্ধরা কী দোষ করল? বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে তার প্রতিশোধ নিতে ভারতের হিন্দুরা যদি সে দেশে বসবাসরত মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালায়, তা যেমন যুক্তিসিদ্ধ হবে না, হবে গর্হিত অন্যায়- এটাও তেমনি অপরাধ। অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা ইসলামের একটি আদর্শ। 'তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার'- এই শিক্ষা ইসলামের।
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন স্তিমিত হতেই গোটা বিশ্বে মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটে। সামনে না এগিয়ে পৃথিবী ও তার সভ্যতা যেন পেছনে ছুটল। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন পরাস্ত করতে বিশ্বব্যাপী এই উত্থান ঘটিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। দুনিয়াকে পায়ের নিচে রাখার নব্য সাম্রাজ্যবাদী পাঁয়তারায় তারা প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছিল আল-কায়েদা নেতা বিন লাদেনকে। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ লুট এবং কমিউনিস্ট রাশিয়া ও চীনকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে আমেরিকা ইরাকে সাদ্দাম হোসেন, সৌদি আরবে রাজপরিবার, সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদ, মিসরে হোসনি মুবারক, জর্দানে বাদশাহ হোসেন, ইরানে রেজা শাহ পাহলভী প্রভৃতি সরকারকে ক্ষমতারোহণে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছিল। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকার বিতাড়নের জন্য তৈরি করেছিল প্রথমে মুজাহিদীন এবং পরবর্তী সময়ে গৃহযুদ্ধের পরিণতিতে গড়ে তোলা হলো তালেবান বাহিনী। ইতিহাসের ট্র্যাজেডি- সেই আমেরিকার হাতে পতন ঘটল সাদ্দাম হোসেনের, মৃত্যু ঘটল ওসামা বিন লাদেনের। এখন সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদকে উৎখাতের জন্য বিদ্রোহীদের মদদ দিচ্ছে, যেমন তারা দিয়েছিল স্বাধীনচেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে। ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল পাহলভী সরকার। এখন প্রতিবাদী বা মার্কিনি প্রভুত্ব মানতে অস্বীকার করা আহমাদিনেজাদের নেতৃত্বে গড়া ইরান সরকারের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে।
আজ মহানবী ও ইসলামকে অপমান করার একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে চলছে, তা তো দিবালোকের মতো পরিষ্কার। Innocence of Islam নামের কুরুচিপূর্ণ ছবিটি ছিল সর্বশেষ ষড়যন্ত্র। অন্য ধর্মের উসকানিদাতারা বুঝে গেছে, মুসলমানরা এসব ব্যাপারে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর। ওই ছবির উসকানিতে সারা মুসলিম দুনিয়ায় প্রতিবাদ বিক্ষোভের যে ঢেউ উঠেছিল, সেটাই এর প্রমাণ। সমস্যা হলো, মূল ষড়যন্ত্রকারী বা উসকানিদাতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে; কিন্তু প্রতিবাদের আগুনে পুড়ে যায় কিছু নিরপরাধ প্রাণ, যারা ওই উসকানির সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বারবার এটাই আমরা দেখছি। রামু ও উখিয়ার ওই একই ব্যাপার। এখানে যুক্তি বা অভিযোগটি আরো 'খোঁড়া'। আমরা কেন এত বেশি স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছি, সেটাও একটি জিজ্ঞাসা!
অন্যদিকে বিরোধী নেত্রী বলেছেন রামুর ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলটির সম্পৃক্ততার কথা। তিনি নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছেন। এ ঘটনায় মর্মাহত দেশবাসীর দাবিও সেটাই। তবে বাংলাদেশে তদন্তের পরিণাম ও ফলাফল কী হয়- সেটা জেনে কেউ আর উৎসাহিত হতে পারছেন না। দায়িত্বে চরম এবং ইচ্ছাকৃত অবহেলা করা রামুর দারোগাকে 'শাস্তি' হিসেবে রামু থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অপরাধ এবং দায়িত্বে চরম অবহেলা করেও আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে পার পেয়ে যান, তাতে এসব 'প্রত্যাহার' বা 'বদলি' বা 'সাময়িক বরখাস্ত'কে তারা হাঁসের পালকে লাগা পানির মতো ঝেড়ে ফেলে; কাগজে-কলমে আইনের লোক হয়ে কাঁচকলা দেখায় আইনকেই। মানুষ বা তাদের দুর্দশা লাঘব নয়, রাজনৈতিক দলগুলো মেতে আছে পারস্পরিক অভিযোগ আর ভুক্তভোগীদের জন্য লোকদেখানো 'মায়াকান্নায়'। যারা বৌদ্ধ প্যাগোডাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তারাই এখন 'সহমর্মী', প্যাগোডা ও বাড়িঘর পুনর্নির্মাণের 'কারিগর'। Irony আর কাকে বলে? আতঙ্কে ভোগা সংখ্যালঘুরা ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না, তাদের অনেককে অভিযোগ না জানানোর জন্য মোবাইলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারীরা অসংখ্য ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে নিজেদের জড়িয়েছে, আট বছরব্যাপী শিয়া অধ্যুষিত ইরানের সঙ্গে সুনি্নপ্রধান ইরাকের যুদ্ধ ছিল এমনই একটি ভ্রাতৃঘাতী ও নির্বোধ যুদ্ধ। আজও ইরাক ও আফগানিস্তানে প্রায় প্রতিদিন আত্মঘাতী বোমা মেরে নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করছে মুসলমানরাই। সব ধর্মেই পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা থাকলেও ধর্মের অতিউৎসাহী অনুসারীরা অন্য ধর্মানুসারীদের নগ্নভাবে আক্রমণ করেছে, হত্যা করেছে নৃশংস আনন্দে।
রামু ও উখিয়ার ঘটনা বহির্বিশ্বে আমাদের ইমেজ কেবল নষ্ট করেনি, অর্থনীতিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে। কেননা রামু ও উখিয়ার ওই নির্বোধ জনতা জানে না, বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো বন্ধু জাপান ও চীনের মতো দেশ, যাদের জনগণের সংখ্যাগুরু অংশটি বৌদ্ধ মতাবলম্বী। রামুর ওই অবিবেচক জনতাকে যারা উসকে দিয়েছিল, তারা হয়তো এটাই চায়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভাবমূর্তি খসে পড়ুক, বিশ্বে একাকী হয়ে পড়ুক বাংলাদেশ। এ ঘটনাকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই, এর সঠিক বিচার না হলে কেবল ক্ষমতাসীন সরকার বা দল নয়, ভুগতে হবে এ দেশের সব মানুষকেই, যারা মূলত অসাম্প্রদায়িক, যারা এই ঘৃণ্য ঘটনার প্রতিবাদে দেশব্যাপী সোচ্চার!
লেখক : ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের শিক্ষক
যিনি শিক্ষা দিয়ে গেছেন 'অহিংসাই পরম ধর্ম', 'সকল জীবে দয়া করো'। তাঁর অনুসারীদের শিকার হতে হলো এক উন্মত্ত হিংসার। কাণ্ডজ্ঞানহীন হিংসার আগুনে তাদের মন্দির ভাঙল, ঘরবাড়ি জ্বলল, লুট হলো সম্পদ; অহিংসার প্রতীক গৌতম বুদ্ধের মূর্তিও ভাঙচুর করল একদল দুর্বৃত্ত, মূর্খ উন্মাদ। রামু ও উখিয়ায় যা ঘটল তা কেবল একদল বোধশূন্য, অবিবেচক মানুষের কাণ্ড নয়, এর পেছনে রয়েছে গভীরতর ষড়যন্ত্র! সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ধূলিসাৎ করাও এর একটি অংশ। তবে এর ভেতরে রয়েছে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের সেই পুরনো লোভ, যা সাম্প্রতিককালে সাতক্ষীরায়ও আমরা দেখেছি, হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিতে পারলে তাদের ভিটে-মাটি, পুকুর-দীঘি, জমিজমা হস্তগত করা যাবে- এই হচ্ছে মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বিরোধী দুই শিবিরই সমান তৎপর। এ ছাড়া রয়েছে আগামী নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোটের হিসাব। সুতরাং এটি যে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অবমাননায় হঠাৎ খেপে ওঠা জিহাদি জনতার ধর্মযুদ্ধ নয়- সেটা বোঝা যায়। হামলাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত, গানপাউডার, কেরোসিন আর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা তো তা-ই প্রমাণ করে। সন্ধ্যারাতে উত্তেজনা প্রশমিত করে দেওয়ার পর মধ্যরাতে সংঘবদ্ধ হয়ে, ট্রাক ভাড়া করে সেই ট্রাকে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণকারীদের হামলা প্রমাণ করে, এটি পূর্বপরিকল্পিত।
আশ্চর্য যে অসাম্প্রদায়িক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন অবস্থায় এমনি একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল। সাম্প্রদায়িক উসকানির ও আক্রমণের এমন প্রলয়ঙ্করী নিন্দাজনক ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর ঘটেনি। এর মাত্রা ছিল ভয়াবহ। পরদিন উখিয়ায় দিনদুপুরে বিভিন্ন প্যাগোডা ও বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছে। পটিয়ায় একটি জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের জঙ্গিবাদী শ্রমিকরা বৌদ্ধ প্যাগোডায় ভাঙচুর চালায়। রামুতে মধ্যরাতে যখন ওই তাণ্ডব চলছিল, তখন স্থানীয় দারোগা ঘুমাচ্ছিলেন, তিনি চার ঘণ্টা ফোন ধরেননি। ঘুমাচ্ছিলেন রামু থানার টিএনও। নিকটবর্তী কক্সবাজার থেকে তিন ঘণ্টায়ও এসে পৌঁছায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য কোনো দল। অর্থাৎ পুরো প্রশাসনই ঘুমাচ্ছিল। শত শত লোক হৈচৈ করে, আগুন জ্বালিয়ে ভাঙচুর করে কয়েক ঘণ্টা ধরে লুটপাট করল আর উনারা টেরই পেলেন না। পেলেও এগিয়ে এলেন না। আজকের মোবাইল ফোনের জমানায় খবর পাঠানো যায় মুহূর্তেই। সুতরাং এটা যে ইচ্ছাকৃত অবহেলা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর দায় কি সরকার ও আওয়ামী লীগ এড়াতে পারবে?
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের ওই অঞ্চলটি শিক্ষা-দীক্ষায় যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে আছে, সেখানে বিদ্যালয়ের চেয়ে মাদ্রাসার সংখ্যা বেশি। বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনে তারা জামায়াত-বিএনপির প্রতিনিধি পাঠিয়েছে সংসদে। সুতরাং বিচিত্র নয় যে মৌলবাদী সংগঠনগুলো অন্ধবিশ্বাসে পরিপূর্ণ লোকালয়টিকে তাদের অভয়ারণ্য বানিয়েছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো সেখানে এসে ঠাঁই নিয়েছে মিয়ানমার থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মিয়ানমারের বৌদ্ধরা এই সংখ্যালঘু মুসলমানদের সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক আচরণ করেনি, তাদের আক্রমণ করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে; প্রাণ বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে এসে ঠাঁই নিয়েছে। সংগত কারণেই বৌদ্ধদের প্রতি এই রোহিঙ্গাদের একটি আক্রোশ রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বসবাসরত বৌদ্ধরা কী দোষ করল? বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে তার প্রতিশোধ নিতে ভারতের হিন্দুরা যদি সে দেশে বসবাসরত মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালায়, তা যেমন যুক্তিসিদ্ধ হবে না, হবে গর্হিত অন্যায়- এটাও তেমনি অপরাধ। অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা ইসলামের একটি আদর্শ। 'তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার'- এই শিক্ষা ইসলামের।
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন স্তিমিত হতেই গোটা বিশ্বে মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটে। সামনে না এগিয়ে পৃথিবী ও তার সভ্যতা যেন পেছনে ছুটল। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন পরাস্ত করতে বিশ্বব্যাপী এই উত্থান ঘটিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। দুনিয়াকে পায়ের নিচে রাখার নব্য সাম্রাজ্যবাদী পাঁয়তারায় তারা প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছিল আল-কায়েদা নেতা বিন লাদেনকে। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ লুট এবং কমিউনিস্ট রাশিয়া ও চীনকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে আমেরিকা ইরাকে সাদ্দাম হোসেন, সৌদি আরবে রাজপরিবার, সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদ, মিসরে হোসনি মুবারক, জর্দানে বাদশাহ হোসেন, ইরানে রেজা শাহ পাহলভী প্রভৃতি সরকারকে ক্ষমতারোহণে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছিল। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকার বিতাড়নের জন্য তৈরি করেছিল প্রথমে মুজাহিদীন এবং পরবর্তী সময়ে গৃহযুদ্ধের পরিণতিতে গড়ে তোলা হলো তালেবান বাহিনী। ইতিহাসের ট্র্যাজেডি- সেই আমেরিকার হাতে পতন ঘটল সাদ্দাম হোসেনের, মৃত্যু ঘটল ওসামা বিন লাদেনের। এখন সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদকে উৎখাতের জন্য বিদ্রোহীদের মদদ দিচ্ছে, যেমন তারা দিয়েছিল স্বাধীনচেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে। ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল পাহলভী সরকার। এখন প্রতিবাদী বা মার্কিনি প্রভুত্ব মানতে অস্বীকার করা আহমাদিনেজাদের নেতৃত্বে গড়া ইরান সরকারের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে।
আজ মহানবী ও ইসলামকে অপমান করার একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে চলছে, তা তো দিবালোকের মতো পরিষ্কার। Innocence of Islam নামের কুরুচিপূর্ণ ছবিটি ছিল সর্বশেষ ষড়যন্ত্র। অন্য ধর্মের উসকানিদাতারা বুঝে গেছে, মুসলমানরা এসব ব্যাপারে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর। ওই ছবির উসকানিতে সারা মুসলিম দুনিয়ায় প্রতিবাদ বিক্ষোভের যে ঢেউ উঠেছিল, সেটাই এর প্রমাণ। সমস্যা হলো, মূল ষড়যন্ত্রকারী বা উসকানিদাতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে; কিন্তু প্রতিবাদের আগুনে পুড়ে যায় কিছু নিরপরাধ প্রাণ, যারা ওই উসকানির সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বারবার এটাই আমরা দেখছি। রামু ও উখিয়ার ওই একই ব্যাপার। এখানে যুক্তি বা অভিযোগটি আরো 'খোঁড়া'। আমরা কেন এত বেশি স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছি, সেটাও একটি জিজ্ঞাসা!
অন্যদিকে বিরোধী নেত্রী বলেছেন রামুর ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলটির সম্পৃক্ততার কথা। তিনি নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছেন। এ ঘটনায় মর্মাহত দেশবাসীর দাবিও সেটাই। তবে বাংলাদেশে তদন্তের পরিণাম ও ফলাফল কী হয়- সেটা জেনে কেউ আর উৎসাহিত হতে পারছেন না। দায়িত্বে চরম এবং ইচ্ছাকৃত অবহেলা করা রামুর দারোগাকে 'শাস্তি' হিসেবে রামু থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অপরাধ এবং দায়িত্বে চরম অবহেলা করেও আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে পার পেয়ে যান, তাতে এসব 'প্রত্যাহার' বা 'বদলি' বা 'সাময়িক বরখাস্ত'কে তারা হাঁসের পালকে লাগা পানির মতো ঝেড়ে ফেলে; কাগজে-কলমে আইনের লোক হয়ে কাঁচকলা দেখায় আইনকেই। মানুষ বা তাদের দুর্দশা লাঘব নয়, রাজনৈতিক দলগুলো মেতে আছে পারস্পরিক অভিযোগ আর ভুক্তভোগীদের জন্য লোকদেখানো 'মায়াকান্নায়'। যারা বৌদ্ধ প্যাগোডাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তারাই এখন 'সহমর্মী', প্যাগোডা ও বাড়িঘর পুনর্নির্মাণের 'কারিগর'। Irony আর কাকে বলে? আতঙ্কে ভোগা সংখ্যালঘুরা ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না, তাদের অনেককে অভিযোগ না জানানোর জন্য মোবাইলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারীরা অসংখ্য ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে নিজেদের জড়িয়েছে, আট বছরব্যাপী শিয়া অধ্যুষিত ইরানের সঙ্গে সুনি্নপ্রধান ইরাকের যুদ্ধ ছিল এমনই একটি ভ্রাতৃঘাতী ও নির্বোধ যুদ্ধ। আজও ইরাক ও আফগানিস্তানে প্রায় প্রতিদিন আত্মঘাতী বোমা মেরে নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করছে মুসলমানরাই। সব ধর্মেই পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা থাকলেও ধর্মের অতিউৎসাহী অনুসারীরা অন্য ধর্মানুসারীদের নগ্নভাবে আক্রমণ করেছে, হত্যা করেছে নৃশংস আনন্দে।
রামু ও উখিয়ার ঘটনা বহির্বিশ্বে আমাদের ইমেজ কেবল নষ্ট করেনি, অর্থনীতিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে। কেননা রামু ও উখিয়ার ওই নির্বোধ জনতা জানে না, বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো বন্ধু জাপান ও চীনের মতো দেশ, যাদের জনগণের সংখ্যাগুরু অংশটি বৌদ্ধ মতাবলম্বী। রামুর ওই অবিবেচক জনতাকে যারা উসকে দিয়েছিল, তারা হয়তো এটাই চায়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভাবমূর্তি খসে পড়ুক, বিশ্বে একাকী হয়ে পড়ুক বাংলাদেশ। এ ঘটনাকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই, এর সঠিক বিচার না হলে কেবল ক্ষমতাসীন সরকার বা দল নয়, ভুগতে হবে এ দেশের সব মানুষকেই, যারা মূলত অসাম্প্রদায়িক, যারা এই ঘৃণ্য ঘটনার প্রতিবাদে দেশব্যাপী সোচ্চার!
লেখক : ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের শিক্ষক
No comments