প্রধানমন্ত্রীর রামু সফর- যেসব জিজ্ঞাসার উত্তর প্রয়োজন by মশিউল আলম

রামুসহ কক্সবাজার জেলার তিনটি উপজেলায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ও বসতভিটার ওপর বর্বর আক্রমণের নয় দিন পর গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামু সফর করলেন। ঘটনার পর পরই সংবাদ সংগ্রহের কাজে রামু-উখিয়া অঞ্চলে অবস্থানকালে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে অনুভব করেছি, তাঁদের সান্ত্বনা,


আশ্বাস, অভয় দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের রামু যাওয়া প্রয়োজন। ঘটনার সময় প্রধানমন্ত্রী বিদেশে ছিলেন, নইলে সম্ভবত আরও আগেই রামু সফরে যেতেন। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া, যিনি নিজেও একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দেশেই ছিলেন। তিনি রামু যাননি। অবশ্য তাঁর দলের কয়েকজন নেতা গিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর রামু সফর সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গিয়ে প্রথমেই যে বিষয়টি লক্ষ করলাম তা হলো, প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। রামু অঞ্চলে বৌদ্ধ ভিক্ষু বাস করেন কয়েক হাজার; কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় এসেছিলেন মাত্র ৩০-৪০ জন। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধারণ উপস্থিতিও ছিল প্রত্যাশার তুলনায় বেশ কম। যাঁরা উপস্থিত হয়েছিলেন, জনসভার আয়োজকেরা তাঁদের কাউকেই মঞ্চে উঠে বক্তব্য প্রকাশের আহ্বান জানাননি। মঞ্চে সেদিন সকাল ১০টা থেকে ১১টা একের পর এক বক্তৃতা করেছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। অথচ যাঁদের ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীর সফর ও জনসভার আয়োজন, সেই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কিছু বলার সুযোগ রাখা হয়নি। বৌদ্ধদের মধ্য থেকে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেছেন মাত্র একজন: রামুর কেন্দ্রীয় সীমা বৌদ্ধবিহারের পরিচালক সত্যপ্রিয় মহাথেরো, তাও প্রধানমন্ত্রী তাঁকে কিছু বলতে বলার পরে। সত্যপ্রিয় মহাথেরোর বক্তব্য ছিল সামান্যই: ‘এই তাণ্ডবলীলায় আমরা হতবাক। কিছু বলার ভাষা নেই।’
আক্রান্ত বৌদ্ধদের এই হতবাক দশাই সবচেয়ে প্রকটভাবে চোখে পড়েছে আমাদের। গভীর বেদনা থেকে উৎসারিত কান্না আর নির্বাক চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তি তাঁদের চোখেমুখে দেখতে পাইনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামুতে গিয়ে তা কি দেখতে পেয়েছেন? তিনি কি তাঁদের কথা শুনতে চেয়েছেন? তিনি কি জানতে পেরেছেন ২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার রাতে রামুতে যাঁরা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উত্তেজনা ছড়িয়েছিলেন, রাত ১২টা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত যাঁরা বৌদ্ধদের উপাসনালয়গুলো ও ঘরবাড়ির ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন, তাঁদেরও কেউ কেউ তাঁর জনসভায় উপস্থিত ছিলেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখের সামনেই এখন তাঁরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন অনেক নিরীহ মানুষ, যাঁরা সেই রাতের ধ্বংসযজ্ঞের ধারেকাছেও ছিলেন না।
ঘটনার পর থেকেই যখন সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পরকে দোষারোপ করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে শুরু করে, তখন আক্রান্ত বৌদ্ধদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়। তাঁরা আমাদের বলেছেন, এই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক বাগিবতণ্ডা চলুক তাঁরা তা চান না। তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে যে বক্তৃতা করেন, রামুতে আমরা তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেছি। বৌদ্ধরা আমাদের বলেছেন, স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ রকম বক্তব্য দিলে ঘটনা ভিন্ন খাতে চলে যাবে, সঠিক বিচার হবে না, প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীও রামু সফরে গিয়ে সরকারের একই অবস্থান তুলে ধরলেন। তিনি বরং আরও স্পষ্ট করে স্থানীয় বিএনপিদলীয় সাংসদের নাম উল্লেখ করে বললেন, তাঁর
উসকানি-ইন্ধনেই বৌদ্ধদের ওপর হামলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী যদি আক্রান্ত বৌদ্ধদের কাছে জানতে চাইতেন, তা হলে এই তথ্যও পেতেন যে শুধু বিএনপির স্থানীয় সাংসদই শনিবার রাতে রামুতে উত্তেজনা ছড়াননি, ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ-সংগঠনগুলোর কিছু নেতা-কর্মীও একই কাজ করেছেন। রামুর আওয়ামী লীগ নেতারা সোমবার প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাউকে মঞ্চে উঠে কিছু বলার সুযোগ যে দেননি, তার কারণ কী ছিল? বৌদ্ধদের তো প্রত্যাশা ছিল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে তাঁরা একের পর এক মনের কথাগুলো বলবেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনবেন। কিন্তু তেমন সুযোগ তাঁদের দেওয়া হলো না কেন?
প্রধানমন্ত্রী সেদিন রামুর আক্রান্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষগুলোকে বলেছেন, ‘কারা এটা করল, আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি।’ কী সূত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘অনেক তথ্য’ পেয়েছেন আমরা জানি না। আমাদের জানতে ইচ্ছা করে, সেই সূত্রগুলো কি তাঁকে জানিয়েছে যে শনিবার রাত আটটা থেকে রামুতে যখন উত্তেজনা শুরু হয়, তারপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সময় পেয়েছিল দীর্ঘ চার ঘণ্টা? এই চার ঘণ্টা তারা কী করেছে যে রাত ১২টার পর থেকে বৌদ্ধবিহারগুলোতে আগুন জ্বলা শুরু হতে পারল? তারপর রাত ১২টা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত একের পর এক বৌদ্ধবিহারগুলোতে হামলা চলেছে: অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাট চলেছে দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে। এটা কী করে সম্ভব হলো? আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা বলে কি রামুতে কিছুই ছিল না?
সন্ধ্যার পর থেকে রামুতে বিদ্বেষপূর্ণ স্লোগানসহ মিছিল শুরু হলে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কেউ কেউ থানা-পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তা দেওয়া দূরে থাক, আমাদের কাছে অনেকে একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন, থানার ওসিসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আক্রমণকারীদের উসকে দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কি জানানো হয়েছে যে শনিবার রাতে রামুর থানা-পুলিশ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণকারীদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে?
রামু থেকে মাত্র ১০-১২ কিলোমিটার দূরে নাইক্ষ্যংছড়িতে আছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একটি ব্যাটালিয়ন। ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজারেও আছে আরেকটি ব্যাটালিয়ন। তা ছাড়া সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন আছে রামুর অদূরে। পুলিশ বাদে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি সশস্ত্র সৈনিক ও জওয়ান আশপাশে থাকার পরও দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর এই ধ্বংসযজ্ঞ কী করে ঘটতে পেরেছে? সব সশস্ত্র বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল কে? রামু অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল কীভাবে?
গত ২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার রাতভর রামুতে এই ধ্বংসযজ্ঞ ঘটার পরদিন রোববার দুপুর থেকে উখিয়া ও টেকনাফ অঞ্চলেও উত্তেজনা ছড়ানো হয়। সন্ধ্যার পর এ দুটি উপজেলায়ও বৌদ্ধদের মন্দির ও ঘরবাড়ির ওপরে হামলা চলে। এটা কী করে সম্ভব হলো? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ কেন আগের রাতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ব্যর্থ হলো? এই ব্যর্থতার কারণ তাদের অক্ষমতা, নাকি ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা?
সরকারের নেতারা বলে আসছেন, বৌদ্ধদের ওপর হামলার ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে আমাদেরও মনে হয়েছে, পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া অমন দ্রুত অত লোকজন সংগঠিত করে হামলা চালানো সম্ভব ছিল না। তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে, অশুভ শক্তি (সরকারের ভাষায় বিএনপি-জামায়াত সাম্প্রদায়িক শক্তি) আগে থেকে পরিকল্পনা করে সুসংগঠিত উপায়ে মানবতার বিরুদ্ধে এই বিরাট অপরাধ সংঘটিত করে গেল, কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছুই টের পেল না, সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীগুলো কিছুই করতে পারল না—কেন? কী কারণ? কী রহস্য?
আরও কিছু জিজ্ঞাসা আছে। ফেসবুকের কথিত ছবিটি কেন এক বৌদ্ধ তরুণের অ্যাকাউন্টেই ট্যাগ করা হয়েছিল? ইউরোপ-আমেরিকায় ইসলামের জন্য অবমাননামূলক কার্টুন, চলচ্চিত্র ইত্যাদি প্রচার করে যারা মুসলমানদের মাঝে-মাঝেই খেপিয়ে তুলছে, তাদের কেউ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বলে খবর পাওয়া যায়নি। তা হলে বাংলাদেশে কেন ক্ষুদ্র ও নিরীহ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একজন সদস্যকে বলির পাঁঠা হিসেবে বেছে নেওয়া হলো? এবং কেন রামু থেকে? আর কেনই বা এই সময়ে—আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার মাস তিনেক পরে?
পুনশ্চ: ৮ অক্টোবর এই পাতায় ‘রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধদের অভিন্ন নিয়তি’ শিরোনামে আমার লেখার শেষ বাক্য ছিল, ‘আরাকানে রোহিঙ্গারা আবার আক্রান্ত হলে বাংলাদেশে বৌদ্ধরা যে আবার আক্রান্ত হবেন না—এমন নিশ্চয়তা আজ কে দিতে পারে?’ বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন পাঠক এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আমাকে ই-মেইল পাঠিয়েছেন। তাঁদের কারোর মনে হয়েছে, আমার এই বক্তব্যে উসকানি আছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা বৌদ্ধদের দ্বারা আক্রান্ত হলে বাংলাদেশে বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের দ্বারা আক্রান্ত হবেন—এটা আমার প্রত্যাশা। কারোর মনে হয়েছে, আমি আক্রমণকারী রোহিঙ্গাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছি।
আসলে তা নয়। বাংলাদেশে সব সম্প্রদায়ের মানুষ নিরাপদে জীবন যাপন ও স্বাধীনভাবে ধর্মপালনের সমান অধিকারী। মিয়ানমারে বা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে যা-ই ঘটুক না কেন, সে জন্য বাংলাদেশে কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রান্ত হবেন না—এটা আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার নিশ্চিত করবে। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা বিতর্কের অবকাশ নেই। রামু-উখিয়ায় বৌদ্ধদের ওপর হামলায় রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ ছিল—এ রকম দাবি প্রত্যক্ষদর্শীরা করেছেন। সরকারও তাই বলছে। তাদের সংশ্লিষ্টতার আরও কিছু আলামত আমরা পেয়েছি। এসব লক্ষ করেই ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমি আশঙ্কা ব্যক্ত করেছি। এবং তা করেছি মিয়ানমারের শান্তিবাদী নেত্রী নোবেলবিজয়ী অং সান সু চি ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভকারী বৌদ্ধ পুরোহিতদের উদ্দেশ করে। চেয়েছি, তাঁরা যেন নিজ দেশের রোহিঙ্গা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.