চারদিক- ‘কষ্ট করতে আর কষ্ট লাগে না’ by সুচিত্রা সরকার

মুচমুচে টাটকা একটা গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা দিল। গন্ধটাকে অনুসরণ করে এগোতেই চোখে পড়ল ললিত মোহন দাস লেনের বাকরখানির দোকানটা। দোকানের সামনে রাখা একটা পাত্রে ঘিয়ে রঙের বাকরখানির ছোট্ট পাহাড়। সবে চুলা থেকে নামানো হয়েছে।


আগুন-কয়লার গুহার মতো একটা তন্দুরি চুলা। তার পাশেই বসে আছেন সিদ্দিক আলী। বয়স ৩৮। হাতে বাঁকানো একটা রড। এটা দিয়েই চুলা থেকে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা বাকরখানি তোলা হচ্ছে। দোকানের ভেতরে ঢুকি। দোকানটা বেশ ছোট। কবির সুমনের ‘দশ ফুট বাই দশ ফুট’ গানের মতোই তার আকার। চলাচলের জন্য সরু একটা রাস্তা রেখে ঘরের বাকিটায় ছোট্ট একটা চৌকি। তার ওপরই চলছে ময়দা ময়ানো, রুটি বানানো। চৌকির সামনের দিকে তন্দুরি চুলা।
সিদ্দিক আলী চুলার পাশ থেকে উঠে আসেন।
প্রশ্ন করি, বাড়ি কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলেন না সিদ্দিক আলী। চৌকির ওপর ঝোলানো দড়ি থেকে একটা তেল চিটচিটে গামছা টেনে নেন। সেটা দিয়ে একটানে মুখের সবটা ঘাম মুছে ফেলেন। তারপর শুরু করেন।
‘বাড়ি হবিগঞ্জের জিরমট্টায়। ঢাকায় আসছি ২০ বছর আগে। বড় ভাই নিয়ে আসছিল। সে-ই আমারে এই কাজ শিখাইছে। আগে অন্য জায়গায় ছিলাম। কয়দিন হইল এইখানে দোকান দিছি।’
কাজ শুরু করেন কখন থেকে?
কথা বলতে বলতেই ময়দার তাল ময়ান করতে শুরু করেন। একটুও না থেমে জবাব দেন, ‘এই ধরেন ভোর পাঁচটা। তারপর একটানা বেলা একটা পর্যন্ত বানাই। তারপর আবার সন্ধ্যা থাইক্যা রাত ১০টা পর্যন্ত চলে।’
প্রতিদিন কতগুলো বাকরখানি বানানো হয়?
‘এই ধরেন গিয়া, দুই হাজার পিস।’
সব বিক্রি হয়?
আবারও হাসেন। ‘কন কী! বিক্রি আবার হয় না! এই যে এইগুলা দেখতাছেন, এক ঘণ্টা পরে আইসা দেখবেন সব শ্যাষ। এইটার খুব চাহিদা এইখানে। ঢাকাইয়্যারা তো সকালে নাশতা করে এইটা দিয়া। তারপর আবার সন্ধ্যার সময়ও খায়। তাগো খুব পছন্দের খাওন এইটা। গরুর মাংস, চা, মিষ্টি দিয়া বাকরখানি খায় তারা।’
এর মধ্যে একজন ক্রেতা এলেন কিছু পনির নিয়ে। সিদ্দিক আলী সেগুলো দেখে নিয়ে বললেন, ‘সাব, এক কেজির বেশি হইব না।’
ক্রেতা তাতেই রাজি।
জিজ্ঞেস করলাম, পনির দিয়ে কী হবে?
সিদ্দিক আলী বললেন, ‘ঢাকার লোকেগো পনিরের বাকরখানি খুব পছন্দ। তারা পনির আইন্যা দেয়। আমরা বানাই। তয় এর দাম একটু বেশি। নোনতা বাকরখানি প্রতি পিস দুই টাকা, মিষ্টিটা তিন টাকা। আর পনিরেরটা পাঁচ টাকা। কাস্টমাররা পনির দিয়া গেলেও বানানের পরে আমরা পিস হিসেবেই বেচি।’
জিজ্ঞেস করলাম, এই যে কথা বলছেন আর কাজ করছেন, কষ্ট হচ্ছে না?
হেসে উত্তর দেন, ‘আমরা পাঁচজনে কাম করতে করতে সারা দিনই গল্প করি। দেশের বাড়ির গল্প করি। এইভাবে সময় কাইট্যা যায়।’
মাসে কত টাকা রোজগার হয়?
এইবার যেন একটু নড়েচড়ে বসেন সিদ্দিক আলী। ‘তা হয় ভালোই। তয় সত্যি কথা হইল, টাকা থাকে না। আমার কর্মচারী চাইরজন। তাগো বেতন চাইর হাজার কইরা। তারপর চুলার কয়লা কিনতে হয় প্রত্যেক দিন। ছয় মাস পরপর চুলাও বদলাইতে হয়। তারপর আবার দোকানভাড়া। এই ছোট্ট দোকানটার ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। গত মাসে মালিকে কইয়া গেছে, মাস শ্যাষে ভাড়া বাড়াইব।’ একটু থেমে, যেন নাড়ির টান পড়ে। বলে ওঠেন নিজেই, ‘এইসব দিয়া থুইয়া পরিবাররে পাঠাই হাজার দশেক টাকা।’
পরিবার কোথায় থাকে?
‘ওরা দ্যাশে থাকে। সাধারণ ব্যবসা কইরা পরিবার লইয়া কি ঢাকা শহরে থাকা সম্ভব? আমি আর কর্মচারীরা এইখানেই থাকি। এইখানেই এক বেলা রান্দি। সেইটা দুই বেলা খাই। আর সকালে তো চা দিয়া নিজের বানানো বাকরখানি দিয়া প্যাট ভরাই।’
তাঁর কথা শেষ হতেই আরেকবার তাকাই ঘরটার দিকে। একটিও জানালা নেই। ওপরে একটা ফ্যান ঘুরছে কোনোরকমে। পুরো দেয়ালে চিমনির কালিতে সয়লাব। কালো রঙের আগে দেয়ালের আসল রংটা কী ছিল, এটা বোঝা সত্যি সাধ্যের বাইরে।
জিজ্ঞেস করলাম, এই গরমে এখানে কীভাবে ঘুমান?
‘কী করুম? কোনোরকমে চইলা যায়। এই চৌকির ওপরেই পাঁচজনে ঘুমাইয়া যাই। চুলা বন্ধ কইরা দিলে ঘরটা ঠান্ডা হইয়া যায়। কষ্ট করতে আর কষ্ট লাগে না। অভ্যাস হইয়া গেছে।’
ছেলেমেয়ে কজন?
‘আমার স্ত্রী, তিন পোলা আর একটা মাইয়া। পোলারা সবাই পড়ালেখা করে। আমি স্কুলে যাই নাই কোনো দিন। তয় পোলাগোরে পড়ামু। তয় তাগো মইধ্যে একজনরে এই কাম শিখামু। ব্যবসাটা ধইরা রাখতে হইব না? বাকরখানির কদর আছে তো। আমার পোলায় পাস দিয়া বড় একটা দোকান দিব বাকরখানির। মাসে ৫০ হাজার টাকা তো ব্যাপারই না। পুঁজি থাকলেই চলে। আর বাকিরা বড় বড় চাকরি করব। তখন সবাই একলগে থাকুম।’
বলতে বলতে কাজও চলতে থাকে সিদ্দিক আলীর। গল্প করেন আর স্বপ্ন দেখেন। স্ত্রী, ছেলেমেয়েসহ সুখী এক দাম্পত্যের স্বপ্ন।
সুচিত্রা সরকার

No comments

Powered by Blogger.