মানবতার শিল্পী ফ্রান্সিসকো গোইয়া by কাইয়ুম চৌধুরী

স্পেনের চিত্রকর ফ্রান্সিসকো গোইয়া। ওল্ড মাস্টার পেইন্টারদের সর্বশেষ আর মডার্ন পেইন্টারদের প্রথম প্রতিনিধি। যাঁর কাজে অনুপ্রাণিত হয়েছেন বিখ্যাত চিত্রকর মানে, পিকাসো, ফ্রান্সিস বেকনরা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিল্পী গোইয়ার ছবি এই প্রথম বাংলাদেশে


পশ্চিমের চিত্রকলায় যুগান্তকারী অবদান রয়েছে স্পেনের তিন শিল্পীর—ভেলাসকুয়েজ, গোইয়া আর পিকাসো। এই তিন শিল্পীর প্রভাব বর্তমানকাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে এখনো অক্ষুণ্ন। চিন্তাধারা, শৈলী এবং মাধ্যমের প্রয়োগ আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করি আধুনিক শিল্পীদের শিল্প রচনাতে প্রবলভাবে। চিত্রশিল্পী হিসেবে গোইয়ার ভূমিকা পৃথিবীতে একটি অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত। শুধু মানবকল্যাণ নয়, একটা সুস্থ, সুন্দর পৃথিবী তাঁর স্বপ্ন ছিল। স্বদেশ স্পেনের শাসকগোষ্ঠী অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট মেকি জীবনযাপন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চরম দারিদ্র্য, স্পেনীয়দের স্বভাবজাত ক্রূরতা ও হিংস্রতা ছিল তাঁর ছবির উপজীব্য। নিজ অন্তর দিয়ে দেশবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন মানুষ ও পশুর মধ্যকার পার্থক্য। যখন মাদ্রিদে প্রাদো মিউজিয়মের চত্বরে গোইয়ার ভাস্কর্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছি, তখনো পুরোপুরি আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি তাঁর সৃষ্টিকে। প্রতিলিপির মাধ্যমে তা সম্ভবও ছিল না। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর গোইয়ার অঙ্কিত ‘দি ফায়ারিং পার্টি, ৩রা মে ১৮০৮’ আমার চোখে নতুনভাবে প্রতিভাত হলো। ফরাসি দখলদার বাহিনীর ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে স্পেনের মুক্তিযোদ্ধারা। প্রাদো মিউজিয়মে রক্ষিত মূল ছবিটি আমাকে একাত্তরে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। শুধু আমিই নই, ইউরোপীয় চিত্রশিল্পীদের অনেককেই এ ছবিটি উদ্বুদ্ধ করেছিল নতুন চিত্র রচনায়। শিল্পসুষমায় নয়, ফরাসি শিল্পী এদুয়ার্দ মানেকে রাজনৈতিকভাবে প্রেরণা দিয়েছিল ‘এক্সিকিউশন অব ম্যাক্সিমিলিয়ন’ ছবিটি আঁকতে। পিকাসো এঁকেছিলেন কোরিয়া যুদ্ধের ওপর অসাধারণ এক ছবি—‘ম্যাসাকার ইন কোরিয়া’। ফ্রান্সিসকো গোইয়া প্রবলভাবে যুদ্ধবিরোধী ছিলেন। যুদ্ধের বীভৎসতা, ক্রূরতা, সাধারণ মানুষের জীবনবিপর্যয়, লুণ্ঠন, ধর্ষণ—এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তাঁর সৃজনশীলতার মাধ্যমে। এমনকি স্পেনের জাতীয় ক্রীড়া বুলফাইটেরও বিরোধী ছিলেন তিনি।
ছাপাই ছবির ক্ষেত্রে গোইয়া অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে। ছাপাই ছবির ইতিহাসে গোইয়ার আসন অবিসংবাদীভাবে স্বীকৃত। কপারের ওপর তক্ষণ গোইয়ার কর্মকুশলতার অপূর্ব নিদর্শন তিনি রেখে গেছেন তাঁর ছাপাই ছবিতে। রেমব্রান্ত অনুপ্রাণিত করেছিলেন গোইয়াকে প্রবলভাবে। ড্রাইপয়েন্ট, এচিং, একুয়োটিন্ট—সব ক্ষেত্রেই গোইয়ার বিচরণ ছিল। ১৭৭৮ সালে গোইয়া তাঁর প্রথম এনগ্রেভিং রচনা করেন। এই মাধ্যমে প্রথম অনুশীলনের জন্য তিনি বেছে নেন স্বদেশীয় শিল্পী ভেলাসকুয়েজের ১৬টি ছবি, যা ছিল রাজকীয় চিত্রশালার সংগ্রহে। বিচিত্র কল্পনাশক্তির প্রয়োগে গোইয়া নিজস্ব চিত্র রচনায় মনোনিবেশ করেন এবং অচিরেই শিল্প সমঝদারদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। শুধু ছাপাই ছবি নিরীক্ষণ করলেই গোইয়ার শিল্পজীবন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ সম্ভব। ছাপাই ছবির মধ্যে চারটি মৌলিক সিরিজের কাজ খুবই উল্লেখযোগ্য। বর্তমান প্রদর্শনীর ছবিগুলো ছাপা হয়েছে ১৯৭০ সালে। প্লেটগুলো রিয়েল আকাদেমিয়া দ্য বেইয়াজ আর্টেজ দ্য সান ফার্নান্দোর সংগ্রহে রয়েছে। ছাপাই ছবির প্রথামতো শিল্পী সংখ্যা গুনে স্বাক্ষর করেন। সে সুযোগ এখন আর নেই। তবু বিস্ময়ের সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, গোইয়া কপার তক্ষণ করে গেছেন অনেক, কিন্তু ছাপাতে পারেননি নিজের জীবদ্দশায়। তিনি নিজের অনেক ছাপা ছবি দেখে যেতে পারেননি—আমাদের সৌভাগ্য আমরা সে ছবি আজ দেখছি। বেঙ্গল শিল্পালয়ে অনুষ্ঠিত বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, রিয়েল আকাদেমিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব অনুষদের স্প্যানিশ ভাষা বিভাগের ইনডিটেক্স চেয়ার ও স্প্যানিশ দূতাবাসের সহযোগিতায় বর্তমান প্রদর্শনী আমাদের সে সৌভাগ্যের দ্বার খুলে দিয়েছে।
রাজপরিবার, অভিজাত শ্রেণী, ধর্মীয় নেতাদের বিলাসবহুল রসঘন জীবনযাপনের কঠোর সমালোচনা করেছেন এ সিরিজের ছবিতে। সরাসরি স্পেনীয় সমাজকে দায়ী না করে গোইয়া সারা পৃথিবীর সমগোত্রীয় মানুষের সমালোচনা করেছেন ‘স্বপ্নের পৃথিবীর নারকীয় হইহল্লা’ নামে। গোইয়া একসময় রাজকীয় আনুকূল্য লাভ করেছেন অকুণ্ঠভাবে। রাজপরিবারের সদস্যদের প্রতিকৃতি ও পারিবারিক ছবি এঁকেছেন। সহানুভূতি পেয়েছেন রাজা-রানির। ভালোবাসা পেয়েছেন ডাচেসদের। ডাচেস আলবার সঙ্গে গোইয়ার সম্পর্ক ছিল মধুর। প্রতিকৃতি এঁকেছেন তাঁর। এঁকেছেন ‘নেকেড মাহা’ নামে শায়িতা ডাচেসের ছবি। ছবিটির দুটি সংস্করণ আছে। একটি সম্পূর্ণ নগ্ন, অন্যটি পোশাক পরিহিতা। ডাচেস কোন সংস্করণের মডেল হয়েছিলেন, সেটা রহস্যাবৃত রয়ে গেছে আজও। এ নিয়ে সমস্যা হয়েছিল ডাচেসের পরিবারে। এ কাহিনির ওপরে হলিউডে মেট্রো গোল্ডুইন মেয়ার দ্য নেকেড মাহা নামে একটি ছবি বানিয়েছিল হেনরি কস্টারের পরিচালনায়। গোইয়ার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অ্যান্থনি ফ্রাঁসোয়া আর ডাচেস অব আলবার ভূমিকায় আভা গার্ডনার। হলিউডি ধাঁচের ছবি গোইয়ার শিল্পীজীবন প্রস্ফুটিত নয় ততটা, যতটা তাঁর ভালোবাসা আলবার প্রতি। ছবিটি ঢাকায় গুলিস্তান হলে দেখেছিলাম।
‘ডিজেস্টার অব ওয়ার’ সিরিজের ছবি এই প্রদর্শনীতে রয়েছে। এ সিরিজ আঁকার পেছনে কাজ করেছে স্প্যানিশ জেনারেল প্যালাক্সের আমন্ত্রণ। নেপোলিয়ানের সৈন্যরা কীভাবে সারাগোসা শহরটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল সেটা দেখার জন্য। দেখার পর অন্য শিল্পীদের মতো গোইয়া খুব বিচলিত হননি। গোইয়ার ওপর এই যুদ্ধক্ষতের প্রভাব পড়তে থাকে ফরাসিদের হাত থেকে মুক্ত স্পেনের মুক্তির প্রাক্কালে। উভয় দিকের যুদ্ধের কারণে বীভৎসতা গোইয়ার একেবারেই অপছন্দ ছিল। ৮২টি ছাপচিত্র তৈরি করেন গোইয়া স্বাধীনতাযুদ্ধের ওপর। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে গোইয়া আঁকেন সুসজ্জিত ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রহীন স্প্যানিশ গেরিলার অসম যুদ্ধ। যুদ্ধক্ষেত্রের ধ্বংসযজ্ঞ, অনাবশ্যক প্রাণহানি, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে মাদ্রিদে খাবার অভাব, অসহায় লোকের মৃত্যু—যা প্রত্যক্ষ করেছেন গোইয়া নিজের চোখে। যুদ্ধপরবর্তী স্পেনে রাজার একচ্ছত্র আধিপত্যের কুফল রূপকল্পের মাধ্যমে তুলে এনেছেন তাঁর ছাপাই ছবিতে। সেই সময়ে গোইয়া আজকালের অ্যানিমেশন ছবির মতো জীবজন্তুর মুখে কথা বলিয়েছেন, যে জন্তুরা প্রতিনিধিত্ব করে শাসককুলের, রাজনীতিবিদের। ‘তোমাদের জন্য আজ মানবতা দুর্বিপাকে’ এই শিরোনাম ব্যবহূত হয়েছে তাঁর ছবিতে। মনে পড়ে যায় আমাদের শিল্পী কামরুল হাসানকে, যিনি রাজনীতিবিদদের উপস্থাপন করেছেন শেয়ালের প্রতীকে, ধূর্ততার চরম পরাকাষ্ঠা। স্বৈরাচারদের দেখিয়েছেন কুমিরের খোলসে, যারা সবকিছু গিলে খেতে চায়। রাজনীতি-সচেতন গোইয়ার প্রভাব কামরুল হাসানেও প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল নিঃসন্দেহে।
ষাঁড়ের লড়াইয়ের বীভৎসতা গোইয়া মেনে নিতে পারছিলেন না। যদিও জনপ্রিয় এই খেলার অর্থনৈতিক সফলতার বিষয়ে গোইয়া সচেতন ছিলেন এবং নিজের অর্থসংকটে এর বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থানও নিতে পারছিলেন না, তা সত্ত্বেও গোইয়া ষাঁড়ের লড়াইয়ের বীভৎসতার ওপর ছবি এঁকেছেন এবং স্পষ্ট স্বাক্ষর রেখেছেন, এই লড়াই তাঁর মনঃপূত নয়।
তাম্রতক্ষণে গোয়াইর সফলতার শিখর স্পর্শ করেছে নিঃসন্দেহে। ড্রইং-এ তাঁর দক্ষতা পুরোপুরি ব্যবহার করেছেন ছাপচিত্রে। সুক্ষ্মরেখার বিচিত্র সঞ্চালন এবং একুয়াটিন্টে আলোছায়ার সুসমবন্টন, টেক্সচারের উপাদান সমূহের চমকপ্রদ বিন্যাস রেমব্রান্ত, আলব্রেখট ড্যুরারকে স্মরণ করায়। ইয়োরোপের একজন শ্রেষ্ঠ ছাপচিত্রীর আসনটি তাঁর করায়ত্ত হয়।
বিচিত্র কল্পনাবিলাসী ছিলেন গোইয়া। যেকোনো বিষয়কে সর্বসাধারণের পক্ষে আনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা তাঁকে সর্বমহলে প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাজ আনুকূল্য নির্দ্ধিধায় পরিত্যাগ করে জনগণের কাতারে শামিল হওয়ার যে ত্যাগ স্বীকার, তা মানুষের পক্ষে কথা বলার তাগিদে মানুষের তৈরি দুর্বিপাক থেকে মানুষকে রক্ষা করার তাগিদে। একটা কথা গোইয়া স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষই মানুষকে সংকটের মুখে ঠেলে দেয় অতিমাত্রায় লোভ-লালসার জন্য এবং এর থেকে উত্তরণের পথ মানুষকেই খুঁজে বের করতে হবে। গোইয়া সমগ্র মানবজীবনের জন্য ভেবেছেন স্পেনকে পশ্চাৎপটে রেখে এবং তার পরিপূর্ণ ছাপ রেখে গেছেন তাঁর অঙ্কিত চার সিরিজের ছাপচিত্রের মাধ্যমে। যার অভ্যন্তরে পরাবাস্তবতার মিশেলে কল্পনাশক্তির চরম উদ্ঘাটন তাঁর চিত্রকলায়, তাঁর ছাপচিত্রে, তাঁর ড্রয়িংয়ে।
ফ্রান্সিসকো হোসে দ্য গোইয়া লুসিয়েন্তেস (১৭৪৬-১৮২৮) স্পেনের গৌরব, মানবতার গৌরব, সমগ্র পৃথিবীর গৌরব।

No comments

Powered by Blogger.