সিলেটের পটলবাবু by শাকুর মজিদ
‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’সহ বিখ্যাত অনেক গানের সুরকার বিদিত লাল দাশ। সিলেটের পটলবাবু নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। দেশীয় সংগীতের প্রসারে নিবেদিত প্রাণ এই সঙ্গীতজ্ঞ লোকান্তরিত হয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর স্মরণে এই লেখা।
বিদিত লাল দাশের (পটলবাবু) সঙ্গে আমার দ্বিতীয় ও শেষ সাক্ষাৎ হয় ২০০৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। দুই দিন আগে সিলেট অডিটরিয়ামে মরমি গীতিকার গিয়াসউদ্দিন আহমেদের স্মরণসভা ও শেষ বিয়ের সানাই গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’সহ গিয়াসউদ্দিন সাহেবের অনেক গানের সুর করার কাহিনি শুনিয়েছিলেন বিদিত লাল দাশ। ঢাকা থেকে হুমায়ূন আহমেদ ও সুবীর নন্দী এসেছিলেন। সুবীর নন্দীও একসময় গান শিখেছিলেন পটলবাবুর কাছে। ওস্তাদের করা সুরে সেই গানটিও তিনি গাইলেন। তখনই মনে হয়েছিল বিদিত লাল দাশের একান্ত কিছু কথা যদি আমার ক্যামেরায় রেকর্ড করে রাখি, কখনো কাজে লাগতে পারে।
বিদিত লাল দাশকে সহজে পেয়ে যেতে পারি, এ আশায় গিয়াসউদ্দিন তনয় আনোয়ার হোসেন রনিকে সঙ্গে নিই। সিলেটেই ছিল কামরুল আহবাব টিপু। এতদিনে সে ক্যামেরা চালানো শিখে ফেলেছে, সুতরাং আমার খাটনি অনেক কম।
শেখঘাটের রাস্তার ওপর বাড়িটার সামনে গিয়ে মনে হলো না যে নয় পুরুষের জমিদারেরা কখনো এখানে ছিলেন। অন্তত বিগত ৫০ বছরে এই বিশাল বাড়ির চত্বরে নতুন কোনো রং পড়েনি, দেয়াল থেকে যখন কোনো পলেস্তারার অংশ আপনাআপনি খসে পড়েছে, সেখানেও নতুন কোনো সিমেন্টের প্রলেপ নেই।
একসময় তাঁর ভেতর বাড়ির বসার ঘরের কার্পেটের ওপর হারমোনিয়াম নিয়ে বসেন। আমরা আলাপ শুরু করি।
বিদিত লাল দাশ বলেন, আমাদের রক্তে সংগীত। আমার বাবা গান গাইতেন, মা সেতার বাজাতেন। সাত বছর বয়স থেকে আমার সংগীতের চর্চা শুরু। আমি সুর সাগর প্রাণের দাশের কাছে সংগীতের হাতেখড়ি নিই। কিন্তু বেশি দিন আমি উনার কাছে থাকতে পারিনি। ছোটবেলা আমরা দুই ভাই এত দুষ্টু ছিলাম যে আমাদের দুষ্টুমি দেখে আমাদের বাবা ১৯৪৬ সালে আমাদের শিলং নিয়ে যান। ভর্তি হই ইংলিশ স্কুলে। ১৯৫৮ সালে ফেরত আসি সিলেট, সঙ্গে ওস্তাদ ফুল মুহম্মদ। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমি তাঁর কাছে উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম নিয়েছি।
একসময় নির্মলেন্দু চৌধুরীর গাওয়া হাসন রাজার একটা গান ‘লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি বালা না আমার’ শুনে আমার উৎসাহ জাগে যে আমি হাসন রাজার গান দিয়েই সংগীতের চর্চা শুরু করব। ১৯৬২ সালে ঢাকা রেডিওতে আমার প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেল। হাসন রাজার গান আমি শুরু করলাম। হাসন উদাস বই পাওয়া ছিল তো খুব দুষ্কর ব্যাপার। হাসন রাজার বাড়িতে গিয়ে হাসন উদাস বইটি নিয়ে টিউনিং শুরু করলাম।
আজকাল আগে সুর হয়ে যায়, তারপর রচয়িতা এসে এর ওপর কথা লিখে দেন। কিন্তু আমি আমার ওস্তাদকে দেখেছি ১০০টি গানের মধ্যে থেকে দুটো গান বেছে সুর করতেন। আমিও সেই প্রথা বজায় রেখে চলেছি। টেলিভিশনের বর্ণালি অনুষ্ঠানে, আমরা যত অনুষ্ঠানে গান করেছি, তাতে আমাদের নাম ছড়িয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি নতুন কিছু উপস্থাপন করতে। আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের এখানে মুরগির লড়াই, নৌকাবাইচের গান—এসব নিয়ে আমি গান করেছি।
তিনি বলেন, আগে লোকসংগীত কিন্তু শহরভিত্তিক ছিল না, গ্রামভিত্তিক ছিল। আমরা মালজোরা গান করতাম। তার জন্য করিম ভাই, দূরবীণ শাহসহ ওই পারে গিয়ে গান করতাম। কিন্তু এই পারে লোকসংগীতের বাতাস ততটা আসেনি।
সিলেটের লোকগান নিয়ে বলেন, আমাদের এখানে এতসব ভ্যারাইটি আছে—যেমন গাজির গান, পির-মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, ভাটিয়ালি, জারিসারি, বিচ্ছেদ, রায় বিচ্ছেদ, শ্যাম বিচ্ছেদ, মঙ্গলা, গুষ্ঠ, ফিরা গুষ্ঠ, নৌকাবাইচ, ধামাইল অনেক রকম গান আছে। কেউ যদি শিখতে চায় দু-চারটি গান শিখে লোকসংগীতশিল্পী হতে পারবেন না। আমার কাছে এই সিলেট অঞ্চলের ৯৭ জন মরমি কবির গান সংগৃহীত আছে। আজকের রথীন রায় আমার সুরে গান করছেন, ফরিদা পারভীন করছেন, তার পরে সাবিনা ইয়াসমীন করেছেন, রুনা লায়লা করেছেন এবং বাইরের শিল্পীরাও করছেন। এই হাসন রাজা, রাধারমন, শীতালং ফকির, আরকুম শাহ—এগুলো আমাদের শরীরে রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। আমাদের লাভটা হচ্ছে কি এসব গান যত বেশি চর্চা করবে, তাতেই তার ঈশ্বরের সাধনা হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদেরও তা-ই বলি, এই সব গানই যদি তোমরা আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টা করো, প্রার্থনার কাছাকাছি কাজ হয়ে যাবে। কিছুদিন আগে আমাকে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। উনারা প্রশ্ন করলেন, বাংলা গানের আজ এই দুরবস্থা কেন? আমি বললাম, বাংলা গানের এই দুরবস্থার কারণ আপনারা। যত রোগের উৎপত্তি সব কেন্দ্র থেকে, এই কেন্দ্র থেকে আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম। ব্যান্ডের যে একটা রোগ পড়েছে। এই ব্যান্ডের রোগটা কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশে ছড়াচ্ছে। যখন আমরা দল গঠন করি, তখনো কিন্তু আমরা এই অসুবিধাটা ফেস করেছিলাম। তখনো ফকির আলমগীর, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, আজম খান উনারা আমাদের সঙ্গে সুবিধা করতে পারেননি। তখন আমাদেরও একটা দল ছিল, উনাদের আমাদের সঙ্গে স্টেজে দাঁড়িয়ে গান করার ক্ষমতা ছিল না। উনারা স্টেজে গিয়ে আগে বলতেন বিদিত লাল দার সংগীতের আগে যেন আমাদের গান না হয়।
আমার আজও মনে হয়, আমার ছেলেরা যদি একটা দল গঠন করে গান শুরু করে, তা হলে ব্যান্ডের যে উৎপাত শুরু হয়েছে, এটা বন্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া আমি উপায় দেখি না।
দীর্ঘক্ষণ মন্ত্রমুদ্ধের মতো তাঁর কথা শুনি।
বিদিত লাল দাশ বলেন, এখন মাঝেমধ্যেই শুনি অমুক দূরবীণ শাহ শিল্পীগোষ্ঠী, অমুক আরকুম শাহ বা শিতালং শাহর। তারা যে গান গায়, সেটাকে তারা কেউ কেউ মূল সুর বলে দাবি করে। কই, তারা কি কেউ এই এক-দেড় শ বছরের পুরোনো সাধকদের স্বরলিপি দেখাতে পারবে? আসলে সিলেটের আঞ্চলিক গানকে আমরাই একটা জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি, সেখান থেকে নানাজন নানাভাবে গাইছে।
বিদিত লাল দাশ গেয়ে শোনান আরকুম শাহর ‘সোনার পিঞ্জিরা আমার কইরা গেলায় খালি রে নির্ধনিয়ার ধন/ আমি কি পাইমুরে কালা তোর দরশন।’ বলেন, এটা আমিই সুর করেছি এ ছাড়া কালা শাহর গান, ‘তোমার আসবে সমন করবে জারি করবে গেরেফতারি/ ও মন নাইওরি, বিয়ার সাজন সাজ তাড়াতাড়ি’ বা ‘সাধের লাউ বানাইছে মোরে বৈরাগী’ এগুলোতে সারা দেশের শিল্পীরা যে সুরে গায়, সেটা আমিই করেছি। এই ‘সাধের লাউ’ গানের একটা অন্তরা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ সাহেবের লেখা, আরেকটি অন্তরা সুনির্মল কুমার দেব মীনের। তিনি বলেন, সিলেট অঞ্চলে অনেক মরমি সাধক ছিলেন। তাঁদের গানের মর্মার্থ বোঝা অত সহজ কাজ নয়। আরকুম শাহ, কালা মিয়া, মুন্সি ইরফান আলী—এঁরা প্রত্যেকেই সাধক, দরবেশ ও গীতিকবি ছিলেন।
সিলেটের ধামাইল সুরের গান নিয়ে অনেক কথা হয় আমাদের মধ্যে। তিনি বলেন, সুর একই, কথা বদলে যায়। হিন্দু বিয়েতে এক রকমের কথা থাকে, মুসলমানের বাড়িতে আরেক রকম।
আরকুম শাহ গান লিখেছিলেন, ‘কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে ফুলে পাইলা ভোমরা, ময়ূর সাজে নাচইন রাধিকা’। মূলত রাধা-কৃষ্ণের উপাচারই বিয়েবাড়িতে বর-কনের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে গান হয়। বর-কনেকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে হাততালি দিতে দিতে এসব গান গাওয়া হয়। রাধারমন ও রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় নিয়ে গান লিখেছেন, সেগুলোও বিয়ের গান হিসেবে আদৃত। যেমন, ‘ও রাই গো কুঞ্জ সাজাও গিয়া/ কেন গো রাই কাঁদিতেছ পাগলিনী হইয়া’।
অনেক বেলা পর্যন্ত আড্ডা হলো। আমরা বেরিয়ে আসি ঘর থেকে। বেরোতে বেরোতে বলেন, এই সিলেট শহরেই একসময় আমাদের অনেক জমিদারি ছিল। ’৪৬ সালে নেহরু এই বাড়িতে এসেছিলেন। আমার বাবাকে আসামের সংসদ সদস্যের টিকিট দিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা যদিও হিন্দু ছিলাম, কিন্তু তখন মুসলিম লিগ করতাম। এখন নয় পুরুষের জমিদারির শেষ চিহ্নটুকু আমার কাছে রেখে সংগীত সাধনার মধ্যেই জীবনটা পার করে দিতে চাই।
আগের রমরমা পরিবেশের কিছু বর্ণনা দেন। বলেন, ১৯৬৫ সালে আইয়ুবের শাসন আসার আগে পর্যন্ত আমাদের এই বাড়িটি অত্যন্ত রমরমা ছিল। দুর্গাপূজার সময় লখনৌ থেকে বাইজি আসত। তারা গান-বাজনা করত। সিলেট ছাড়াও বিশ্বনাথ, জকিগঞ্জে আমাদের জমিদারি ছিল। সিলেটের বেশ জমিজমা সরকার নিয়ে নিয়েছে, কিছু মানুষ দখল করেছে, কিছু বিক্রি হয়ে গেছে, কিছু আবার দান করা হয়েছে। সিলেট সরকারি স্কুল, বর্তমান মধুবন মার্কেট, কুদরত উল্লাহ মসজিদ চত্বর, স্টেশন ক্লাব—এগুলো আমাদের দান করা জমির ওপর হয়েছে। বিদিত লাল দাশের বাবা ছিলেন ফিল্মের ডিস্ট্রিবিউটর এবং আসাম সংসদের সদস্য। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দুইটা সিনেমা হলই এখন তাঁর আয়ের প্রধান উৎস। তাঁরা তিন ভাই ছিলেন। এক ভাই মারা গেছেন, আরেক ভাই আসামে থাকেন, তিনি একা বাংলাদেশ। দুই বোনের মধ্যে একজন ভারতে, একজন সিলেটে। তাঁর এক পুত্র ছিল, নাম নীলম। ১৯৮১ সালে চার বছর বয়সে মারা যায়। তার নামে খুলেছেন নিজের বাড়িতে সংগীত একাডেমি। সারা দিন গান-বাজনা শেখানোর কাজেই ব্যস্ত থাকেন। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা—ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। ডাক্তারি পড়া শেষ হলে ছেলে গান শিখবে। সেই ছেলে যেন আরেক বিদিত লাল দাশ হতে পারে, এটাই তার জীবনের একমাত্র চাওয়া।
২০০৫ সালের সেদিনের পর বিদিত লাল দাশের সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হয়নি। গত সোমবার (৮ অক্টোবর ২০১২) সকালবেলা দুঃসংবাদটি পেলাম। এ সাত বছরে নিশ্চয়ই তাঁর জীবনযাপনে অনেক পরিবর্তন এসেছিল। আমি জানি না তাঁর পুত্র এত দিনে ডাক্তারি শেষ করে বাবার মতো গানের অনুরাগী হয়েছে কি না। বিদিত লাল দাশ সিলেটে পটলবাবু নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যু সিলেটের লোকসংগীতকে সত্যিকার অর্থেই অভিভাবকহীন করে গেল। জানি না তাঁর নীলম লোক সংগীতালয় কেমন থাকবে।
বিদিত লাল দাশকে সহজে পেয়ে যেতে পারি, এ আশায় গিয়াসউদ্দিন তনয় আনোয়ার হোসেন রনিকে সঙ্গে নিই। সিলেটেই ছিল কামরুল আহবাব টিপু। এতদিনে সে ক্যামেরা চালানো শিখে ফেলেছে, সুতরাং আমার খাটনি অনেক কম।
শেখঘাটের রাস্তার ওপর বাড়িটার সামনে গিয়ে মনে হলো না যে নয় পুরুষের জমিদারেরা কখনো এখানে ছিলেন। অন্তত বিগত ৫০ বছরে এই বিশাল বাড়ির চত্বরে নতুন কোনো রং পড়েনি, দেয়াল থেকে যখন কোনো পলেস্তারার অংশ আপনাআপনি খসে পড়েছে, সেখানেও নতুন কোনো সিমেন্টের প্রলেপ নেই।
একসময় তাঁর ভেতর বাড়ির বসার ঘরের কার্পেটের ওপর হারমোনিয়াম নিয়ে বসেন। আমরা আলাপ শুরু করি।
বিদিত লাল দাশ বলেন, আমাদের রক্তে সংগীত। আমার বাবা গান গাইতেন, মা সেতার বাজাতেন। সাত বছর বয়স থেকে আমার সংগীতের চর্চা শুরু। আমি সুর সাগর প্রাণের দাশের কাছে সংগীতের হাতেখড়ি নিই। কিন্তু বেশি দিন আমি উনার কাছে থাকতে পারিনি। ছোটবেলা আমরা দুই ভাই এত দুষ্টু ছিলাম যে আমাদের দুষ্টুমি দেখে আমাদের বাবা ১৯৪৬ সালে আমাদের শিলং নিয়ে যান। ভর্তি হই ইংলিশ স্কুলে। ১৯৫৮ সালে ফেরত আসি সিলেট, সঙ্গে ওস্তাদ ফুল মুহম্মদ। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমি তাঁর কাছে উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম নিয়েছি।
একসময় নির্মলেন্দু চৌধুরীর গাওয়া হাসন রাজার একটা গান ‘লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি বালা না আমার’ শুনে আমার উৎসাহ জাগে যে আমি হাসন রাজার গান দিয়েই সংগীতের চর্চা শুরু করব। ১৯৬২ সালে ঢাকা রেডিওতে আমার প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেল। হাসন রাজার গান আমি শুরু করলাম। হাসন উদাস বই পাওয়া ছিল তো খুব দুষ্কর ব্যাপার। হাসন রাজার বাড়িতে গিয়ে হাসন উদাস বইটি নিয়ে টিউনিং শুরু করলাম।
আজকাল আগে সুর হয়ে যায়, তারপর রচয়িতা এসে এর ওপর কথা লিখে দেন। কিন্তু আমি আমার ওস্তাদকে দেখেছি ১০০টি গানের মধ্যে থেকে দুটো গান বেছে সুর করতেন। আমিও সেই প্রথা বজায় রেখে চলেছি। টেলিভিশনের বর্ণালি অনুষ্ঠানে, আমরা যত অনুষ্ঠানে গান করেছি, তাতে আমাদের নাম ছড়িয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি নতুন কিছু উপস্থাপন করতে। আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের এখানে মুরগির লড়াই, নৌকাবাইচের গান—এসব নিয়ে আমি গান করেছি।
তিনি বলেন, আগে লোকসংগীত কিন্তু শহরভিত্তিক ছিল না, গ্রামভিত্তিক ছিল। আমরা মালজোরা গান করতাম। তার জন্য করিম ভাই, দূরবীণ শাহসহ ওই পারে গিয়ে গান করতাম। কিন্তু এই পারে লোকসংগীতের বাতাস ততটা আসেনি।
সিলেটের লোকগান নিয়ে বলেন, আমাদের এখানে এতসব ভ্যারাইটি আছে—যেমন গাজির গান, পির-মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, ভাটিয়ালি, জারিসারি, বিচ্ছেদ, রায় বিচ্ছেদ, শ্যাম বিচ্ছেদ, মঙ্গলা, গুষ্ঠ, ফিরা গুষ্ঠ, নৌকাবাইচ, ধামাইল অনেক রকম গান আছে। কেউ যদি শিখতে চায় দু-চারটি গান শিখে লোকসংগীতশিল্পী হতে পারবেন না। আমার কাছে এই সিলেট অঞ্চলের ৯৭ জন মরমি কবির গান সংগৃহীত আছে। আজকের রথীন রায় আমার সুরে গান করছেন, ফরিদা পারভীন করছেন, তার পরে সাবিনা ইয়াসমীন করেছেন, রুনা লায়লা করেছেন এবং বাইরের শিল্পীরাও করছেন। এই হাসন রাজা, রাধারমন, শীতালং ফকির, আরকুম শাহ—এগুলো আমাদের শরীরে রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। আমাদের লাভটা হচ্ছে কি এসব গান যত বেশি চর্চা করবে, তাতেই তার ঈশ্বরের সাধনা হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদেরও তা-ই বলি, এই সব গানই যদি তোমরা আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টা করো, প্রার্থনার কাছাকাছি কাজ হয়ে যাবে। কিছুদিন আগে আমাকে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। উনারা প্রশ্ন করলেন, বাংলা গানের আজ এই দুরবস্থা কেন? আমি বললাম, বাংলা গানের এই দুরবস্থার কারণ আপনারা। যত রোগের উৎপত্তি সব কেন্দ্র থেকে, এই কেন্দ্র থেকে আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম। ব্যান্ডের যে একটা রোগ পড়েছে। এই ব্যান্ডের রোগটা কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশে ছড়াচ্ছে। যখন আমরা দল গঠন করি, তখনো কিন্তু আমরা এই অসুবিধাটা ফেস করেছিলাম। তখনো ফকির আলমগীর, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, আজম খান উনারা আমাদের সঙ্গে সুবিধা করতে পারেননি। তখন আমাদেরও একটা দল ছিল, উনাদের আমাদের সঙ্গে স্টেজে দাঁড়িয়ে গান করার ক্ষমতা ছিল না। উনারা স্টেজে গিয়ে আগে বলতেন বিদিত লাল দার সংগীতের আগে যেন আমাদের গান না হয়।
আমার আজও মনে হয়, আমার ছেলেরা যদি একটা দল গঠন করে গান শুরু করে, তা হলে ব্যান্ডের যে উৎপাত শুরু হয়েছে, এটা বন্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া আমি উপায় দেখি না।
দীর্ঘক্ষণ মন্ত্রমুদ্ধের মতো তাঁর কথা শুনি।
বিদিত লাল দাশ বলেন, এখন মাঝেমধ্যেই শুনি অমুক দূরবীণ শাহ শিল্পীগোষ্ঠী, অমুক আরকুম শাহ বা শিতালং শাহর। তারা যে গান গায়, সেটাকে তারা কেউ কেউ মূল সুর বলে দাবি করে। কই, তারা কি কেউ এই এক-দেড় শ বছরের পুরোনো সাধকদের স্বরলিপি দেখাতে পারবে? আসলে সিলেটের আঞ্চলিক গানকে আমরাই একটা জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি, সেখান থেকে নানাজন নানাভাবে গাইছে।
বিদিত লাল দাশ গেয়ে শোনান আরকুম শাহর ‘সোনার পিঞ্জিরা আমার কইরা গেলায় খালি রে নির্ধনিয়ার ধন/ আমি কি পাইমুরে কালা তোর দরশন।’ বলেন, এটা আমিই সুর করেছি এ ছাড়া কালা শাহর গান, ‘তোমার আসবে সমন করবে জারি করবে গেরেফতারি/ ও মন নাইওরি, বিয়ার সাজন সাজ তাড়াতাড়ি’ বা ‘সাধের লাউ বানাইছে মোরে বৈরাগী’ এগুলোতে সারা দেশের শিল্পীরা যে সুরে গায়, সেটা আমিই করেছি। এই ‘সাধের লাউ’ গানের একটা অন্তরা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ সাহেবের লেখা, আরেকটি অন্তরা সুনির্মল কুমার দেব মীনের। তিনি বলেন, সিলেট অঞ্চলে অনেক মরমি সাধক ছিলেন। তাঁদের গানের মর্মার্থ বোঝা অত সহজ কাজ নয়। আরকুম শাহ, কালা মিয়া, মুন্সি ইরফান আলী—এঁরা প্রত্যেকেই সাধক, দরবেশ ও গীতিকবি ছিলেন।
সিলেটের ধামাইল সুরের গান নিয়ে অনেক কথা হয় আমাদের মধ্যে। তিনি বলেন, সুর একই, কথা বদলে যায়। হিন্দু বিয়েতে এক রকমের কথা থাকে, মুসলমানের বাড়িতে আরেক রকম।
আরকুম শাহ গান লিখেছিলেন, ‘কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে ফুলে পাইলা ভোমরা, ময়ূর সাজে নাচইন রাধিকা’। মূলত রাধা-কৃষ্ণের উপাচারই বিয়েবাড়িতে বর-কনের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে গান হয়। বর-কনেকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে হাততালি দিতে দিতে এসব গান গাওয়া হয়। রাধারমন ও রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় নিয়ে গান লিখেছেন, সেগুলোও বিয়ের গান হিসেবে আদৃত। যেমন, ‘ও রাই গো কুঞ্জ সাজাও গিয়া/ কেন গো রাই কাঁদিতেছ পাগলিনী হইয়া’।
অনেক বেলা পর্যন্ত আড্ডা হলো। আমরা বেরিয়ে আসি ঘর থেকে। বেরোতে বেরোতে বলেন, এই সিলেট শহরেই একসময় আমাদের অনেক জমিদারি ছিল। ’৪৬ সালে নেহরু এই বাড়িতে এসেছিলেন। আমার বাবাকে আসামের সংসদ সদস্যের টিকিট দিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা যদিও হিন্দু ছিলাম, কিন্তু তখন মুসলিম লিগ করতাম। এখন নয় পুরুষের জমিদারির শেষ চিহ্নটুকু আমার কাছে রেখে সংগীত সাধনার মধ্যেই জীবনটা পার করে দিতে চাই।
আগের রমরমা পরিবেশের কিছু বর্ণনা দেন। বলেন, ১৯৬৫ সালে আইয়ুবের শাসন আসার আগে পর্যন্ত আমাদের এই বাড়িটি অত্যন্ত রমরমা ছিল। দুর্গাপূজার সময় লখনৌ থেকে বাইজি আসত। তারা গান-বাজনা করত। সিলেট ছাড়াও বিশ্বনাথ, জকিগঞ্জে আমাদের জমিদারি ছিল। সিলেটের বেশ জমিজমা সরকার নিয়ে নিয়েছে, কিছু মানুষ দখল করেছে, কিছু বিক্রি হয়ে গেছে, কিছু আবার দান করা হয়েছে। সিলেট সরকারি স্কুল, বর্তমান মধুবন মার্কেট, কুদরত উল্লাহ মসজিদ চত্বর, স্টেশন ক্লাব—এগুলো আমাদের দান করা জমির ওপর হয়েছে। বিদিত লাল দাশের বাবা ছিলেন ফিল্মের ডিস্ট্রিবিউটর এবং আসাম সংসদের সদস্য। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দুইটা সিনেমা হলই এখন তাঁর আয়ের প্রধান উৎস। তাঁরা তিন ভাই ছিলেন। এক ভাই মারা গেছেন, আরেক ভাই আসামে থাকেন, তিনি একা বাংলাদেশ। দুই বোনের মধ্যে একজন ভারতে, একজন সিলেটে। তাঁর এক পুত্র ছিল, নাম নীলম। ১৯৮১ সালে চার বছর বয়সে মারা যায়। তার নামে খুলেছেন নিজের বাড়িতে সংগীত একাডেমি। সারা দিন গান-বাজনা শেখানোর কাজেই ব্যস্ত থাকেন। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা—ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। ডাক্তারি পড়া শেষ হলে ছেলে গান শিখবে। সেই ছেলে যেন আরেক বিদিত লাল দাশ হতে পারে, এটাই তার জীবনের একমাত্র চাওয়া।
২০০৫ সালের সেদিনের পর বিদিত লাল দাশের সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হয়নি। গত সোমবার (৮ অক্টোবর ২০১২) সকালবেলা দুঃসংবাদটি পেলাম। এ সাত বছরে নিশ্চয়ই তাঁর জীবনযাপনে অনেক পরিবর্তন এসেছিল। আমি জানি না তাঁর পুত্র এত দিনে ডাক্তারি শেষ করে বাবার মতো গানের অনুরাগী হয়েছে কি না। বিদিত লাল দাশ সিলেটে পটলবাবু নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যু সিলেটের লোকসংগীতকে সত্যিকার অর্থেই অভিভাবকহীন করে গেল। জানি না তাঁর নীলম লোক সংগীতালয় কেমন থাকবে।
No comments