'আমি'র বিয়োগ অথবা ফকির লালনের সাধনা by সলিমুল্লাহ খান

ইংরেজি ১৯৫৮ সালে নামকাওয়াস্তে ডক্টর শ্রীমতিলাল দাশ, এম্এ, বিএল্, পিএইচডি ও শ্রীপীযূষকান্তি মহাপাত্র, এমএকে যুক্ত করিয়া বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক লালন শাহ্ ফকিরের গান গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের নাম রাখা হয় 'লালন-গীতিকা'।


গ্রন্থের ভূমিকা লেখেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রী শশিভূষণ দাশগুপ্ত। ভূমিকাকার লেখেন, ''বাংলার বাউল এবং বাউল-গান সম্বন্ধে শিক্ষিত বাঙালীর মনে একটা শ্রদ্ধা এং ঔৎসুক্য দেখা দিয়াছে। ইহার মূলে রহিয়াছেন মুখ্যভাবে রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতীতে তাঁহার সহকর্মী আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়।''
লালন-গীতিকার সম্পাদক মহাশয়েরা আপনাদের হাতে পাওয়া পদগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করিয়াছিলেন। তাঁহারা প্রথম ভাগের নাম 'বাউল গান' আর দ্বিতীয় ভাগের নাম 'বৈষ্ণবভাবাপন্ন গান' রাখিয়াছিলেন। লালন ফকিরের গানের মধ্যে অনেকগুলি 'বৈষ্ণবভাবাপন্ন পদ' দেখা যায়। শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখিয়াছেন, ''এগুলি রাধা-কৃষ্ণের লীলাবিষয়ক অথবা গৌরাঙ্গলীলাবিষয়ক।'' দাশগুপ্ত মহাশয় দেখিতে পাইয়াছেন, ''রাধাকৃষ্ণের লীলা অথবা শ্রী গৌরাঙ্গের লীলা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙলার জনগণের নিকটে একটা সামাজিক উত্তরাধিকাররূপে দেখা দিয়াছিল। তাহার ফলে অসংখ্য হিন্দু-কবির সঙ্গে বহুসংখ্যক মুসলমান কবিও এই কৃষ্ণলীলা বা গৌরাঙ্গলীলার গান করিয়াছেন।'' লালন ফকিরের গানের এক ভাগ হইতে তিনি সেই সত্যেরই সমর্থন লাভ করিয়াছেন। এই সত্যের মূলে আছে একটি ঘটনা। 'শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে অবলম্বন করিয়া ষোড়শ শতাব্দীতে বাঙলা দেশে ধর্ম ও সাহিত্যের' যাহাকে বলে 'অভিনব প্রসার' ঘটিয়াছিল। ইহা হইতেছে লালন

ফকির রচিত গানের একাংশ বিষয়ে মন্তব্য। অপরাংশ বিষয়ে শশিভূষণ দাশগুপ্তের মন্তব্য আরও কৌতূহলোদ্দীপক।
ইনি লিখিয়াছেন : "বাউল গানগুলির মধ্যে আবার দুইটি দিক আছে; একটি হইল সর্বপ্রকার সংস্কার-প্রথার বাহিরে একান্ত সহজভাবে রূপের মধ্যে অরূপের_ সীমার মধ্যে অসীমের_ সন্ধানের দিক। এই দিকটিই রবীন্দ্রনাথ এবং আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয় প্রভৃতিকে বাউল-গানের প্রতি অমনভাবে আকৃষ্ট করিয়াছিল। এই যে রূপের খাঁচার মধ্যে একটি অধরা অচিন পাখীর আসা-যাওয়ার রহস্য_ রক্তমাংসের মানুষের ভিতরেই যে আর একটি 'মনের মানুষে'র অবস্থান_ ইহার আভাসই বাউল-সঙ্গীতকে আধুনিককালে এত জনপ্রিয় করিয়া তুলিয়াছে।" 'বাঙলার জনগণের নিম্নকোটিতে প্রচলিত এবং প্রচারিত বাউল-ধর্ম ও বাউল-গান', শশিভূষণ দাশগুপ্ত অকপটে স্বীকার করিয়াছেন, 'আজ সর্ব কোটির ধর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করিতেছে।' প্রমাণ রবীন্দ্রনাথ এবং আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়।
কথায় বলে, সরিষার মধ্যেই ভূত। বাউল গানের প্রভাব বলিয়া রবীন্দ্রনাথ যাহা গ্রহণ করিয়াছেন 'শিক্ষিত বাঙালি' তাহাকেই যদি লালন ফকিরের সারাংশ বলিয়া ধারণা করেন, তবে খুব দোষের কাজ হয় না। আমাদের ধারণা, রবীন্দ্রনাথ কিংবা ক্ষিতিমোহন সেন বাউল গানের প্রচার বা প্রসারে যে ভূমিকাই গ্রহণ করিয়া থাকেন না কেন, ফকির লালন শাহের গানে ব্যক্ত তত্ত্বকথার খুব বেশি তাঁহারা ধরিতে পারেন নাই। উপস্থিত নিবন্ধে এই কথাটির পক্ষে দুই-চারি প্রস্তাব উত্থাপন করিতেছি। তবে উত্থাপন মাত্র। যুক্তিবিস্তারের মতো স্থান বা কাল আজ পাইলাম না। পাঠিকার ঋণে আপাতত আরও ঋণী থাকিলাম।
১.
শশিভূষণ দাশগুপ্ত জানাইতেছেন, "শিলাইদহে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ পল্লীগায়কদের মুখে এই বাউল-গান শুনিতে পান; সুরে ও ব্যঞ্জনায় গানগুলি রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্তে গভীর প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। আসলে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটি 'নবীন বাউলে'র বসতি ছিল। রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে সেই বাউলের গূঢ় পরিচয় নিহিত আছে।"
প্রমাণস্বরূপ দাশগুপ্ত মহাশয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পত্রপুট' নামক সংগ্রহ হইতে একটি কবিতা উপস্থিত করিয়াছেন। এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন, 'কবি আমি ওদের দলে'। প্রশ্ন হইতেছে 'ওদের' পরিচয় কী? ওরা কারা? রবীন্দ্রনাথ জানেন ওরাও সন্ধানী, ওরাও সাধক, কিন্তু ওরা ওরাই। ওরায় আর আমরায় ভেদও অভেদ্য।

ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত।
দেবালয়ের মন্দিরদ্বারে
পূজা-ব্যবসায়ী ওদের ঠেকিয়ে রাখে।
ওরা দেবতাকে খুঁজে বেড়ায় তাঁর আপন স্থানে
সকল বেড়ার বাইরে
সহজ ভক্তির আলোকে,
নক্ষত্রখচিত আকাশে,
পুষ্পখচিত বনস্থলীতে,
দোসর জনার মিলন-বিরহের
গহন বেদনায়।
যে-দেখা বানিয়ে দেখা বাঁধা ছাঁচে,
প্রাচীর ঘিরে 'দুয়ার তুলে',
সে-দেখার উপায় নেই ওদের হাতে।

কতদিন দেখেছি ওদের সাধককে
একলা প্রভাতের রৌদ্রে সেই পদ্মানদীর ধারে,
যে নদীর নেই কোনো দ্বিধা
পাকা দেউলের পুরাতন ভিত ভেঙে ফেলতে।
দেখেছি একতারা হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে
মনের মানুষকে সন্ধান করবার
গভীর নির্জন পথে।

রবীন্দ্রনাথ বাউল বলিতে কী বুঝিয়াছেন তাহার সামান্য পরিচয় এই কবিতায় ধরা পড়িয়াছে। শশিভূষণ দাশগুপ্তও কবুল করিতেছেন এই পরিচয় খণ্ডিত। খণ্ডিত পরিচয় যে সত্য পরিচয় নহে, তাহা অবশ্য বলাই বাহুল্য। দাশগুপ্ত মহাশয় লিখিয়াছেন, "রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত বাউলের এই পরিচয় পড়িলেই বুঝিতে পারা যায়, ইহার কিছু তিনি পাইয়াছিলেন স্রোতচঞ্চলা পদ্মার নির্জন তীরে একতারা হাতে 'গানের ধারা বেয়ে চলা' গায়কদের কথায় সুরে, বাকিটুকু তিনি পূরণ করিয়া লইয়াছেন নিজের মধ্যে যে বাউল-কবির বাস তাহার পরিচয় মিশ্রিত করিয়া।" শশিভূষণ অবশ্য পরিষ্কার করিবার সময় পান নাই কিছুর ভাগ কতটুকু আর বাকিটুকুর অংশইবা কতটুকু। আমরা সবিনয় নিবেদন করি রবীন্দ্রনাথের এই বাউল পরিচয়নামার বাকির খাতায় শূন্য নাই_ শূন্য যাহা আছে তাহা সবই কিছুর খাতায়। তাহা যদি সত্য হয় তো নতুন প্রশ্ন জাগে_ সেই প্রশ্ন পদ্মার জাগা নতুন চরের মতো। এই ফাঁকি কি করিয়া সম্ভব হইল? সম্ভব হইল যে ইতিহাসের কারণে তাহার পুরা বয়ান এইখানে দেওয়ার উপায় নাই। সম্ভব হইল শিক্ষিত মহল বলিয়া একটা মহল ছিল বলিয়া। রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন_ দেবালয়ের মন্দিরদ্বারে পূজা-ব্যবসায়ী ওদের ঠেকিয়ে রাখে। একশত ভাগ খাঁটি এই কথা। কিন্তু তিনি ঠাহর পান নাই যে, শিক্ষিত মহল বা শিক্ষা-ব্যবসায়ীও উহাদের কম ঠেকাইয়া রাখে নাই। শিক্ষা-ব্যবসায়ী উহাদের 'মনের মানুষকে সন্ধান করবার গভীর নির্জন পথে' একেবারে পুঁতিয়া রাখিয়াছেন। সেই পদ্মা নদীর ধারে। সেই কথায় আসিতেছি। শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখিয়াছেন, "পাবনা জেলার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কর্মকেন্দ্র_ আর পাশেই নদীয়া জিলার কুষ্টিয়া মহকুমায় বিশিষ্ট বাউল লালন শাহ্ ফকিরের সাধনকেন্দ্র। লালন ফকিরের কিছু কিছু গান রবীন্দ্রনাথের কানে আসিতে লাগিল, লালন ফকিরের খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।' এই জিজ্ঞাসার সহিত রবীন্দ্রনাথের জীবন-জিজ্ঞাসার গভীর মিল ছিল; তাই স্বাভাবিকভাবেই এই গানগুলি তাঁহাকে আকৃষ্ট করিল। তিনি তখন লালন ফকিরের অনেক গান সংগ্রহ করিলেন এবং ১৩২২ সনে প্রথমে লালন ফকিরের কুড়িটি গান 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশ করেন। তখন হইতেই শিক্ষিত বাঙালির মনে বাউল সাধক ও তাঁহাদের গান_ বিশেষ করিয়া লালন ফকির ও তাঁহার রচিত গান সম্বন্ধে একটা কৌতূহল জাগ্রত হয়।" এই কৌতূহলের পরিণতি কী পরিমাণ শোকাবহ হইয়াছে তাহার প্রমাণ আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়। শশিভূষণ দাশগুপ্ত-ইহাঁরও অনুরক্ত। তিনি লিখিতেছেন, 'আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয় দীর্ঘদিন ধরিয়া তাঁহার নানাবিধ লেখা এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ অথচ সুমধুর ভাষণের ভিতর দিয়া এই বাউল-গান সম্বন্ধে একটা ব্যাপক শ্রদ্ধা ও কৌতূহল জাগ্রত করাইতে সমর্থ হন। এই ভাবেই শিক্ষিতমহলে লালন ফকিরের প্রসিদ্ধি।'
ক্ষিতিমোহন সেন রবীন্দ্রনাথের যোগ্য উত্তরসূরি। তিনিও রবীন্দ্রনাথের মতোই দেখিয়াছেন। বাউলরা শাস্ত্রবিধি ও আনুষ্ঠানিক ধর্ম মানে না। দেব-দেবীর পূজা করে না, মানুষকেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া জ্ঞান করে, ভাণ্ডেই ব্রহ্মাণ্ড প্রত্যক্ষ করে_ এইসব কথাই তাহার মূলধন। ক্ষিতিমোহন সেনের মতে বাংলার বাউলদের সাধনা ভগবৎ প্রেমের সাধনা। তাই তাঁহাকে বলিতে হইয়াছে বাউল দুই বা অনেক প্রকারের। একদল গ্রন্থী বাউল আর দল সাচ্চা বা আসল বাউল। সেন মহাশয়ের ধারণা, সহজ ভাব সম্বন্ধীয় যে-কয়খানা পুঁথি পাওয়া যায়, তাহাতে সাচ্চা বাউল-ভাবের পরিচয় মেলে না।' সেন মহাশয়ের এই ধারণাজাত সাচ্চা-বাউল কি বস্তু? উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলিয়াছেন, 'বর্তমানে বাংলার বাউলরা যে গান করে, যেভাবে ধর্ম-জীবনযাপন করে, ধর্ম-কর্ম করে, তাহার সহিত ক্ষিতিমোহন বাবু কর্তৃক প্রচারিত গান বা তাঁহার বর্ণিত সাধন-প্রণালির বিশেষ কোনো মিল নাই।'
বাউল সাধকদের মধ্যে 'সহজ' নামে একটি কথা চলে । ক্ষিতিমোহন সেন ইহার পরিচয় দিয়াছেন 'সস্তা ইন্দ্রিয়-উপভোগের পন্থা' বলিয়া। বলিয়াছেন, এই জিনিস 'বাস্তবিকপক্ষে কোনো সাধনার ভিত্তি হইতে পারে না।' উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ক্ষিতিমোহন সেনকে ছাড়িয়া কথা বলেন নাই দেখিয়া আমার বিশেষ প্রীতি হইতেছে। তিনি বলিয়াছেন, বাউল সাধকদের প্রকৃতি পুরুষ মিলন ইন্দ্রিয়-উপভোগ নহে, ইন্দ্রিয় দমন। ভট্টাচার্য মহাশয়ের জবানিতে বলিতে, "ইহা বিন্দু ধারণের জন্য সুকঠিন যোগ-সাধনা, ইহার বিশেষণ 'সস্তা' হইতে পারে না। ইহার বিশেষ রূপে 'দুর্লভ' কথাটি প্রযোজ্য। ইহা ক্ষয়ের আয়োজন নয়, সঞ্চয়ের সাধনা।"
গ্রন্থনির্ভর বাউলদের কথা তুলিয়া ক্ষিতিমোহন সেন বলিয়াছেন, 'সহজ নামে তাহারা যে সস্তা ইন্দ্রিয়-উপভোগের পন্থা খুলিয়াছেন তাহা বাস্তবিকপক্ষে কোনো সাধনার ভিত্তি হইতে পারে না।' আর সাচ্চা বাউল কী করিবে? উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য খানিক রস করিয়া লিখিয়াছেন, 'সাচ্চা বাউল-অর্থে মনে হয়, তিনি [ক্ষিতিমোহন সেন] বুঝিয়াছেন, যে-বাউল কোনোরূপ প্রকৃতি ঘটিত সাধনা করিবে না, যে-বাউল ক্ষণে ক্ষণে বিশ্ব-প্রকৃতিতে ও মানুষের মধ্যে ভগবানের লীলা দেখিয়া বিস্মিত ও মুগ্ধ হইবে, সে ভগবানের প্রেমে সর্বসময় উন্মত্তবৎ ঘুরিয়া বেড়াইবে এবং তাঁহার প্রেম-স্পর্শ পাইবার জন্য লালায়িত হইবে, তাহার মনের মানুষকে পাইবার জন্য সর্বদা আকুলিবিকুলি করিবে, কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্ম মানিবে না, শাস্ত্রাচার বা দেব-দেবতা মানিবে না, কেবল ভগবানের প্রেমে সর্বদা আত্মহারা, উন্মাদবৎ হইয়া থাকিবে ইত্যাদি ইত্যাদি।'
উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের কথা যদি আট আনাও সত্য হয় তো স্বীকার করিতে হইবে, রবীন্দ্রনাথ যাহা প্রচ্ছন্ন করিয়া বলিয়াছেন ক্ষিতিমোহন সেন তাহা প্রকাশ্যে কবুল করিয়াছেন। বলা প্রয়োজন, শ্রীযুক্ত সেন মহাশয় রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা অর্জন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এক্ষণে আমরা দেখিব উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহাশয়ের ধারণার গোড়ায় কোনো মাটি আছে কি-না। তিনি লিখিতেছেন, 'দীর্ঘদিন ধরিয়া অনেক বাউলের পরিচয় পাইয়াছি। তাহার ফলে তাহাদিগকে উচ্ছৃঙ্খল ইন্দ্রিয় সেবী বলিতে পারি না। ইহা একটি সুকঠোর যোগ-সাধনা_ এই যোগ-সাধনার মধ্য দিয়াই বাউলরা তাহাদের আকাঙ্ক্ষিত চরম অবস্থায় উপনীত হয়।'
তিনি আরও লিখিতেছেন, "যদি আত্মস্বরূপের উপলব্ধি করিতে হয়, যদি 'মনের মানুষ'কে 'ধরিতে হয়', তবে হরি, কৃষ্ণ বা আল্লা বলিয়া চিৎকার করিলে হইবে না বা মনের মানুষের উদ্দেশ্যে হায় হায় করিয়া আকুলি-বিকুলি করিয়া বেড়াইলে চলিবে না। তাহার জন্য কর্মময় যোগ সাধনা করিতে হইবে। সেই কৃষ্ণ, হরি বা আল্লা তো আমার মধ্যেই আছেন, নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করিতে পারিলেই তাঁহাকে জানা যাইবে। তাই লালন বলিতেছেন : 'কেবল ডাকলে মানুষ কয় না কথা'।
উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন, "বাংলার বাউলদের সাধনা 'অধর মানুষ'কে ধরিবার সাধনা। তিনি লিখিয়াছেন, "এই মনের মানুষ', 'অধর মানুষ', 'অটল মানুষ', 'সহজ-মানুষ', 'যুগের মানুষ', 'সোনার মানুষ', 'আলোক-মানুষ', 'ভাষের মানুষ', মানুষের হৃদয় বিহারী পরমাত্মা। যদিও ইহা মূলতঃ প্রত্যেক মানুষেরই অন্তরতম সত্তা, তবুও বাউলরা তাঁহাকে অনেক স্থলে বক্তিগত ভগবান মনে করিয়াছেন এবং অনেক গানে তাঁহার কাছে দৈন্য, আর্তি, শরণাগতি প্রভৃতি প্রকাশ করিয়াছে। 'মনের মানুষ'-এর সঙ্গে মিলিত হইবার জন্য কতকগুলি গানে আকুলতাও প্রকাশ করা হইয়াছে।'' ভট্টচার্য মহাশয়ের মতে, এই অধর মানুষকে উপলব্ধি করিবার বা 'ধরিবার' যে পদ্ধতি, তাহা একটি যৌক্তিক প্রক্রিয়ায়, এই 'অধর মানুষ'-এর স্থান বিশেষে আবির্ভাব ও তাহার উপলব্ধির প্রক্রিয়াই বাউল সাধনার একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।" এক কথায়, ভট্টাচার্য লিখিয়াছেন, ''বাংলার বাউলের প্রেম মানবিক প্রেম এবং 'অধর মানুষ'কে ধরিবার সাধনা প্রকৃতি-পুরুষ মিলনাত্মক যোগ-সাধনা।''
আমরা সবিনয় নিবেদন করিব, বাংলার বাউলদের বিশেষ ফকির লালন শাহের সাধনা বুঝিতে হইলে ঘটনাটি অন্যদিক হইতে দেখিতে হয়। এক মানুষের মধ্যে দুই বা একাধিক মানুষের 'ভাব' আসে কোথা হইতে? আসে 'ভাষা' হইতে। 'ভাষা'র সহিত 'ভাব' মিশিয়া আছে। একটা হইতে আরকে আলাদা বা বিয়োগ করিলেই বোঝা যায় এক মানুষের মধ্যে আর মানুষ কি করিয়া প্রবেশ করিয়াছে।
ভাষা মানুষকে শুধু অন্য প্রাণী হইতেই, অন্য জীব হইতেই, আলাদা করে নাই। নিজেকেও নিজের নিকট হইতে দূরে ঠেলিয়া দিয়াছে। সেই কারণেই মানুষ বলিতে পারে, আমি ঘুমাইতেছি, আমি স্বপ্ন দেখিতেছি বা আমি তো মরিয়া কাঠ হইয়া গেলাম। ইতি আদি। বাউল সাধকদের জ্যান্তে মরা কথাটার গোড়ায় ভাষার এই দোহাই অপরিহার্য। দেখিতে হইবে, ভাষা হইতে স্বাধীন কোনো ভাব নাই। থাকিতেই পারে না। দুঃখের মধ্যে, আবার ভাষার মধ্যেও ভাবকে ষোলআনা ধরিবার স্থান নাই। এই দ্বৈরথ বাউলদের সাধনায় চমৎকার ধরা পড়িয়াছে। 'আমি' বলিতে কি বুঝায়? 'আমি' একটি শব্দ বা বাক্যমধ্যে 'পদ' হিসাবে পরিচিত শব্দ। আমির অর্থ কি? যে মানুষ 'আমি' উচ্চারণ করে সে বলে আমি মানে আমার 'আপন' বা 'নিজ'। আর যাহাকে সে 'তুমি' বা 'সে' বলে। সেই 'তুমি' বা 'সে'ও যখন কথা বলে সেও 'আমি' শব্দের শরণ লয়। ইহার তাৎপর্য কি? তাৎপর্য আমি শব্দের কোনো 'অটল' অর্থ নাই। ইহার অর্থ টলটলায়মান। অর্থ টলতে পারে দুই কারণে_ এক নম্বরে বক্তা বা উক্তিকারের কারণে, দুই নম্বরে খোদ ভাষার কারণে। 'আমি' শব্দ ভাষার ক্ষেত্র হইতে শস্য আকারে ফলিয়াছে ইহা ভুলিলে চলিবে না। এই শস্য চাষী বা বক্তা হইতে বিয়োগ করা। ভাষা শুদ্ধ যোগই করে না, বিয়োগও করিয়া দেয়।
বাংলার সাধক বাউলদের মধ্যেই চিন্তার এই বিস্ময়কর ফসল ফলিয়াছে। দুঃখের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হইতে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য পর্যন্ত কেহ ইহার একটিবার উল্লেখও করেন নাই। আমির অর্থও যে শুদ্ধ আমি নয়, আমির মধ্যে তুমি ও সে। এককথায় পুরা ভাষার ক্ষেত্র লুকাইয়া আছে তাহা দেখিতে পারিলে গুরুতর লাভ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বঘোষিত গুরুদেব। তাঁহার এই গুরুতর শিক্ষার দরকার আছে। লালন ফকির সেই শিক্ষাই দিয়াছেন।
ফকির লালন শাহের এই গানটি বিবেচনা করুন।

আমি কি তাই জানলে সাধন সিদ্ধি হয়।
আমি শব্দের অর্থ ভারি, আমি সে তো আমি নয়

অনন্ত শহর বাজারে
আমি আমি শব্দ করে
আমার খবর নাই আমারে
বেদ পড়ি পাগলের প্রায়

যখন না ছিল স্বর্গ মর্ত্য
তখন কেবল আমি সত্য
পরেতে হইল বর্ত
আমি হইতে তুমি কায়

মনছুর হাল্লাজ ফকির সে তো
বলেছিল আমি সত্য
সেই প'লো সাঁইর আইন মত,
শরায় কি তার মর্ম পায়

কুম বেইজনি কুম বেয়েজনিল্লা
সাঁইর হুকুম দুই আমি হীলা
লালন বলে, এ ভেদ খোলা
আছে রে মুরশিদের ঠাঁয়

'আমি' হইতে 'আমি' বিয়োগ করিবার এই সাধনা ফকির লালন শাহের এই গানে বেদের বিচার আকারে হাজির হইয়াছে। ইহাকে কি বাংলার শিক্ষিত মহলের এবং পূজা ব্যবসায়ী মহলের বিচার আকারেও যুগপৎ গ্রহণ করিব না? হ


দোহাই
১। মতিলাল দাশ ও পীযূষকান্তি মহাপাত্র [সম্পাদিত]
লালন-গীতিকা, লালন শাহ ফকিরের গান
[কলিকাতা : কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৮]
২। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বাংলার বাউল ও বাউল গান, তৃতীয় সংস্করণ [কলিকাতা : ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ১৪০৮]।
 

No comments

Powered by Blogger.