জার্মান ঐক্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরো-সংকট
পুনরেকত্রীকরণের ২৩ বছর পর ইউরোপে জার্মানি এখন আবার মর্যাদার আসনে, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে। ইউরোপীয় অর্থনীতির অন্যতম ‘পাওয়ার হাউস’ জার্মানি। তবে এই অর্থনৈতিক সবলতাকে অনেকে ভিন্ন চোখে দেখছেন, যাতে বাস্তবতার চেয়ে ইতিহাসনির্ভর আবেগটাই বেশি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিগত অবিশ্বাসবোধ এবং পুঁজিবাদ আর সমাজবাদে বিভক্ত হয়ে যায় পুরো ইউরোপ। বিভক্ত হয় জার্মানিও। বহু যুগ পর, গত শতকের নব্বইয়ের দশকে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে অধিকতর গণতন্ত্র আর নাগরিক অধিকারের আন্দোলন শুরু হলে তার ঢেউ এসে লাগে সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানিতেও। চূড়ান্ত পরিণতিতে পতন ঘটে বার্লিন দেয়ালের।
১৯৮৯ সালের ৮ নভেম্বর। এদিন পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর পদত্যাগ করার মাধ্যমে ভেঙে পড়ে পূর্ব জার্মান সরকার। ৯ নভেম্বর ভাঙা শুরু হয় বার্লিনকে বিভক্ত করে রাখা প্রাচীর। বিভেদকারী রাজনৈতিক তত্ত্বের বেড়াজাল শিথিল হয়ে ঘটে জার্মান জাতির পুনর্মিলন।
বিভক্ত জার্মানির দীর্ঘদিনের সমাজতান্ত্রিক আর ধনবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এক করে এগিয়ে যাওয়ার কাজটি ছিল দুরূহ। পূর্ব জার্মানিতে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনীতি পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অগ্রসর ছিল, যদিও পুঁজিবাদের সব সমর্থক তা মানেন না। আবার পশ্চিমের অর্থনীতি পুঁজিবাদী হলেও সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল সুদৃঢ়।
একত্রীকরণের পর অর্থনীতি ছাড়াও আইন, প্রশাসন, রাস্তাঘাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা—সবকিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটানো হয়। আর এসবের জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি সচ্ছল পশ্চিমের বাসিন্দাদের দীর্ঘ ২২ বছর ধরে ‘সংহতি ভ্যাট’ দিতে হচ্ছে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার বদৌলতে ঐক্যবদ্ধ জার্মানি তার সংস্কার কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে এখন ইউরোপের বড় অর্থনৈতিক শক্তি। অবশ্য, এ ঐক্যের অনেক আগে থেকেই মধ্য ইউরোপের দুই সমৃদ্ধ দেশ জার্মানি আর ফ্রান্স একটি সমন্বিত ইউরোপীয় অর্থনীতি গড়ার প্রয়াস পেয়েছিল।
১৯৫৭ সালে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কয়লা আর ইস্পাত বিনিময়ের মাধ্যমে ছয়টি ইউরোপীয় দেশ যে অর্থনৈতিক সমঝোতা করেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ১০টি, পরে আরও সাতটি দেশ অভিন্ন ইউরো মুদ্রা চালু করেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি চালু হয় ভিসামুক্ত যাতায়াতব্যবস্থা, যৌথ শিক্ষা, সাংস্কৃতিক গবেষণামূলক কার্যক্রম ইত্যাদি।
সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণী সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে এটি ছাড়া দেশ অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাবে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর ক্রমান্বয়ে চাপ পড়লেও অর্থনীতিতে গতি ফিরে আসে। তবে সময় থাকতে ঘাটতি হ্রাস আর রাষ্ট্রীয় ঋণ কমানোর জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে জার্মানি ও ফ্রান্স যেভাবে এগিয়ে যায়, অন্যরা তেমনটা পারেনি।
ইউরোপের অর্থনীতিকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিতে সবল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজ দেশে বেশ সমালোচনার মুখেও জার্মানি নিজেদের অর্থ ঘাটতি বাজেটে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দেশ গ্রিস, স্পেন বা পর্তুগালে লগ্নি করেছে। এতে জার্মানির কিছুটা লাভ থাকলেও ঝুঁকিটাও কম নয়।
এদিকে ইউরো-সংকট কাটাতে জার্মানের নীতিবিষয়ক প্রস্তাবগুলো সংকট-আক্রান্ত দেশগুলোতে জার্মান-বিরোধিতার জন্ম দিচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে গ্রিস, স্পেন বা পর্তুগালে সেই দেশগুলোর অর্থনৈতিক সংস্কারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে জার্মানবিরোধী পোস্টার-ব্যানার দেখা গেছে।
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেল কদিন আগে বলেছেন, ইউরোভুক্ত কিছু দেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নিয়ে জার্মানি এবং লগ্নিকারীরা চিন্তিত। অন্যদিকে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান মারিও দ্রাগি অবিলম্বে অর্থনৈতিক সংস্কারের তাগিদ দিয়েছেন।
ইউরোজোনের সংকট কাটাতে জার্মানির অর্থলগ্নি যেন সীমাহীন না হয়, সে জন্য জার্মান সাংবিধানিক আদালত সরকারকে সতর্ক করে সীমারেখা ধার্য করে দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, ঘাটতি বাজেট নিয়ন্ত্রণে আর্থিক বিষয়ে চুক্তির ক্ষেত্রে জার্মান লগ্নি কোনোমতেই ১৯ হাজার কোটি ইউরোর ঊর্ধ্বে যেতে পারবে না। এই সীমারেখা ছাড়িয়ে গেলে সংসদের অনুমোদন নিতে হবে।
২০০৯ সালের শুরু থেকে ইউরোভুক্ত বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হলেও জার্মানির অর্থনীতি চাঙা রয়েছে। গত দুই বছরের মতো এবারও জার্মানির রপ্তানি-আয় এবং প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, বেকারের সংখ্যা কমেছে। আর এসবই ঘটেছে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেলসহ জার্মানির রাজনীতিকদের দূরদর্শিতার কারণে।
জার্মানির ঐক্যের ২২ বছরে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ জার্মানি এগোচ্ছে। এগোচ্ছে প্রায় পুরো ইউরোপকে নিয়ে।
সরাফ আহমেদ
প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
১৯৮৯ সালের ৮ নভেম্বর। এদিন পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর পদত্যাগ করার মাধ্যমে ভেঙে পড়ে পূর্ব জার্মান সরকার। ৯ নভেম্বর ভাঙা শুরু হয় বার্লিনকে বিভক্ত করে রাখা প্রাচীর। বিভেদকারী রাজনৈতিক তত্ত্বের বেড়াজাল শিথিল হয়ে ঘটে জার্মান জাতির পুনর্মিলন।
বিভক্ত জার্মানির দীর্ঘদিনের সমাজতান্ত্রিক আর ধনবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এক করে এগিয়ে যাওয়ার কাজটি ছিল দুরূহ। পূর্ব জার্মানিতে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনীতি পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অগ্রসর ছিল, যদিও পুঁজিবাদের সব সমর্থক তা মানেন না। আবার পশ্চিমের অর্থনীতি পুঁজিবাদী হলেও সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল সুদৃঢ়।
একত্রীকরণের পর অর্থনীতি ছাড়াও আইন, প্রশাসন, রাস্তাঘাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা—সবকিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটানো হয়। আর এসবের জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি সচ্ছল পশ্চিমের বাসিন্দাদের দীর্ঘ ২২ বছর ধরে ‘সংহতি ভ্যাট’ দিতে হচ্ছে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার বদৌলতে ঐক্যবদ্ধ জার্মানি তার সংস্কার কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে এখন ইউরোপের বড় অর্থনৈতিক শক্তি। অবশ্য, এ ঐক্যের অনেক আগে থেকেই মধ্য ইউরোপের দুই সমৃদ্ধ দেশ জার্মানি আর ফ্রান্স একটি সমন্বিত ইউরোপীয় অর্থনীতি গড়ার প্রয়াস পেয়েছিল।
১৯৫৭ সালে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কয়লা আর ইস্পাত বিনিময়ের মাধ্যমে ছয়টি ইউরোপীয় দেশ যে অর্থনৈতিক সমঝোতা করেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ১০টি, পরে আরও সাতটি দেশ অভিন্ন ইউরো মুদ্রা চালু করেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি চালু হয় ভিসামুক্ত যাতায়াতব্যবস্থা, যৌথ শিক্ষা, সাংস্কৃতিক গবেষণামূলক কার্যক্রম ইত্যাদি।
সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণী সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে এটি ছাড়া দেশ অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাবে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর ক্রমান্বয়ে চাপ পড়লেও অর্থনীতিতে গতি ফিরে আসে। তবে সময় থাকতে ঘাটতি হ্রাস আর রাষ্ট্রীয় ঋণ কমানোর জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে জার্মানি ও ফ্রান্স যেভাবে এগিয়ে যায়, অন্যরা তেমনটা পারেনি।
ইউরোপের অর্থনীতিকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিতে সবল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজ দেশে বেশ সমালোচনার মুখেও জার্মানি নিজেদের অর্থ ঘাটতি বাজেটে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দেশ গ্রিস, স্পেন বা পর্তুগালে লগ্নি করেছে। এতে জার্মানির কিছুটা লাভ থাকলেও ঝুঁকিটাও কম নয়।
এদিকে ইউরো-সংকট কাটাতে জার্মানের নীতিবিষয়ক প্রস্তাবগুলো সংকট-আক্রান্ত দেশগুলোতে জার্মান-বিরোধিতার জন্ম দিচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে গ্রিস, স্পেন বা পর্তুগালে সেই দেশগুলোর অর্থনৈতিক সংস্কারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে জার্মানবিরোধী পোস্টার-ব্যানার দেখা গেছে।
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেল কদিন আগে বলেছেন, ইউরোভুক্ত কিছু দেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নিয়ে জার্মানি এবং লগ্নিকারীরা চিন্তিত। অন্যদিকে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান মারিও দ্রাগি অবিলম্বে অর্থনৈতিক সংস্কারের তাগিদ দিয়েছেন।
ইউরোজোনের সংকট কাটাতে জার্মানির অর্থলগ্নি যেন সীমাহীন না হয়, সে জন্য জার্মান সাংবিধানিক আদালত সরকারকে সতর্ক করে সীমারেখা ধার্য করে দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, ঘাটতি বাজেট নিয়ন্ত্রণে আর্থিক বিষয়ে চুক্তির ক্ষেত্রে জার্মান লগ্নি কোনোমতেই ১৯ হাজার কোটি ইউরোর ঊর্ধ্বে যেতে পারবে না। এই সীমারেখা ছাড়িয়ে গেলে সংসদের অনুমোদন নিতে হবে।
২০০৯ সালের শুরু থেকে ইউরোভুক্ত বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হলেও জার্মানির অর্থনীতি চাঙা রয়েছে। গত দুই বছরের মতো এবারও জার্মানির রপ্তানি-আয় এবং প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, বেকারের সংখ্যা কমেছে। আর এসবই ঘটেছে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেলসহ জার্মানির রাজনীতিকদের দূরদর্শিতার কারণে।
জার্মানির ঐক্যের ২২ বছরে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ জার্মানি এগোচ্ছে। এগোচ্ছে প্রায় পুরো ইউরোপকে নিয়ে।
সরাফ আহমেদ
প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
No comments