আসলেই কতটা এগোলেন আফ্রিকার নারীরা?

গত এক বছরে আফ্রিকার কয়েকজন নারীর সাফল্যের খবর শুনেছে বিশ্ববাসী। এ মহাদেশের দুজন নারী যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, দ্বিতীয় নারী প্রেসিডেন্ট পেয়েছে আফ্রিকা আর প্রথমবারের মতো একজন নারী আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। মনে হতে পারে, আফ্রিকায় নারীদের উত্থানপর্ব শুরু হয়েছে।


কিন্তু পরিস্থিতি আসলেই তা কি না, বিবিসির ‘আফ্রিকা ডিবেট’ অনুষ্ঠানের হয়ে সে প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন মালাবির নারী অধিকারকর্মী জেসি কাবউইলা।

গত বছর যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া তিন নারীর মধ্যে রয়েছেন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ ও একই দেশের শান্তিকর্মী লেমাহ জিবোয়ি। এদিকে মালাবির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন জয়েস বান্দা। আফ্রিকার ৫৪টি দেশের জোট আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী কর্মী এনকোসাজানা দ্লামিনি-জুমা। এসব দেখে অনেকেই হয়তো বলবেন, আফ্রিকার নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হলে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানা খুব জরুরি।
প্রথমত জানতে হবে, আফ্রিকার নারীদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ কী। শুধু দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়েই কি তাঁরা উঠে আসতে পারবেন? যাঁরা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তাঁরা কি আফ্রিকার সব পিছিয়ে থাকা নারীর প্রতিনিধিত্ব করেন?
বিভিন্ন গবেষণায় স্পষ্ট দেখা গেছে, পুরুষদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যবাদের নীতি আফ্রিকার নারীদের দমিয়ে রাখার একটি বড় অস্ত্র। এখানে নারীর চেয়ে পুরুষকে বড় করে দেখা হয়। এমন একটা পরিস্থিতিতে কোনো নারী রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাচিত হলে স্বাভাবিকভাবে সবাই চমৎকৃত হয়। কিন্তু তাতে নারীদের সার্বিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না।
যত দিন পর্যন্ত পুরুষকে বড় করে দেখা হবে, সমাজের সব সুযোগ-সুবিধা মূলত পুরুষের জন্য নির্ধারিত থাকবে, তত দিন পর্যন্ত নারীদের অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। আফ্রিকার কোনো নারী প্রেসিডেন্ট হলেও তাঁর টিকে থাকা নির্ভর করবে, তিনি পুরুষের সুযোগ-সুবিধার জন্য কতখানি কাজ করছেন, তার ওপর।
মনে রাখতে হবে, আফ্রিকার ৫৪টি দেশের মধ্যে মাত্র দুটি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন নারী। এই করুণ রকমের ভারসাম্যহীন অনুপাতকেও অনেকে নারীর এগিয়ে যাওয়া হিসেবে দেখছেন। আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি হচ্ছে নারী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই মহাদেশে নারীদের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকে গেছে।
আফ্রিকায় নারীদের উত্থান হচ্ছে—এ কথা বলার সময় আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে আমরা কি নেতৃত্বের কথা বলছি, না কাঠামোর কথা বলছি। নারীদের অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে প্রথমে দরকার কাঠামোর পরিবর্তন। কোনো নারীকে হঠাৎ করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিলে রাতারাতি অবস্থার পরিবর্তন হয় না। এটা তখনই ঘটে, যখন গোটা সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নারী বা শিশুদের জন্য কাজ করে, এমন মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চাইলে এবং নারীরা যে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম, তা প্রমাণ করতে হলে তাঁদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দিতে হবে।
আফ্রিকার বেশির ভাগ নারী দরিদ্র। তাঁরা থাকেন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। বেশির ভাগই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। রাজনীতিতে যেসব নারীর উত্থান ঘটেছে, তাঁরা কেউ এ শ্রেণীর নন। সব নারীর উন্নয়ন চাইলে নেতৃস্থানীয় নারীরা যা করেন, তার সুফল নিচের স্তরে থাকা নারীসমাজের কাছে পৌঁছাতে হবে। এ জন্য আফ্রিকার সমাজের ওপর ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া আধুনিক রাষ্ট্র, আনুষ্ঠানিক ধর্ম, বৈশ্বিক পুঁজিবাদের মতো বিষয়গুলোকে বদলাতে হবে। সংস্কার করতে হবে বিয়ের মতো ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে নারীদের ওপর নিপীড়নের ব্যবস্থারও।
নারীরা আসলেই কীভাবে এগিয়ে এসে গুরুত্বপূর্ণ পদে জায়গা করে নিতে পারেন, সে ব্যাপারে গবেষণা হওয়া দরকার। গবেষণার পর গৃহীত পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে তার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সব রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বতসোয়ানা ও রুয়ান্ডার কথা বলা যায়। দেশ দুটি রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। নারীর ক্ষমতায়ন চাইলে রাজনৈতিক দল, পার্লামেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানের নেতৃস্থানীয় পদগুলোতে নারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। কোনো দেশের পার্লামেন্টে যদি অর্ধেকসংখ্যক সদস্য নারী হন, সে দেশে নারীদের উন্নয়ন হতে বাধ্য।
একজন নারী প্রেসিডেন্ট তাঁর দেশের নারীদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাঁদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। তিনি নিশ্চিত করবেন, তাঁর রাষ্ট্র নারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছে। একজন নারী প্রেসিডেন্ট নারীদের কথা, বিশেষ করে দরিদ্র, গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ও শিক্ষাবঞ্চিত নারীদের কথা শুনবেন এবং তাঁদের সমস্যার সমাধান করবেন। একজন নেতাকে এটা মনে রাখতে হবে যে পরিবর্তন এক দিনে হয় না। এটি একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পাদিত হয়। নারীবান্ধব একটি সমাজ তৈরি করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে এবং তাতে অবশ্যই জনগণের সহযোগিতা থাকতে হবে। যেসব দেশে কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান, সেসব দেশের নারীরা প্রেসিডেন্ট হলেও খুব বেশি করার কিছু থাকে না।
 জেসি কাবউইলা
ভাবানুবাদ: রোকেয়া রহমান, সূত্র: বিবিসি

No comments

Powered by Blogger.