সংসার কি তবে শুধুই পুরুষের? by নূর-এ-জান্নাতুল ফেরদৌস রুহী

ভারতীয় নারীরা এখন থেকে তাদের সিভিকে আকর্ষণীয় করতে পারবেন একটি আকর্ষণীয় পদবি 'চিফ হাউসহোল্ড অফিসার' বা 'হাউস ম্যানেজার' ব্যবহার করে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি হলো তার নিজের বাসা এবং তার বস হলেন তার স্বামী! এমনই একটি অবিশ্বাস্য, হাস্যকর আইন প্রস্তাব করতে যাচ্ছে ভারতের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রণালয়।


দেশটির নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রণালয় স্ত্রীদের সারাদিনের গৃহকর্মের কাজকে আর্থিকভাবে স্বীকৃতি আদায় করে দিতে চায়। আর এই আর্থিক স্বীকৃতি দেবেন তাদের স্বামীরা। স্বামীরা প্রত্যেক মাসে তার নিজের বেতনের ১০ থেকে ২০ শতাংশ স্ত্রীদের বেতন হিসেবে তাদের অ্যাকাউন্টে জমা দেবেন।
এখানে দুটি বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যাক। প্রথমত, এই আইনের ফলে ক. মহিলাদের উন্নয়ন খ. আর্থিক স্বাধীনতা এবং গ. সামাজিক পরিসরে কর্মের স্বীকৃতি মিলবে বলে মন্ত্রণালয়টি দাবি করছে। দ্বিতীয়ত, গৃহিণীদের সারাদিনের কাজকর্মের একটা বড় সুফল ভোগ করেন স্বামীরা। তাই এই আর্থিক স্বীকৃতি তাদেরই বহন করতে হবে। এই বিষয় দুটি একটু বিশেল্গষণ করা যাক। প্রথম বিষয়টিকে বিশেল্গষণ করলে দেখা যায়, আইনটি দিয়ে বোঝানো হচ্ছে যে, একজন পুরুষ শুধুই তার নিজের জন্য আয় করেন এবং বাজার করা, রান্না করা, পরিষ্কার কিংবা শিশুদের দেখাশোনার জন্য তার স্ত্রীকে বেতন দেওয়ার অর্থ হলো, পুরুষ তার নিজের সংসার, নিজের পরিবারের স্বার্থে এটা করছেন। অর্থাৎ সংসারটা শুধু পুরুষের, স্বামীর। নারীকে ক্ষমতায়নের বদলে এই আচরণটি একজন নারীকে চার দেয়ালে তার নিজের বিচরণ ক্ষেত্রে আরও সংকীর্ণ করে তুলবে। নিজেকে তার পরিবারেই একজন 'কর্মী' বলে মনে হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই তার ওপর স্বামীর কর্তৃত্ব আরও বাড়বে।
স্বামীরা প্রতি মাসে তার নিজের বেতনের ১০ থেকে ২০ শতাংশ স্ত্রীদের বেতন দেবেন। এর প্রকৃত ফিগারটি কে যাচাই করবেন? নিশ্চয়ই তার বস? এখানে এই কর্র্মী কি তার সঠিক বেতনের জন্য তার বসের সঙ্গে তর্ক করবেন? আর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে? তার অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে তিনি কি সিক-লিভ নিতে পারবেন? অথবা ক্যাজুয়াল লিভ? এই সময় কি স্বামী অফিস থেকে দ্রুত বাসায় এসে দৈনন্দিনকার কর্ম সারবেন? স্ত্রী তার মায়ের বাসায় যাওয়ার আগে তিনি কি কোনো আবেদনপত্র জমা দেবেন? এসব ছুটিতেও কি তাকে বেতন দেওয়া হবে? বাজারে যাওয়ার জন্য কি তাকে যাতায়াত খরচ প্রদান করা হবে? তাকে কি গ্র্যাচুইটি কিংবা পেনশন দেওয়া হবে? উৎসবের জন্য তিনি কি ফেস্টিভ্যাল বোনাস পাবেন? প্রাসঙ্গিক অথচ অদ্ভুত সব প্রশ্ন আইনটির যৌক্তিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। মোদ্দা কথা, এ ধরনের আইন নারীকে একজন বাধ্য, প্রভুভক্ত 'সার্ভেন্ট' হিসেবে উপস্থাপিত হতে বাধ্য করবে।
দ্বিতীয় বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়া যাক। অর্থনীতিতে 'হাউসহোল্ড' কাজগুলোকে 'আন-পেইড' হিসেবে বিবেচনা করে এসব কাজকে আর্থিকভাবে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। কারণ ভাবা হয়, এর মাধ্যমে সম্পদ উৎপাদন হয় না। কিন্তু এই যুক্তিটা ভুল। কারণ পরিবারেই গড়ে ওঠে শিশুরা। একটি দেশের ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ। সুতরাং সংকীর্ণ অর্থে গৃহকর্মের মাধ্যমে স্বামীরা সুফল ভোগ করে_ এই বিষয়টাও খুবই অযৌক্তিক এবং হাস্যকর। সরকারের ভাষ্যমতে, 'সুফলভোগকারী' স্বামীরাই যদি তার স্ত্রীকে নিজের বেতনের অর্থ প্রদান করেন, তবে এতে পরিবারের মোট আয়ের কোনো পরিবর্তন হয় না। বরং আইনের মাধ্যমে জোর করে এই অর্থ প্রদান করাটা অনেকটাই পরিবারের কাজকর্মের ওপর সরকারের কর আরোপ করার শামিল।
একজন কর্মজীবী নারী যখন 'মা' হতে চলেন তখন তাকে মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রদান করা হয়। উন্নত বিশ্বে এ সময় হবু বাবাদেরও পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয়। আবার সম্প্রতি কিছু দেশে শিশুর জন্মের পর ২৩ মাস পর্যন্ত যে কোনো একজনকে (বাবা কিংবা মা) বাসায় থাকার সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে এবং তাকে সেই ২৩ মাসের বেতন প্রদান করা হয়। এটাকে বলা হয় ক্যাশ ফর কেয়ার (সিএফসি)। ফিনল্যান্ড, নরওয়ে এবং সুইডেনে এটা চালু রয়েছে। সুতরাং গৃহকর্মের আর্থিক স্বীকৃতি দিতে এটাকে 'কর্ম' হিসেবে গণনা করে সরকার তার নিজের খাত থেকে এর জন্য কিছু বরাদ্দ রাখতে পারে।
সামাজিক কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে একজন পুরুষ এবং একজন নারী ঘর বাঁধেন; শুরু করেন একটি নতুন সংসার। এই সংসারটি তাদের দু'জনের এবং দু'জনেরই দায়িত্ব এই সংসারকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই চিত্রটা বেশ খানিকটাই ভিন্ন। এখানে ধরেই নেওয়া হয়, বিয়ের পর একজন নারী 'অধীন' হবেন একজন পুরুষের এবং সেই 'স্বামী'রূপী পুরুষ দায়িত্ব নিলেন 'স্ত্রী'রূপী সেই নারীর নিরাপত্তা, খাওয়া-দাওয়া এবং ভরণপোষণের। পুরো বিষয়টার অর্থ দাঁড়ায়, সামাজিক কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে একজন পুরুষ একটা সংসার পেলেন, যেখানে তিনি নিয়ন্ত্রক, হর্তাকর্তা, ভালো-মন্দ বিচারক, সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক। আর নারীটি হলেন পালনকর্তা।
jannatulruhi@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.