মনের কোণে হীরে-মুক্তো-এক সন্ত্রাসীর মৃত্যু এবং রাজনৈতিক ধারায় ওলটপালট by ড. সা'দত হুসাইন

১৯৬৩ সালে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (অনার্স) শ্রেণীতে ভর্তি হই। ড. ওসমান গনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং মোনেম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। মোনেম খান আইয়ুব খানের খাস লোক। সুবিধাভোগী অন্ধ সমর্থক।


ওসমান গনি মোনেম খানের কাছের মানুষ। দুজন একই জেলার অধিবাসী। আমি অর্থনীতির ছাত্র। ড. এ এন এম আবু মাহ্মুদ অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধান। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার লোক, ঢাকা কুরিয়ারে নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়; বিশাল মাপের বুদ্ধিজীবী হিসেবে সারা দেশে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থনীতি বিভাগের তাঁর সরাসরি ছাত্র হিসেবে আমরা গর্ব অনুভব করতাম। তখন ইন্টারমিডিয়েটে আর্টস গ্রুপের সেরা ছাত্রছাত্রীর প্রায় সবাই অর্থনীতিতে ভর্তি হতো। দু-একজন ইংরেজি, ইতিহাস কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যেত। সায়েন্স গ্রুপের দু-একজন ভালো ফল করা সত্ত্বেও অর্থনীতিতে ভর্তি হতো। আমি তাদের একজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক ছাত্রের পরিচয় ও তার সম্পর্কিত কার্যাবলি আবাসিক হলের মাধ্যমে হয়ে থাকে। আবাসিক ছাত্ররা তো বটেই, এটাচ্ড বা সংযুক্ত ছাত্রদেরও যাবতীয় কাজের জন্য হলে আসতে হয়। এমনকি পরীক্ষার ফলাফলের কাগজপত্রও হলের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হয়। আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। অর্থনীতি বিভাগে ক্লাস করা এবং পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া বাকি কাজ হলের পরিবেশে ও হল কর্তৃপক্ষের আওতাধীনে করতে হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সর্বোচ্চ নির্বাচিত ফোরাম ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (ঢাকসু)। তার পরই ছিল বিভিন্ন হলের নির্বাচিত ছাত্র সংসদ। এই দুই ফোরামই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত এবং প্রত্যেক নির্বাচিত প্রতিনিধি বড় রাজনৈতিক দলের অঙ্গীভূত কোনো ছাত্র সংগঠনের আনুষ্ঠানিক সদস্য। বস্তুত হলের প্রায় প্রতিজন ছাত্র কোনো না কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্য; নির্দলীয় ছাত্রের সংখ্যা খুবই নগণ্য।
আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (ইপসু) সদস্য ছিলাম। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইপসুর কর্তৃত্বাধীন ছিল। আর্টস ফ্যাকাল্টির সেরা ছাত্ররা এই হলে থাকত এবং তাদের সিংহভাগ ইপসুর সদস্য ছিল। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের রেশ তখনো পুরোদমে রয়েছে। রাজনীতিতে সরকারবিরোধী হাওয়া জোরে বইছে। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ এই দুই সংগঠন সরকারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেরা ছাত্র হলেও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের সরকার পছন্দ করে না। সুযোগ পেলেই সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এদের ঝামেলায় ফেলে। ইপসুর সদস্যদের কমিউনিস্ট বলে গালি দেয়।
হলে সরকার সমর্থক একদল ছাত্রের সঙ্গে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-পরিচয় হলো। তাদের দলের নাম ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফ্রন্ট (এনএসএফ)। এ দলের সদস্যদেরও সবাই এনএসএফ বলেই ডাকে। বিরোধী দলের ছাত্ররা এদের সরকার বা আইয়ুব-মোনেমের দালাল বলে জানে। এসএম হলে ছাত্রলীগের সদস্যসংখ্যা যেমনি খুব কম ছিল, তেমনি এদের মধ্যে খুব ভালো ছাত্রের সংখ্যাও তেমন একটা ছিল না। এনএসএফের কয়েকজন সদস্য সেরা ছাত্র ছিল, তবে এ দলের বেশির ভাগ সদস্যই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। এরা ডাইনিং হলে ডাবল কাপ খেত, ক্যাফেটেরিয়াতে বিনা পয়সায় খেতে চাইত, সরকারবিরোধী ছাত্রদের অযথা গালি দিত। অন্য দলের ছেলেদের সঙ্গে বড় রকমের বাগবিতণ্ডা বা মারামারি হলে তাদের লেপ-তোষক, বালিশ ও বইপত্র হলের মাঠে এনে পুড়িয়ে দিত। এককথায় এরা হামবড়া ভাব নিয়ে উদ্ধত আচরণ করত এবং সুযোগ পেলেই নিরীহ সাধারণ ছাত্রদের যন্ত্রণা দিত। এনএসএফের সাধারণ সম্পাদক জমির আলী এসএম হলের বাসিন্দা ছিল, তবে এই হলে কোনো ছাত্রকে ছুরি বা লাঠি দিয়ে আঘাত করেনি। তির্যক ভাষায় বিদ্রূপ করত।
এনএসএফের বড় বড় গুণ্ডা বা সন্ত্রাসীরা ঢাকা হলে (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) অবস্থান করত। এদের মধ্যে কয়েকজন ভালো খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদ ছিল। এরা সুযোগ পেলেই লাঠিসোটা, ছুরি, হকিস্টিক নিয়ে মারামারি করত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়া বাইরের লোকজনকেও এরা আক্রমণ করত। ব্যবসায়ী বা ঠিকাদারদেরও অপহরণ করে ঢাকা হলে আটকে রেখে টাকা-পয়সা আদায় করত। মেয়েদের ধরে এনে হলে নির্যাতন করত বলেও শোনা গেছে। এরাই ড. মাহমুদকে নৃশংসভাবে লাঠিসোটা ও হকিস্টিক দিয়ে মারধর করে মারাত্মক আহত করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ছিল খোকা ও পাঁচপাত্তু। খোকার বাড়ি বগুড়া এবং পাঁচপাত্তুর বাড়ি বরিশাল। খোকাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক বলে চালিয়ে দেওয়া যায়; ছিমছাম গড়ন, পরনে ফুল হাওয়াই শার্ট এবং চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা, চোখে-মুখে রাগ বা হিংস্রতার কোনো চিহ্ন নেই। পাঁচপাত্তু, যার আসল নাম সাইদুর, তার চেহারায় হিংস্রতার ছাপ রয়েছে, যদিও তার গায়ের রং ফর্সা, সুঠাম শরীর, মানানসই চেহারা- চোখে পড়ার মতো। এই দুইজন একসঙ্গে চলাফেরা করে, প্রায় সময়ই একসঙ্গে মারামারি করে। ১৯৬৩-৬৪ সালে এদের উপস্থিতি তত লক্ষণীয় ছিল না। কিন্তু ১৯৬৫-র পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্রই যেন এরা উপস্থিত। ছাত্র-শিক্ষক সবাই এদের ভয়ে তটস্থ। ঢাকা হলের প্রভোস্টের অফিস, তাঁর টেলিফোন- সবই এদের কব্জায়। প্রভোস্ট, হাউস টিউটররা এদের ভয়ে অথবা নিজেরা আইয়ুব, মোনেম, ড. গনি বা সর্বোপরি এনএসএফের সমর্থক বলে এদের পুরোমাত্রায় আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। ফলে এদের সাহস ও শক্তি তুঙ্গে পৌঁছে যায়। যেখানে-সেখানে এরা মারামারি ও সুযোগমতো লুটপাট শুরু করে। এদের অত্যাচারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে ঢাকা হলের আশপাশ একটা ভয়ংকর এলাকায় পরিণত হয়। এখানকার রাস্তা দিয়ে ভালো কাপড়চোপড় পরা মানুষ ও মহিলাদের চলাফেরা রীতিমতো বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে এদের দুজনের নামে অনেক গল্প-কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে। এক জায়গায় প্রতিপক্ষের সাত-আটজন সদস্য পাঁচপাত্তুকে ঘিরে ধরেছিল; সে কাউকে ব্যাক কিক দিয়ে, কাউকে মাথা দিয়ে আঘাত করে বেরিয়ে এসেছে। অন্য জায়গায় ছুরি হাতে এগিয়ে আসা একাধিক প্রতিপক্ষকে পিস্তলের ভয় দেখিয়ে ও একজনের হাত মুচড়ে ধরে তার ছুরি কেড়ে নিয়ে সে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। খোকা সম্পর্কেও এ জাতীয় নানা গল্প-কাহিনী তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মুখে মুখে। ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে এই দুজনই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাদের কীর্তি-কাহিনী নিয়ে প্রতিদিন মুখে মুখে বুলেটিন প্রচার হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবাই এদের অপ্রতিরোধ্য মনে করত, এদের রীতিমতো সমীহ করে চলত।
সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ছাত্র হলেও দিনে ক্লাসের সময় এরা কলা ভবনে ঘুরে বেড়াত। বাইরের সন্ত্রাসীরাও অনুগত অনুসারী হিসেবে এদের পিছে পিছে থাকত। খোকা আবার রফিক নামে এক সাপুড়ে সন্ত্রাসীকে আমদানি করেছিল। সে গলায় বা হাতে সাপ জড়িয়ে খোকার পেছনে চলত। ছাত্রীরা ভয়ে তটস্থ থাকত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বা কোনো শিক্ষক তাদের কিছু বলতে সাহস পেতেন না। দুর্দান্ত প্রতাপে করিডরে ঘুরে শিক্ষক কমনরুম-সংলগ্ন ক্যাফেটেরিয়া অথবা মধুর ক্যান্টিনে হৈচৈ করে চা-নাশতা খেত। কোনো জায়গায় মারামারি বা গণ্ডগোলের গন্ধ পেলে সেখানে দ্রুত উপস্থিত হয়ে যা ইচ্ছে তা করত।
এক দুপুরে শিক্ষক কমনরুমের কাছে বড় রকমের হৈচৈ শোনা গেল। মেরে ফেলল, মেরে ফেলল চিৎকারে একটা ভয়াল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে আমরা এগিয়ে গেলাম। দেখি, এক ছাত্র মাটিতে পড়ে আছে। কাছে গিয়ে বুঝলাম, সে অজ্ঞান হয়ে গেছে। শুনলাম, বারবার তাকে চিৎ করে ওপরে তুলে মাটিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অজ্ঞান হওয়া ছাত্রকে সাধারণ ছাত্ররা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আরেকজন আহত হওয়া ছাত্রের দাঁত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে হাঁটতে পারছে না। এ কাজ খোকা আর পাঁচপাত্তু করেছে। তাদের সঙ্গে আরো দু-একজন থাকতে পারে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে একটা ছোট প্লেট হাতে নিয়ে খোকা পেস্ট্রি খাচ্ছে। তার গায়ে বিস্কুট রঙের ফুল হাওয়াই শার্ট, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক অথবা ফাইনাল ইয়ারের মেধাবী ছাত্র। সৌম্য-শান্ত চেহারা। রাগ ও হিংস্রতার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই। মনে হচ্ছে, সেও একজন দর্শক। একটু দূরে পাঁচপাত্তু দাঁড়ানো। অস্থির ভাব, রাগান্বিত মুখে গজর গজর করছে। যে ছেলেটি বেহুঁশ অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছিল, সে হচ্ছে স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম সংগঠক আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং যাকে দাঁত ভেঙে মারাত্মক আহত করা হয়েছে, সে হলো ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাজহারুল হক বাকী। এত ছাত্র, এত শিক্ষক- কেউ কিছু বলল না, সবাই আস্তে আস্তে নিজের জায়গায় চলে গেল।
আরেক দিনের ঘটনা। কলা ভবনেই আমরা এমএ ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছি। এক ছাত্র নকল করেছে অথবা বড় রকমের কোনো অন্যায় করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক, যত দূর মনে হলো- কেন্দ্রের সুপার, তার খাতা নিয়ে গেলেন। তাকে বহিষ্কার করা হবে। ছাত্রটি সিনিয়র শিক্ষকের পেছনে অনেক ঘোরাঘুরি করল, অনেক অনুনয়-বিনয় করল। কিছুই হলো না। চোখে পানি নিয়ে সে দরজার দিকে গেল। একটু পরেই পাঁচপাত্তু হলে ঢুকল। সিনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলল। দুজনেরই হাসি হাসি ভাব। মনে হলো, অনেক দিনের বন্ধু। সিনিয়র শিক্ষক ছাত্রটির খাতা ফেরত দিল। সে নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিল। পরীক্ষায় তার কোনো অসুবিধা হয়েছে বলে শুনিনি। পাঁচপাত্তুর তদবিরে খুনের আসামি খালাস!
বিরোধীদলীয় তরুণদের মাত্র তিনটি গ্রুপ যাবতীয় প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এদের সঙ্গে সমান তালে টেক্কা দিয়ে চলত। এরা হলো- খসরু-মন্টু গ্রুপ, ফিরু-মহিউদ্দিন গ্রুপ, হাতির পুলের করিম-বেনু-মজনু গ্রুপ। তবে এদের কর্মকাণ্ড হল-পর্যায়ে সীমিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অর্থাৎ বটতলা, আমতলা, কার্জন হল কিংবা সায়েন্স এনেক্স বিল্ডিংয়ে এরা যাতায়াত করত না। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসগুলো খোকা ও পাঁচপাত্তুর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাদের সঙ্গে এনএসএফের পাতি গুণ্ডারাও নাচানাচি করত। এদের ভয়ে বটতলা থেকে কোনো মিছিল-শোভাযাত্রা নিয়ে আমরা রাস্তায় যেতে পারতাম না। বহু দিন মিটিং শেষে আমরা যখন মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরোব, ঠিক সে সময় জানা যেত যে কলা ভবনের (বটতলার) এক গেটে খোকা ও অন্য গেটে পাঁচপাত্তু তাদের সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ভাই এসে চুপে চুপে আমাদের বলতেন যে মিছিল করে বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়, অতএব আমরা যেন একজন-দুজন করে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির মাঠে যাই। সেখানেই ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা জানিয়ে দেওয়া হবে এবং ছোট্ট পরিসরে মিছিল-স্লোগান হবে। মন খারাপ করে আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির দিকে চলে যেতাম। তখন আমাদের মনে হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর কোনো মিছিল-শোভাযাত্রা বের করা যাবে না। ছাত্র আন্দোলনও বোধ হয় ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়বে।
কিন্তু একটি ঘটনা তথা একটি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেল। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে ১৯৬৮ সালের প্রথমার্ধে আমরা বন্ধু-বান্ধবরা দলবলে হল ছেড়ে দিলাম। আমি ছেড়ে দেওয়ার পর পরই আমার রুম, অর্থাৎ জেনারেল সেক্রেটারির জন্য নির্দিষ্ট রুম (নম্বর ১২২) এনএসএফের এক নেতা দখল করে নেয়। আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষক ড. আবু মাহমুদকে ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তিনি চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। আমরা তিন-চার বন্ধু মেস ভাড়া নিয়ে সিএসএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। পাকিস্তান ফিচার্স সিন্ডিকেট নামক একটি সংস্থায় স্বল্প বেতনে চাকরি নিলাম। অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে আমাদের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। যত দূর মনে পড়ে, নভেম্বর মাসের কোনো একদিন প্রথমে লোকমুখে ও পরদিন পত্রিকার খবরে জানতে পারলাম, পাঁচপাত্তুকে সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলের ১২২ নম্বর রুমে মারাত্মকভাবে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা খুবই সঙ্গিন, যেকোনো মুহূর্তেই তার মৃত্যু হতে পারে। তার শরীরে এমনভাবে ছুরি চালানো হয়েছে যে তার স্প্লিন বা প্লীহা প্রায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে, বেঁচে থাকলেও সে আর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না। আমার ধারণা, এনএসএফের কিছু নেতা-কর্মী ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী এতে দারুণ খুশি হয়েছিল। তারা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল, কখন শেষ সংবাদ শুনবে। তাদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। দিন দুয়েকের মধ্যেই পাঁচপাত্তুর জীবন অবসান হলো। বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, সারা ঢাকার লোকই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। পাঁচপাত্তুর মরদেহ বরিশালে সমাধিস্থ করা হলো।
এই একটি মৃত্যু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিকে ওলটপালট করে দিল। এনএসএফের গুণ্ডাদের অপ্রতিরোধ্য বীরত্বের কল্প-গল্প বা 'মিথ'-এর অবসান হলো। এনএসএফের গুণ্ডাপাণ্ডা ও সমর্থকরা আতঙ্কিত। বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো শঙ্কামুক্ত অবস্থায় কর্মতৎপর হয়ে উঠল। এখন আর মিছিল-মিটিংয়ে বাধা দেওয়ার লোক নেই। ছাত্র আন্দোলন আবার দানা বেঁধে উঠল। এনএসএফের এক অংশ ভোল পাল্টে বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে মিশে গেল। মাত্র দুই মাসের মাথায় ১৯৬৯-এর ২০ জানুয়ারি ছাত্রদের বিশাল মিছিলের ওপর গুলি হলো। আমাদের বন্ধু ও সতীর্থ, ছাত্র ইউনিয়নের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী আসাদ শহীদ হলো। ২৪ জানুয়ারি মতিঝিলের স্কুলছাত্র মতিউর শহীদ হলো। আন্দোলন দুর্বার গতি পেল। একের পর এক ঘটনার মধ্যে ড. জোহা, সার্জেন্ট জহুরুল হক শহীদ হলেন। আগরতলা মামলার বিচারকরা পালিয়ে গেলেন। শেখ মুজিব কারামুক্ত হলেন। তাঁকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হলো। মাসখানেকের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের পতন হলো। জেনারেল ইয়াহিয়া খান নতুন সামরিক শাসক হলেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এক নতুন ধারা সৃষ্টি হলো।
মার্কসীয় বিশ্লেষণে 'অবজেকটিভ কন্ডিশন' তৈরি হলে তার ভিত্তিতেই ইতিহাসের নতুন ধারা সৃষ্টি হয়। নতুন অধ্যায় রচিত হয়। দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণে কথাটি বোধ হয় সত্য। তবে ক্লিওপেট্রার একটি মাত্র দর্শন ইতিহাসে অনেক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। ইতিহাসের ধারা স্বল্পমেয়াদের জন্য হলেও পাল্টে দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনা হলেও পাঁচপাত্তুর মৃত্যু পাকিস্তানের ইতিহাসের এক 'টার্নিং পয়েন্ট'। এ মৃত্যু না হলে ঊনসত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় রকমের ছাত্র আন্দোলন হতো কি না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। বড় ধরনের ছাত্র আন্দোলন না হলে গণ-অভ্যুত্থান হতো কি না তা-ও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। এখনো কোনো ইতিহাস পাঁচপাত্তুর মৃত্যুকে যথাগুরুত্ব দিয়ে লিপিবদ্ধ করেনি। এটি করা উচিত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা পাঁচপাত্তুকে বধ করেছে, তাদের খুঁজে পাওয়া হয়তো খুবই কষ্টকর হবে। তবে সুনিশ্চিতভাবে খুঁজে পাওয়া গেলে তাদের যথাযথ মর্যাদায় সম্মানিত করা সমীচীন হবে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান পিএসসি ও
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

No comments

Powered by Blogger.