পদ্মা সেতু-আরো অনেক পথ বাকি by আরিফুর রহমান

ঋণচুক্তি বাতিল করার তিন মাসের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার ঘোষণায় আশার আলো দেখা গেলেও নতুন পূর্বশর্তগুলো পূরণ করে অর্থছাড়ের পর্যায়ে যাওয়া পর্যন্ত আরো কিছু পথ পার হতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ বিবৃতির ভাষা ও সংস্থাটির দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতা বিবেচনা করে এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।


বিশ্বব্যাংক গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, সরকার যেসব পদক্ষেপের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে সেগুলোর 'সন্তোষজনক বাস্তবায়নের' পর তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পে নতুন করে সম্পৃক্ত হবে। এতে সংস্থাটির গভর্নিং বডির সমর্থন লাগবে। পুরনো চুক্তিই পুনরুজ্জীবিত হবে, নাকি নতুন করে চুক্তি করতে হবে, বিবৃতিতে তা বলা হয়নি। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল আগামী সপ্তাহে ঢাকায় আসবে। তারা কী বিষয়ে আলোচনা করবে, স্বাধীন প্যানেলে কারা থাকবেন, সহযোগী অন্য সংস্থাগুলোর ভূমিকা কী হবে- এসব নির্ধারণ করে ঠিক কবে নাগাদ কাজ শুরু করা যাবে তা স্পষ্ট নয়।
২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার চুক্তি করেছিল বিশ্বব্যাংক। পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির তদন্তে সরকার সহযোগিতা করছে না- এমন অভিযোগ দেখিয়ে সংস্থাটি ২৯ জুন ঋণচুক্তি বাতিল করে। তাদের দেওয়া সব শর্ত সরকার পূরণ করায় ফিরে আসতে সম্মত হয়েছে সংস্থাটি। গতকাল (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার ভোরে এবং ওয়াশিংটন সময় বৃহস্পতিবার দুপুর) বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের এ সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে জাইকা, এডিবি ও আইডিবিকে মৌখিকভাবে জানিয়েছে সংস্থাটি। তবে বিশ্বব্যাংকের পথ চেয়ে বসে থাকা এ দুটি সংস্থা এখনো তাদের অবস্থান জানায়নি। এ প্রকল্পে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ৪০ কোটি ডলার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬১ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার চুক্তি করেছে। জাইকার ঋণ চুক্তির মেয়াদ গতকাল শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
জাইকা বাংলাদেশ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়ার পরই সংবাদ ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জাইকার বক্তব্য তুলে ধরা হবে।
আর এডিবি বাংলাদেশ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক সম্পৃক্ত হচ্ছে বলে মৌখিকভাবে এডিবিকে জানিয়েছে সংস্থাটি। ওয়েবসাইটে দেওয়া বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি পর্যবেক্ষণ করছে এডিবি। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এমন কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তাই এখনই এডিবির পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি দেওয়া হবে না।
বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে বাংলাদেশ সফরে আসছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রতিনিধিদল দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত জানালেও এর সঙ্গে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। গতকাল বিশ্বব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সরকার নতুনভাবে পূর্বশর্ত হিসেবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো গ্রহণে ইতিমধ্যে সম্মতি জানিয়েছে। এগুলো হচ্ছে : নতুন ক্রয় ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করতে হবে। অর্থাৎ সেতুর নির্মাণকাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নতুন ক্রয় ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাংকসহ অন্য তিন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাকে অধিকতর ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দিতে হবে। এ ছাড়া সুষ্ঠু, অবাধ ও দ্রুত তদন্তকাজ চালিয়ে যেতে হবে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তদের ছুটিতে পাঠাতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অধীনে একটি তদন্তদল গঠন করতে হবে। তদন্ত পর্যালোচনা করে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের কাছে এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রদানের জন্য একটি স্বাধীন এঙ্টারনাল প্যানেল গঠন করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ একটি প্যানেল গঠন করে নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসাটা সুখবর। আগামী দিনে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের দুই বিষয়ে আলোচনা হবে। প্রথমত, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, এর তদন্তকাজ কিভাবে চলবে। এ ছাড়া প্যানেলে থাকা বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি এ তদন্তকে কিভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। এসব বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হওয়ার প্রয়োজন হবে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, এ সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি কিভাবে বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পটিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে করণীয় ঠিক করতে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। সে ক্ষেত্রে ক্রয় ব্যবস্থপনায় যাতে কোনো ধরনের দুর্নীতি না হয়, সে বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। তিনি আরো বলেন, প্রকল্পটির অর্থায়ন যেহেতু বাতিল করা হয়েছিল, পুনরায় ফিরে আসায় তা বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে। তবে সেটি শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্যই।
গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের প্রধান নির্বাহী ড. রাশেদ আল মাহমুদ বলেন, অর্থায়ন নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা নীতি প্রক্রিয়ার দ্বারা। এ ক্ষেত্রে হচ্ছে উল্টো। এখানে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানই নীতি নির্দেশ করছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তাতেই কয়েক বছর আগে সরকারি ক্রয়নীতি প্রণীত হয়েছিল। এখন সেই ক্রয়নীতিতে তারাই আস্থা রাখতে পারছে না। সেখানে 'গ্রেটার ওভারসাইট'-এর কথা বলছে। তাহলে প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের হাতে আর কী থাকল!
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাজ করেছেন এমন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ইতিবাচক। এ ছাড়া সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরে আসার খবরটিও ইতিবাচক। তবে সংস্থাটির দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী দুটি শর্ত আগামী কয়েক দিনের প্রধান আলোচ্য বিষয় হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিন সদস্যের এঙ্টারনাল প্যানেলে কারা থাকবেন? যে তিনজনকে এ প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সে বিষয়ে দুই পক্ষকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। এ ছাড়া দুদকের সঙ্গে এঙ্টারনাল প্যানেলের সম্পর্কের ধরন কী হবে? এ বিষয়ে একটি পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে হবে। দ্বিতীয় শর্তটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নতুন ক্রয় ব্যবস্থাপনা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া ক্রয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে চার উন্নয়ন সংস্থার নিবিড় পর্যবেক্ষণ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তাও এখনো স্পষ্ট নয়। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান, মূল্যায়ন ও দরপত্রের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রণয়ন করে থাকে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। অর্থাৎ বাস্তবায়নকারী সংস্থা এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। এখন নতুন ক্রয় ব্যবস্থাপনা বলতে এ কাজগুলো চার উন্নয়ন সহযোগীর সমন্বয়ে করা হবে বলে মনে হচ্ছে। এ বিষয়ে উভয় পক্ষকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাজ করা আরেক কর্মকর্তা জানান, আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি চুক্তি সই করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে সেটি মুখ্য বিষয় নয়। কারণ পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসার ঘোষণা প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের পক্ষ থেকে এসেছে। তিনি বলেন, গত ২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক তাঁর চাকরিজীবনের শেষ কর্মদিবসে নিজ ক্ষমতাবলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি বাতিল করেছেন। আবার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম নিজ ক্ষমতাবলে বাতিল হওয়া ঋণচুক্তি পুনর্বহাল করেন।

No comments

Powered by Blogger.