সদরে অন্দরে-জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে দড়ি টানাটানি নয় by মোস্তফা হোসেইন

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস জনশক্তি রপ্তানিতেও টানাপড়েন চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং এ দেশীয় জনশক্তি রপ্তানিকারকদের অনেকেরই অসাধু পথ অবলম্বনের কারণে এই খাতে বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে।


কারণ অনুসন্ধান করে সেই অনুযায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পেশ করার পরও অচলাবস্থার সম্পূর্ণ অবসান হয়নি। যদিও কিছুটা আশার আলো দেখা দিয়েছে সম্প্রতি। অনেক প্রচেষ্টার ফলে মালয়েশিয়া চোখ মেলে তাকিয়েছে। গত মে মাসে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল মালয়েশিয়া সফরের মাধ্যমে নেতিবাচক মানসিকতার পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী সে দেশের মানবসম্পদমন্ত্রী ড. এস সুব্রানিয়ম বাংলাদেশ সফর করে আরেক ধাপ এগিয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু এবার দেখা দিয়েছে অভ্যন্তরীণ সমস্যা। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বেঁকে বসেছে সরকারের একটি সিদ্ধান্তের কারণে। সরকার চাইছে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি হবে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। বায়রা বলছে, তাদের হাতে তুলে দিতে হবে রপ্তানির পুরো স্বত্ব। সর্বশেষ তারা ঘোষণা করেছে, মালয়েশিয়ায় যদি তাদের জনশক্তি রপ্তানি করতে দেওয়া না হয়, তাহলে তারা অন্য দেশেও রপ্তানি বন্ধ করে দেবে।
হারিয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ার বাজার ফিরে পাওয়ার কারণে সাধারণ্যে স্বস্তি এসেছে। আবার যখন মানুষ জানতে পারল, মাত্র ৫০ হাজার টাকা হলেই মানুষ সেখানে চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়া যেতে পারবে তখন সংগত কারণেই আশার মাত্রাটা বেড়ে গিয়েছে একটু বেশি। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা সরকারের কাছে যে দাবি তুলে ধরেছে তাতে মালয়েশিয়ায় গমনেচ্ছুদের হোঁচট খেতে হচ্ছে। তাদের দাবি হচ্ছে, এ ব্যবসার সঙ্গে কয়েক হাজার মানুষ জড়িত এবং তারা এই রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিত শক্তিশালী করতে অবদান রাখছে। সরকারের সামনে অবশ্যই প্রশ্ন থাকবে- সরকার কি কয়েক হাজার ব্যবসায়ীর স্বার্থ দেখবে নাকি পাঁচ লাখ বিদেশগামী মানুষের স্বার্থ দেখবে। আরো স্পষ্ট করে বললে, সরকার কি সামগ্রিকভাবে জনস্বার্থ বিবেচনা করবে নাকি স্বল্পসংখ্যক লোকের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার সুযোগ করে দেবে। সরকার যদি কলাগাছ বনে যাওয়া মানুষের স্বার্থ দেখার চেয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে বড় করে দেখতে চায়, তাহলে মালয়েশিয়ায় পাঁচ লাখ শ্রমিক পাঠানোর দায়িত্বটা সরকারের হাতেই রাখতে হবে। আবার বায়রাকেও সুযোগ দিতে হবে- যা এখন অবারিত আছে। অর্থাৎ বাকি বিশ্বের শ্রমবাজারে লোক পাঠানোর সুবিধা তাদের হাতেই রেখে দিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, মালয়েশিয়ায়ও বেসরকারি পর্যায়ে আরো যদি লোক পাঠানোর সুযোগ থাকে, তাহলেও বায়রা সেখানে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। সেই সুযোগটিও তাদের দিতে হবে।
বিদেশে শ্রমিক রপ্তানির ক্ষেত্রে বেসরকারি রপ্তানিকারকদের প্রাধান্য থাকবে এবং আছেও। কিন্তু সবচেয়ে টানাপড়েন আর দুর্ভোগের শ্রমবাজার মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে তাদের দাবি নিয়ে কথা উঠতেই পারে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজারের পরিস্থিতি ভালো নয়। এর কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বেসরকারি রপ্তানিকারকদের সততার অভাবই শীর্ষে অবস্থান করে। তাঁদের দুর্নীতি এবং প্রতারণার কারণে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার একাধিকবার হারিয়েছে। শ্রমবাজার হারানোর পাশাপাশি সে দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে হলে সেখানে রপ্তানিপ্রক্রিয়া পরিবর্তন অপরিহার্য। ১৯৯৬ সালে সে দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রথম। তখন থেকেই যদি সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করত, তাহলে হয়তো পরবর্তী সময়ে এতটা তিক্ততায় পৌঁছত না বাজার পরিস্থিতি। আমরা দেখলাম, ২০০৩ সালে সরকারিভাবে সমঝোতা চুক্তি হলো। কিন্তু সেই চুক্তিও আলোর মুখ দেখল না। পেরিয়ে গেল আরো তিন বছর। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়োগ থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে মালয়েশিয়া। দীর্ঘদিন পর ফিরে পাওয়া বাজারটি ধরে রাখার জন্য সরকারি প্রচেষ্টা এবং জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সততা ও আন্তরিকতা সেখানেও মার খেল। মাত্র বছরখানেকের মধ্যে মালয়েশিয়া আবারও বাংলাদেশের শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয়। অবিশ্বাস আর দুর্নামের ছাপ পড়ে বড় করে। আরো বছরকাল চলে যায় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সেই বিশ্বাসও ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে আবার বন্ধ হয়ে যায় সে দেশে শ্রমিক রপ্তানি।
যেসব কারণে বাংলাদেশের প্রতি এই অবিশ্বাস ও অনাস্থা তা রীতিমতো দুর্ভাগ্যজনক। একশ্রেণীর মুনাফালোভী জনশক্তি রপ্তানিকারকের কারণে সাধারণ্যে তাদের নাম ব্যবসায়ীর পরিবর্তে আদম ব্যাপারি হয়ে দাঁড়ায়। আর এমন সুন্দর এবং দেশগঠনমূলক ব্যবসাটিকে মানুষ হেয় চোখে দেখতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা জন্মায়, জনশক্তি রপ্তানিকারক বলতেই বুঝি প্রতারণা আর অসততায় ভরপুর একটি পেশা। এটা এই দেশে যেমন, তেমনি মালয়েশিয়ায়ও প্রতিষ্ঠা পায়। যার প্রমাণ বারবার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া।
বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শ্রমিকদের অসদাচরণের কথা। শ্রমিকদের কারো কারো মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ করা গেছে- এটা স্বীকার করতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনিয়ম ও বেআইনি কাজ করার পেছনে কাজ করেছে অনিবার্য কিছু পরিস্থিতি। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রায় সর্বাংশে দায়ী একশ্রেণীর আদম ব্যাপারি। এই আদম ব্যাপারিরা দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে সে দেশে শ্রমিক পাঠিয়েছে। লোভনীয় পারিশ্রমিকের লোভ দেখানোর কারণে মানুষ ভিটে-মাটি বিক্রি করে সে দেশে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত পারিশ্রমিক না পাওয়া এবং ওখানকারও কিছু কিছু মালিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুবিধা না দেওয়ার কারণে শ্রমিকরা কোথাও ক্ষুব্ধ হয়েছে, কোথাও চুক্তি ভঙ্গ করে অন্যত্র বেশি বেতনের চাকরি খোঁজার মতো নিয়মবহির্ভূত কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, মালয়েশিয়ায় কর্মরত শ্রমিকদের বেশির ভাগই এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। আর এ কাজের দায় জনশক্তি রপ্তানিকারকরা অস্বীকার করতে পারবেন না।
মালয়েশিয়ায় এখন বাংলাদেশের সাত লাখ শ্রমিক কাজ করেন। সেখানে আরো পাঁচ লাখ শ্রমিক নেওয়া হবে। সংগত কারণেই মালয়েশিয়া বাংলাদেশের বড় একটি শ্রমবাজার হিসেবে গণ্য। এ পরিস্থিতিতে আবার যদি মানুষ দালালচক্রের হাতে প্রতারিত হয়, তাহলে গুরুত্বপূর্ণ এই বাজারটি চিরদিনের জন্য হারাতে হতে পারে।
এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্য এখন সোনার হরিণের মতো। এরপর যদি মালয়েশিয়ার বাজারটিও হারায়, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় মাধ্যমটি লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। তাই সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অন্তত চলতি পাঁচ লাখ শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থাটি করা হোক।
তবে সেখানে চাকরিপ্রার্থীদের যাতে ৫০ হাজার টাকার পরিবর্তে দুই লাখ টাকা খরচ করতে না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। হয়রানিতে যাতে কেউ না পড়ে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
যে মুহূর্তে সরকার জানিয়েছে বিমান ভাড়া ছাড়া সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা খরচ করলেই একজন শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন, তখন বায়রার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এখানেও সরকার ব্যবসা করবে। সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, এর আগে সরকারের কাছে প্রস্তাবনায় এই বায়রাই উল্লেখ করেছে, তারা এক লাখ ২০ হাজার টাকায় শ্রমিক রপ্তানি করতে চায়। তাহলে ধরা যাক, ২০ হাজার টাকায়ই রপ্তানি সম্ভব। এর সঙ্গে বিমান ভাড়া ৩৫ হাজার টাকা যোগ হলে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৫৫ হাজার টাকা। তাহলে বায়রার এক লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করার পেছনে কি অতিরিক্ত লোভই প্রমাণিত হয় না? এর পরও সত্য হচ্ছে, তাদের যদি এক লাখ ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে লোক পাঠানোর সুযোগও দেওয়া হয় তারা কি এর দ্বিগুণ ও তিন গুণ টাকা আদায় করবে না? এমন প্রমাণ তো তারা মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে আগেই।
এখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্টত উল্লেখ করা প্রয়োজন। মালয়েশিয়া সরকারই চাইছে, জনশক্তি রপ্তানি করতে হবে বাংলাদেশের সরকারের ব্যবস্থাপনায়। সেখানে কি বায়রাকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশ আবারও বিরাগভাজন হবে?
বায়রার মাধ্যমে যদি লোক পাঠানো হয়, তাহলে জেলা পর্যায়ের সব মানুষ এই সুযোগ পাবে না। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে নেওয়া হলে সবার সুযোগ থাকবে। কারণ প্রতিটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে এই কাজ সমন্বয় করার কথা। সরকারিভাবে করলে সাধারণ মানুষের তাই আনুষঙ্গিক ব্যয়ও কমে যাবে। সুতরাং মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি সরকারিভাবেই করা উচিত, বায়রার জন্য বাকি দুনিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত থাকুক। সরকারি সহযোগিতায় তারা নতুন বাজার অনুসন্ধান করুক, সেখানে শ্রমশক্তি রপ্তানি করুক- এমন প্রত্যাশাই করা যায়।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.