আলোর ইশারা-পদ্মা সেতু প্রকল্প :এখন সব কাজ দ্রুত করতে হবে by আইনুন নিশাত
টেলিভিশনে খবর দেখছি আর খবরের কাগজের পাতায় পড়েছি যে, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক ফিরে আসছে। কয়েকদিনের মধ্যেই বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করবে। সমগ্র দেশবাসীর সঙ্গে এ খবরে আমিও অত্যন্ত আনন্দিত।
যারা বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাদের সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
খবর সংবাদমাধ্যমে আসার পরই এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বর্তমান অবস্থান কী, তা বোঝার জন্য ইন্টারনেটে ঢুকেছিলাম। বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে কয়েকটি সূত্র পেলাম। ওইসব সূত্র আমাকে একটি ব্লগে নিয়ে গেল। ইউটিউবের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকায় ব্লগে অবশ্য ঢুকতে পারলাম না। এরপর বিশ্বব্যাংকের একটি প্রেস স্টেটমেন্ট পেলাম যেটি ওয়াশিংটন থেকে তাদের ২০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকাতে আমরা গতকাল বা ২১ সেপ্টেম্বর পেয়েছি। দেখেশুনে মনে হলো, খবরাখবর সত্য। এবারের মতো ঝামেলা মিটে গিয়েছে। এখনকার প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কী হবে এবং কত দ্রুত আমরা পদ্মা সেতুর কাজকর্ম যেখানে থেমে গিয়েছিল সেখান থেকে আবার শুরু করতে পারব?
প্রসঙ্গত, এর আগে সমকালের পাতায় একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু থেকে সরে যাওয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কী করতে হবে আমার আজকের বিষয় সেটা। প্রকল্প বাস্তবায়নে যদি কোনো কারণে ধীরগতি চলে আসে, তার সম্ভাব্য কারণও চিহ্নিত করতে চেষ্টা করব এই কিস্তিতে।
আমার মনে হয়, প্রথমেই আসবে সুপারভিশন কনসালটেন্ট নির্বাচনের বিষয়টি। কানাডার যে কোম্পানিটিকে মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থেকেই সব গোলযোগের সূত্রপাত। বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে এদের কালো তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশ সরকারও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গ্রুপটিকে কোনোভাবে বিবেচনায় না আনার কথা বলেছে। কাজেই কোম্পানিটিকে কাজ না দেওয়ার বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এখন প্রশ্ন হতে পারে, আবার কি নতুন করে পরামর্শ প্রদায়ী উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের কাজ হাতে নিতে হবে? নাকি বর্তমানে যারা দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে তাদের কাজটি দিয়ে দেওয়া যেতে পারে? আমি যতদূর বুঝি, বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব আইনের মাধ্যমেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে। এখন সেই প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন এবং এই কাজে প্রধান দাতাগোষ্ঠীগুলোর পূর্ণ অংশগ্রহণ ও সম্মতি প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ সরকার সে ব্যাপারে যত তৎপর হবে, পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ তত দ্রুত শুরু করা যাবে।
মনে রাখতে হবে, নির্মাণ তদারকিতে ওই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা থাকবে সর্বপ্রধান। ওই কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানই সব কন্ট্রাক্ট পরিচালনা করবে, কোয়ালিটি কন্ট্রোল করবে, কাজের অগ্রগতি অর্জনে সচেষ্ট থাকবে। কাজ করতে গিয়ে ডিজাইনের কোনো পরিবর্তন করতে হলে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। ডিজাইন পরিবর্তিত করা হলে বাড়তি খরচ তারা ঠিক করে দিলে সেটি দিতে সরকার বাধ্য থাকবে। সরকার ও ঠিকাদারের মধ্যে যে কোনো কাজে এবং যে কোনো ধরনের কাজে মতবিরোধ হলে তাদের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে। যে কারণে নির্মাণ কাজ তদারককারী সংস্থাটির নির্বাচন প্রক্রিয়া গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
তিনটি প্রধান বিষয় বিবেচনা করে তদারকি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে হবে। প্রথমত, এ ধরনের কাজ তদারকিতে তাদের অভিজ্ঞতা কতখানি। দ্বিতীয়ত, এই কাজে যেসব বিশেষজ্ঞ তারা নিয়োজিত করবেন, তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা এবং এ কাজ করতে তাদের যে পরিমাণ সম্মানী ও খরচ প্রদান করতে হবে তার পরিমাণ। যেহেতু এই পরামর্শ প্রদানকারী সংস্থা নির্বাচনের কাজটি থেমে গেছে অনেকদিন হলো; কাজেই অবিলম্বে বিশ্বব্যাংকের মত নিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এ কাজে আর যাই হোক, কালক্ষেপণ করা চলবে না। তাহলে গোটা নির্মাণ প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এরপরের বিষয়টি আসে মূল সেতু এবং নদীশাসনে ঠিকাদার নির্বাচনের কাজ। এ দুটি কাজের জন্যই সম্ভাব্য ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা সম্পন্ন করা হয়েছে। টেকনিক্যাল ইভালুয়েশন কমিটির মতামত বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছে। এখন তা বিশ্বব্যাংককে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। সে জন্য অপেক্ষা যাতে দীর্ঘায়িত না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্টরা মনোযোগ দেবেন আশা রাখি। আমার যতটুকু জানা, তাতে প্রাক-নির্বাচিত ঠিকাদারদের তালিকা বিশ্বব্যাংকের কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। তারা দুটি কাজেই কিছু ক্লারিফিকেশন বা ব্যাখ্যা চেয়েছিল। সেটাও দেওয়া হয়েছে। কাজেই এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা কাজ হাতে নিলে সরকারের তরফ থেকে অনুরোধ যাওয়া উচিত যে, তালিকা দুটি যত দ্রুত সম্ভব চূড়ান্ত করতে হবে। এরপর মূল টেন্ডার দুটি প্রাক-নির্বাচিত ঠিকাদারদের কাছে পাঠিয়ে প্রস্তাব সংগ্রহ করতে হবে। অবশ্য ঠিকাদারদের প্রস্তাব জমা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। কারণ তারা মূল ডিজাইনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পরামর্শ দিতে পারে। এই পর্যায়ে এমন পরামর্শের নজির রয়েছে। এরপর আসবে নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে অ্যাপ্রোচ রোডের বিষয়টি। পশ্চিম পাড়ের ঠিকাদার নির্বাচিত হয়ে আছে এবং প্রকল্পের এই অংশটুকু ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক অর্থায়ন করবে। বিশ্বব্যাংক কাজ হাতে নিলে আইডিবিও তাদের কার্যক্রম শুরু করবে বলে আশা করছি। অন্যদিকে ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ইত্যাদি কাজ এগিয়ে চলছে এবং এই কাজে কোনো অভিযোগ শুনিনি।
এটা ঠিক, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন সম্পন্ন করতে গিয়ে আমাদের বেশ ভোগান্তি হলো। আবার সেখান থেকে অনেক কিছু শেখারও আছে। গোটা ব্যাপারটিকে দুর্ভাগ্যজনক অতীত হিসেবে মেনে নিয়ে এখনকার কর্তব্য হচ্ছে অর্জিত শিক্ষা ভবিষ্যতে কাজে লাগানো। পদ্মা সেতু ইস্যুতে আগ্রহীরা যদি বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে চান, তাদের বলব অর্থায়নের ঘোষণা, স্থগিতাদেশ ও পুনঃছাড় সম্পর্কিত তিনটি প্রেস রিলিজ মনোযোগ দিয়ে পাঠ করা। প্রথমটি হচ্ছে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালের; দ্বিতীয়টি ২১ জুন ২০১২ এবং তৃতীয়টি ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক প্রকাশ করেছে।
প্রথমটিতে বিশ্বব্যাংক সেতু নির্মাণে তাদের অর্থায়নের কথা ঘোষণা করছে এবং একই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার কথা ঘোষণা করছে। এক পৃষ্ঠার এই প্রেস রিলিজে ঘুরেফিরে প্রকল্পের প্রতিটি স্তরে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথা বলা হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, এ জন্য সরকারের সঙ্গে মিলে একটি গভর্ন্যান্স অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যাকশন প্লান তৈরি করা হবে, যার মাধ্যমে কোনো ধরনের জালিয়াতি বা দুর্নীতি হতে দেওয়া হবে না। কাজের গুণগত মান বজায় থাকবে এবং সব কাজে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে। তারা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশ সরকারের রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্টের সূত্র ধরে সব তথ্যই প্রকাশযোগ্য হবে। জবাবদিহি অর্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের বিস্তারিত বিবরণ সেখানে রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য যে সেতুটি অপরিহার্য এ কথাও সেখানে ঘোষণা করা হয়েছে এবং আশা প্রকাশ করা হয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক যোগাযোগে সেতুটি বিরাট ভূমিকা রাখবে। তার মানে, প্রায় দেড় বছর আগে বিশ্বব্যাংক যেসব বিষয়ের ওপর নজর দিয়েছিল এবং দেওয়ার জন্য আমাদের আহ্বান করেছিল হয়তো সেগুলো আমরা ঠিকমতো প্রতিপালন করলে এত ঝামেলা হতো না।
দ্বিতীয় প্রেস রিলিজটিতে বিশ্বব্যাংক কেন তাদের অর্থায়নের প্রস্তাব প্রত্যাহার করছে তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছে। তারা বলেছে, তাদের তিনটি শর্ত পূরণ হলেই তারা প্রকল্পটি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে। দেখে ভালো লাগছে যে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সরকার তা পূরণ করেছে এবং বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে তাদের তৃতীয় প্রেস রিলিজে। অবশ্য শেষোক্তটিতে বিশ্বব্যাংক চতুর্থ একটি শর্তও জুড়ে দিয়েছে। তাহলো ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থলগি্নকারী সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি। তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন টেন্ডার চূড়ান্ত করার কাজে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে চায়। তারা একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন এক্সটারনাল প্যানেল বসাতে চায় যারা দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে। আমি আশা করব, এ পর্যালোচনা কাজের জন্য অন্য কোনো কাজ আটকে থাকবে না। পর্যালোচনা ও নির্মাণ প্রক্রিয়া সমান্তরালভাবে চলবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বছরখানেকের যে জটিলতা, তাতে বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে সব ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা বজায় রাখা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা আবশ্যকীয় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে_ তা দেশীয় অর্থায়ন বা দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নই হোক। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের বৃহৎ প্রকল্পে বিশ্বজুড়ে আরও দুটি শর্ত যোগ হচ্ছে। প্রথমত, সব স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত প্রচলিত আইনের সংস্কার করেছে। সেখানেও এসব বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। কাজেই কেউ যদি বলেন, নিয়ম-কানুনের দিক থেকে আমাদের দেশীয় আইনে দুর্বলতা রয়েছে_ এটি ঠিক নয়। যেটা প্রয়োজন হচ্ছে তা হলো কাজে-কর্মে আইনের প্রতিফলন ঘটানো।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, যে কোনো অভিযোগ সময়মতো নিষ্পত্তি করা। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে যদি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ সময়মতো আমলে নেওয়া হতো, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় এড়ানো সম্ভব ছিল। নির্মাণের ক্ষেত্রেও কিন্তু সময়কাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রমত্তা পদ্মায় বর্ষাকালে নির্মাণ কাজ করা দুরূহ। কাজেই পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজটি আবার হাতে নেওয়ার আগে প্রথমে যে কাজটি করতে হবে তা হলো একটি বাস্তবমুখী টাইমটেবল বা সময়সূচি করা ও তা ধরে রাখা। আগামী শুষ্ক মৌসুমে কাজ হাতে নেওয়া সম্ভব হবে না। ঠিকাদার নির্বাচনেই তা পার হয়ে যাবে। তবে কয়েক মাসের মধ্যে এ কাজ সম্পন্ন করা গেলে নির্বাচিত ঠিকাদারদের মোবিলাইজেশনের কাজ সম্পন্ন করতে অনুরোধ করা যেতে পারে। আমি আশা করব, সেতু কর্তৃপক্ষ এবং অর্থলগি্নকারী সংস্থাগুলো দ্রুত তৎপর হবে এবং ক'দিন দেরিতে হলেও সেতু নির্মাণে আর কালক্ষেপণ হবে না। সব কাজই দ্রততার সঙ্গে সম্পন্ন হবে। সব পক্ষ আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হলে তা অসম্ভব নয়।
অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত : পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
খবর সংবাদমাধ্যমে আসার পরই এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বর্তমান অবস্থান কী, তা বোঝার জন্য ইন্টারনেটে ঢুকেছিলাম। বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে কয়েকটি সূত্র পেলাম। ওইসব সূত্র আমাকে একটি ব্লগে নিয়ে গেল। ইউটিউবের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকায় ব্লগে অবশ্য ঢুকতে পারলাম না। এরপর বিশ্বব্যাংকের একটি প্রেস স্টেটমেন্ট পেলাম যেটি ওয়াশিংটন থেকে তাদের ২০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকাতে আমরা গতকাল বা ২১ সেপ্টেম্বর পেয়েছি। দেখেশুনে মনে হলো, খবরাখবর সত্য। এবারের মতো ঝামেলা মিটে গিয়েছে। এখনকার প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কী হবে এবং কত দ্রুত আমরা পদ্মা সেতুর কাজকর্ম যেখানে থেমে গিয়েছিল সেখান থেকে আবার শুরু করতে পারব?
প্রসঙ্গত, এর আগে সমকালের পাতায় একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু থেকে সরে যাওয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কী করতে হবে আমার আজকের বিষয় সেটা। প্রকল্প বাস্তবায়নে যদি কোনো কারণে ধীরগতি চলে আসে, তার সম্ভাব্য কারণও চিহ্নিত করতে চেষ্টা করব এই কিস্তিতে।
আমার মনে হয়, প্রথমেই আসবে সুপারভিশন কনসালটেন্ট নির্বাচনের বিষয়টি। কানাডার যে কোম্পানিটিকে মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থেকেই সব গোলযোগের সূত্রপাত। বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে এদের কালো তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশ সরকারও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গ্রুপটিকে কোনোভাবে বিবেচনায় না আনার কথা বলেছে। কাজেই কোম্পানিটিকে কাজ না দেওয়ার বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এখন প্রশ্ন হতে পারে, আবার কি নতুন করে পরামর্শ প্রদায়ী উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের কাজ হাতে নিতে হবে? নাকি বর্তমানে যারা দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে তাদের কাজটি দিয়ে দেওয়া যেতে পারে? আমি যতদূর বুঝি, বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব আইনের মাধ্যমেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে। এখন সেই প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন এবং এই কাজে প্রধান দাতাগোষ্ঠীগুলোর পূর্ণ অংশগ্রহণ ও সম্মতি প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ সরকার সে ব্যাপারে যত তৎপর হবে, পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ তত দ্রুত শুরু করা যাবে।
মনে রাখতে হবে, নির্মাণ তদারকিতে ওই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা থাকবে সর্বপ্রধান। ওই কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানই সব কন্ট্রাক্ট পরিচালনা করবে, কোয়ালিটি কন্ট্রোল করবে, কাজের অগ্রগতি অর্জনে সচেষ্ট থাকবে। কাজ করতে গিয়ে ডিজাইনের কোনো পরিবর্তন করতে হলে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। ডিজাইন পরিবর্তিত করা হলে বাড়তি খরচ তারা ঠিক করে দিলে সেটি দিতে সরকার বাধ্য থাকবে। সরকার ও ঠিকাদারের মধ্যে যে কোনো কাজে এবং যে কোনো ধরনের কাজে মতবিরোধ হলে তাদের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে। যে কারণে নির্মাণ কাজ তদারককারী সংস্থাটির নির্বাচন প্রক্রিয়া গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
তিনটি প্রধান বিষয় বিবেচনা করে তদারকি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে হবে। প্রথমত, এ ধরনের কাজ তদারকিতে তাদের অভিজ্ঞতা কতখানি। দ্বিতীয়ত, এই কাজে যেসব বিশেষজ্ঞ তারা নিয়োজিত করবেন, তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা এবং এ কাজ করতে তাদের যে পরিমাণ সম্মানী ও খরচ প্রদান করতে হবে তার পরিমাণ। যেহেতু এই পরামর্শ প্রদানকারী সংস্থা নির্বাচনের কাজটি থেমে গেছে অনেকদিন হলো; কাজেই অবিলম্বে বিশ্বব্যাংকের মত নিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এ কাজে আর যাই হোক, কালক্ষেপণ করা চলবে না। তাহলে গোটা নির্মাণ প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এরপরের বিষয়টি আসে মূল সেতু এবং নদীশাসনে ঠিকাদার নির্বাচনের কাজ। এ দুটি কাজের জন্যই সম্ভাব্য ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা সম্পন্ন করা হয়েছে। টেকনিক্যাল ইভালুয়েশন কমিটির মতামত বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছে। এখন তা বিশ্বব্যাংককে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। সে জন্য অপেক্ষা যাতে দীর্ঘায়িত না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্টরা মনোযোগ দেবেন আশা রাখি। আমার যতটুকু জানা, তাতে প্রাক-নির্বাচিত ঠিকাদারদের তালিকা বিশ্বব্যাংকের কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। তারা দুটি কাজেই কিছু ক্লারিফিকেশন বা ব্যাখ্যা চেয়েছিল। সেটাও দেওয়া হয়েছে। কাজেই এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা কাজ হাতে নিলে সরকারের তরফ থেকে অনুরোধ যাওয়া উচিত যে, তালিকা দুটি যত দ্রুত সম্ভব চূড়ান্ত করতে হবে। এরপর মূল টেন্ডার দুটি প্রাক-নির্বাচিত ঠিকাদারদের কাছে পাঠিয়ে প্রস্তাব সংগ্রহ করতে হবে। অবশ্য ঠিকাদারদের প্রস্তাব জমা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। কারণ তারা মূল ডিজাইনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পরামর্শ দিতে পারে। এই পর্যায়ে এমন পরামর্শের নজির রয়েছে। এরপর আসবে নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে অ্যাপ্রোচ রোডের বিষয়টি। পশ্চিম পাড়ের ঠিকাদার নির্বাচিত হয়ে আছে এবং প্রকল্পের এই অংশটুকু ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক অর্থায়ন করবে। বিশ্বব্যাংক কাজ হাতে নিলে আইডিবিও তাদের কার্যক্রম শুরু করবে বলে আশা করছি। অন্যদিকে ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ইত্যাদি কাজ এগিয়ে চলছে এবং এই কাজে কোনো অভিযোগ শুনিনি।
এটা ঠিক, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন সম্পন্ন করতে গিয়ে আমাদের বেশ ভোগান্তি হলো। আবার সেখান থেকে অনেক কিছু শেখারও আছে। গোটা ব্যাপারটিকে দুর্ভাগ্যজনক অতীত হিসেবে মেনে নিয়ে এখনকার কর্তব্য হচ্ছে অর্জিত শিক্ষা ভবিষ্যতে কাজে লাগানো। পদ্মা সেতু ইস্যুতে আগ্রহীরা যদি বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে চান, তাদের বলব অর্থায়নের ঘোষণা, স্থগিতাদেশ ও পুনঃছাড় সম্পর্কিত তিনটি প্রেস রিলিজ মনোযোগ দিয়ে পাঠ করা। প্রথমটি হচ্ছে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালের; দ্বিতীয়টি ২১ জুন ২০১২ এবং তৃতীয়টি ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক প্রকাশ করেছে।
প্রথমটিতে বিশ্বব্যাংক সেতু নির্মাণে তাদের অর্থায়নের কথা ঘোষণা করছে এবং একই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার কথা ঘোষণা করছে। এক পৃষ্ঠার এই প্রেস রিলিজে ঘুরেফিরে প্রকল্পের প্রতিটি স্তরে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথা বলা হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, এ জন্য সরকারের সঙ্গে মিলে একটি গভর্ন্যান্স অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যাকশন প্লান তৈরি করা হবে, যার মাধ্যমে কোনো ধরনের জালিয়াতি বা দুর্নীতি হতে দেওয়া হবে না। কাজের গুণগত মান বজায় থাকবে এবং সব কাজে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে। তারা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশ সরকারের রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্টের সূত্র ধরে সব তথ্যই প্রকাশযোগ্য হবে। জবাবদিহি অর্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের বিস্তারিত বিবরণ সেখানে রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য যে সেতুটি অপরিহার্য এ কথাও সেখানে ঘোষণা করা হয়েছে এবং আশা প্রকাশ করা হয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক যোগাযোগে সেতুটি বিরাট ভূমিকা রাখবে। তার মানে, প্রায় দেড় বছর আগে বিশ্বব্যাংক যেসব বিষয়ের ওপর নজর দিয়েছিল এবং দেওয়ার জন্য আমাদের আহ্বান করেছিল হয়তো সেগুলো আমরা ঠিকমতো প্রতিপালন করলে এত ঝামেলা হতো না।
দ্বিতীয় প্রেস রিলিজটিতে বিশ্বব্যাংক কেন তাদের অর্থায়নের প্রস্তাব প্রত্যাহার করছে তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছে। তারা বলেছে, তাদের তিনটি শর্ত পূরণ হলেই তারা প্রকল্পটি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে। দেখে ভালো লাগছে যে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সরকার তা পূরণ করেছে এবং বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে তাদের তৃতীয় প্রেস রিলিজে। অবশ্য শেষোক্তটিতে বিশ্বব্যাংক চতুর্থ একটি শর্তও জুড়ে দিয়েছে। তাহলো ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থলগি্নকারী সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি। তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন টেন্ডার চূড়ান্ত করার কাজে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে চায়। তারা একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন এক্সটারনাল প্যানেল বসাতে চায় যারা দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে। আমি আশা করব, এ পর্যালোচনা কাজের জন্য অন্য কোনো কাজ আটকে থাকবে না। পর্যালোচনা ও নির্মাণ প্রক্রিয়া সমান্তরালভাবে চলবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বছরখানেকের যে জটিলতা, তাতে বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে সব ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা বজায় রাখা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা আবশ্যকীয় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে_ তা দেশীয় অর্থায়ন বা দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নই হোক। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের বৃহৎ প্রকল্পে বিশ্বজুড়ে আরও দুটি শর্ত যোগ হচ্ছে। প্রথমত, সব স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত প্রচলিত আইনের সংস্কার করেছে। সেখানেও এসব বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। কাজেই কেউ যদি বলেন, নিয়ম-কানুনের দিক থেকে আমাদের দেশীয় আইনে দুর্বলতা রয়েছে_ এটি ঠিক নয়। যেটা প্রয়োজন হচ্ছে তা হলো কাজে-কর্মে আইনের প্রতিফলন ঘটানো।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, যে কোনো অভিযোগ সময়মতো নিষ্পত্তি করা। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে যদি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ সময়মতো আমলে নেওয়া হতো, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় এড়ানো সম্ভব ছিল। নির্মাণের ক্ষেত্রেও কিন্তু সময়কাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রমত্তা পদ্মায় বর্ষাকালে নির্মাণ কাজ করা দুরূহ। কাজেই পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজটি আবার হাতে নেওয়ার আগে প্রথমে যে কাজটি করতে হবে তা হলো একটি বাস্তবমুখী টাইমটেবল বা সময়সূচি করা ও তা ধরে রাখা। আগামী শুষ্ক মৌসুমে কাজ হাতে নেওয়া সম্ভব হবে না। ঠিকাদার নির্বাচনেই তা পার হয়ে যাবে। তবে কয়েক মাসের মধ্যে এ কাজ সম্পন্ন করা গেলে নির্বাচিত ঠিকাদারদের মোবিলাইজেশনের কাজ সম্পন্ন করতে অনুরোধ করা যেতে পারে। আমি আশা করব, সেতু কর্তৃপক্ষ এবং অর্থলগি্নকারী সংস্থাগুলো দ্রুত তৎপর হবে এবং ক'দিন দেরিতে হলেও সেতু নির্মাণে আর কালক্ষেপণ হবে না। সব কাজই দ্রততার সঙ্গে সম্পন্ন হবে। সব পক্ষ আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হলে তা অসম্ভব নয়।
অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত : পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
No comments