স্মরণ-জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম by ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের (১৯১১-১৯৮৯) ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটিকে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি 'সেবা দিবস' হিসেবে পালন করে। কিভাবে এই চিকিৎসা সমাজ বিজ্ঞানী ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠা করে এ দেশে ডায়াবেটিক চিকিৎসার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন,
তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ডায়াবেটিস হাজার বছরের পুরনো রোগ। ১৯২২ সালে ইনসুলিন আবিষ্কার হওয়ার পর এই রোগের নিয়ন্ত্রণে ও চিকিৎসায় নবযুগের সূচনা হয় । Sir Frederick Grant Banting (১৮৯১-১৯৪১) এবং Charles Herbert Best (১৮৯৯-১৯৭৮) ইনসুলিন আবিষ্কারের ১২ বছর পর চিলিতে এবং ইংল্যান্ডে ১৯৩৪ সালে প্রথম ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব ইংল্যান্ড রোগীদের প্রশিক্ষণ এবং চিকিৎসার জন্য বই এবং যে জার্নাল বের করে সেখানে ডায়াবেটিসের ওপর একটি আর্টিকেল দেখতে পান ডা. ইব্রাহিম। তা থেকে তিনি জানতে পারেন বিলেতে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে এবং বিশেষ ব্যবস্থায় এসব সমিতি ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা করে। তাতে তিনি তাঁর দেশেও ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হন। প্রথমে তিনি নিজের চেম্বারে বিশেষভাবে ডায়াবেটিক রোগী দেখা শুরু করেন। এসব রোগীর মধ্যে অনেকেই ছিলেন উচ্চ শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তাঁদের ডা. ইব্রাহিম ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠা এবং ডায়াবেটিক রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য কিছু করার কথা বলা শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁর এ রকম ধারণার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করতেন। ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসভবনে তিনি কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে ডায়াবেটিস চিকিৎসা সম্পর্কে মতবিনিময় সভায় অমন্ত্রণ জানান। ডাক্তার ইব্রাহিম নিমন্ত্রিতদের জানালেন, যেদিন কারো ডায়াবেটিস হবে সেদিনই বুঝতে হবে ওই লোকটা অন্ধ হয়ে যাবে, কিংবা প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে বা তার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। কিন্তু যদি যথারীতি চিকিৎসা ও পরিচর্যার ভেতর একে রাখা যায়, তাহলে আজীবন সে সুস্থ থাকবে। রোগীর হয়তো ৩০-৪০ বছর বয়স- ১০ বছরের মধ্যেই তার সবকিছু অকেজো হয়ে যাবে, কিন্তু যথারীতি চিকিৎসা ও পরিচর্যা করলে এবং নিয়ম মেনে চললে সে ষাট বছর কেন তার চেয়েও বেশি অর্থাৎ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সুস্থ থাকবে এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে। উপস্থিত সমাজদরদিদের সেদিন ডা. ইব্রাহিম তাঁর নিজস্ব আবেগের সঙ্গে আরো জানিয়েছিলেন, যদি একটি ডায়াবেটিক সমিতি গঠন করা যায় তাহলে এই সমিতির মাধ্যমে যত রোগীর চিকিৎসা হবে, তা তিনি নিজেই করবেন একেবারেই বিনা পয়সায়। তা ছাড়া এই চিকিৎসার জন্য যেসব যন্ত্রপাতির প্রয়োজন তার কিছু কিছু, যা ডাক্তার ইব্রাহিমের নিজস্ব রয়েছে, তাও তিনি এই প্রকল্পের কাছে দিয়ে দেবেন।
ডা. ইব্রাহিম ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য বিনা পয়সায় উন্নত চিকিৎসার যুক্তি নিয়েও এগিয়ে আসেন, বলাবাহুল্য এই অভিনব পন্থাটিকেই ডায়াবেটিস চিকিৎসার কৌশল হিসেবে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করেন তিনি। যে দেশে যেখানে গাঁটের পয়সা খরচ করে উন্নত চিকিৎসা পাওয়া যায় না, সেখানে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর প্রথম যুক্তি ছিল : ধনী, গরিব সামাজিক শ্রেণী নির্বিশেষে সবাইকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেওয়ার কারণ পয়সা দিয়ে যদি চিকিৎসা করি তাহলে যাদের পয়সা আছে তারা শুধু ডায়াবেটিক সমিতির ক্লিনিকে আসবে কেন? পয়সা দিয়ে তো তারা অন্য কোনো ক্লিনিকেও চিকিৎসা করাতে পারে। কিন্তু আজীবনের রোগ ডায়াবেটিস চিকিৎসায় রোগী পয়সা দিয়ে অন্যত্র চিকিৎসা করতে গেলেই একসময় তার নিজেরও সমস্যা হবে। আর এই অতি দরিদ্রের দেশে গরিবরা আদৌ কোনো চিকিৎসা না পেয়ে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে তাই ডা. ইব্রাহিমের প্রধান আদর্শ হিসেবে ঘোষিত হলো : 'ধনী, গরিব, উঁচু, নিচু কোনো ডায়াবেটিক রোগীকেই বিনা চিকিৎসায় এবং কাজবিহীন অবস্থায় মরতে দেওয়া হবে না'।
দ্বিতীয় যুক্তি : তাঁর জীবনের ব্রত ছিল রোগীর মুখে হাসি ফোটানো। রোগী এবং চিকিৎসকের মাঝখানে অর্থকে দাঁড় করাননি তিনি কখনো। ডাক্তারি পড়া অবস্থায় তিনি ভাবতেন কিভাবে সমাজের সেবা করা যায়? সমাজসেবার কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডি নেই, এ এক বৃহৎ বিশাল পরিমণ্ডল। শুধু রোগী আর ডাক্তারের মধ্যে সমাজসেবার এ বিশাল পরিমণ্ডলকে তিনি সংকীর্ণ করে রাখার কখনোই পক্ষপাতী ছিলেন না। মেডিক্যাল ছাত্র থাকাকালীন তিনি যখনই সময় পেতেন দেশে এসে সাধারণ মানুষের সেবা করতেন। প্রয়োজনে নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে ওষুধ কিনে দিতেন। জটিল রোগীকে বহন করে কলকাতার বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন।
তাঁর তৃতীয় যুক্তি : রোগীদের মধ্যে সমতা সৃষ্টি করা। যার মাধ্যমে সমাজের সব স্তরের সব শ্রেণীর রোগী সমতার ভিত্তিতে সেবা পেতে পারে। যদি সমতার ভিত্তিতে রোগীদের সেবা প্রদান করা না হয় তাহলে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে রোগীদের মধ্যে সমতা বিধান করতে হবে।
লেখক : ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের চেয়ারম্যান। বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো-অর্ডিনেটর
No comments