বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি ও ভবিষ্যৎ by হাসান কামরুল
নেদারল্যান্ডসের হেগে সমুদ্রসীমা মীমাংসাবিষয়ক পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশন বা স্থায়ী সালিস আদালতের প্রেসিডেন্ট জাজ জোসে লুইস জিসাস বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ মামলা পরিচালনার জন্য পাঁচজন বিচারককে ইতিমধ্যে নিয়োগ দিয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে তিনজন আন্তর্জাতিক আদালতের নিজস্ব এখতিয়ারে ও দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষ থেকে। ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ইটলসের প্রেসিডেন্টের কাছে ১৯৮২ সালে প্রণীত ইউএন কনভেনশনের সমুদ্রবিষয়ক আইনের আর্টিকেল ৩-এর অ্যানেঙ্ ৭-এর ধারা অনুসরণের জন্য অনুরোধ জানায়। ২০১০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক আদালত এ মামলা পরিচালনার জন্য তিনজন বিচারককে আদালতের পক্ষ থেকে নিয়োগ করেন এবং বাংলাদেশ ও ভারতের নিয়োগকৃত বিচারকদ্বয় ২০১০ সালের ৮ মার্চের পর আদালতের এখতিয়ারভুক্ত হন। মোট পাঁচজন বিচারকের সমন্বয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তিতে আদালত কাজ করছেন। যার রায় পাওয়ার জন্য দুটি দেশকেই ২০১৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ মামলার বিচারকরা হলেন জাজেস রুডিনজার ওলফ্রাম (জার্মানি), যিনি এ মামলার চিফ জাস্টিস হিসেবে কর্মরত। টুলিও ট্রেভেজ (ইতালি) এবং ইভান শেয়ারার (অস্ট্রেলিয়া)। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল জুরিস্ট প্রফেসর ভোগান লু ও ভারতের নিযুক্ত বিচারপতি পি শ্রীনিভাসা রাও।
বঙ্গীয় বদ্বীপ অঞ্চলের মাউথ হিসেবেই বঙ্গোপসাগরের পরিচিতি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। যার ৬০ শতাংশ এলাকাই বাংলাদেশের। বঙ্গোপসাগর প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ামক ভাণ্ডার হিসেবেও সুপরিচিত। প্রাকৃতিক তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ এ উপসাগরের মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে। ২০১১ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত ইটলসের রায়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ও ভারতের অমীমাংসিত সমুদ্রবিরোধ রয়ে গেছে। যদিও ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ও ভারত দুটি দেশই সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তিতে কূটনৈতিক সম্পর্ককে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ বিরোধ নিষ্পত্তিতে কোনো সুরাহাই করতে পারেনি। ফলে দেশ দুটিকে আদালতের আশ্রয় নিতে হয়েছে। এখন পুরো বিষয়টিই আন্তর্জাতিক আদালতের নজরদারিতে থাকায় রায় হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো দেশই বিরোধপূর্ণ স্থানে কোনো ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারবে না।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার জাতিসংঘের সমুদ্র কনভেশনে আনক্লসের সদস্যপদ লাভ করে। আনক্লসের ১৫ নম্বর অংশে স্পষ্ট বলা আছে, সমুদ্রসীমা নির্ধারণবিষয়ক মামলার মীমাংসার্থে হয় ইটলস বা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আইসিজেই সর্বময় ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে এবং এ-সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসায় এ দুটি আদালতই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আনক্লসে স্বাক্ষর করা সদস্য দেশগুলোকে আদালতের রায় মেনে নিতে এবং আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আদেশ পুনর্বিবেচনার কোনো ধরনের আবেদন গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। তার মানে, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের কোনো সুযোগ নেই। আদালত যে রায় দেবেন, সেটা দুই পক্ষকেই মেনে নিতে হবে। আর এসব নিয়মকানুন জেনেশুনেই আনক্লসের সদস্য হতে হয়। সমুদ্রবিরোধের সমাধানার্থে এ দুটি আদালতের বিকল্প নেই।
২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার_তিনটি দেশই সমুদ্রবিরোধ মীমাংসার্থে আনক্লসের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়। আন্তর্জাতিক আদালত বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের জন্য অধিকতর অর্থনৈতিক অঞ্চল পুনর্নির্ধারণসহ কন্টিনেন্টাল সেলফকে বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গোপসাগরের সীমানা নির্ধারণে চাহিদাপত্র চেয়েছে। ফলে এ-সংক্রান্ত সব দলিল-দস্তাবেজ বাংলাদেশ ও ভারত ইতিমধ্যেই আদালতে উপস্থাপন করেছে। বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চল অধিকতর অস্থায়ী ও দ্রুত পরিবর্তনশীল হওয়ায় বাংলাদেশ টেরিটরিয়াল ওয়াটার ও মেরিটাইম জোন্স অ্যাক্ট ১৯৭৪ অনুযায়ী ১০ ফ্যাদম বা ৬০ ফুট গভীরতার এলাকাকে সোজাসুজি বেজলাইন ধরে বিরোধ মীমাংসার প্রস্তাবনা দাখিল করেছে। যা নিয়ে ভারতের মতবিরোধ রয়েছে। ভারত চাইছে ইক্যুয়ি-ডিসট্যান্স বা সমদূরত্ব পদ্ধতির প্রয়োগ। যা বাংলাদেশ চাইছে না। কারণ সমদূরত্ব পদ্ধতির প্রয়োগ হলে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানের আমূল পরিবর্তন হবে। তাই বাংলাদেশ নচড বা ইক্যুয়িটি পদ্ধতির প্রয়োগের যুক্তিতে ভারতের ভীতি রয়েছে। ভারত মনে করছে, যদি নচড পদ্ধতিতে সমুদ্রবিরোধ মীমাংসার রায় দেওয়া হয়, তাহলে বঙ্গোপসাগরের তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ অঞ্চল ভারতের হাতছাড়া হয়ে যাবে। বাংলাদেশের ইক্যুয়িটি ফর্মুলায় ভারতের না। আবার ভারতের ইক্যুয়ি-ডিসট্যান্স ফর্মুলায় বাংলাদেশের না। কারণ বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ২৮টি ব্লক নির্ধারণ করেছে। যদি ইক্যুয়ি-ডিসট্যান্স বা সমদূরত্ব পদ্ধতিতে বাংলাদেশ বিরোধ মীমাংসায় রাজি হয়, তাহলে সমুদ্র অঞ্চলের ২৮টি ব্লকের ১০টি বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর যদি বাংলাদেশের প্রস্তাবিত নচড বা ইক্যুয়িটি পদ্ধতিকে অনুসরণ করে এ মামলার রায় দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের বিদ্যমান তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ব্লকগুলো অক্ষত থাকবে। এমনকি বাংলাদেশ মাদ্রাজ ও কলকাতার বঙ্গোপসাগরের অংশের বেশ কিছু জায়গার মালিকানা পাবে। তাতে হয়তো আরো গোটা চারেক ব্লকের ডিজাইন করা যেতে পারে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার রায় অবশ্য বাংলাদেশ প্রস্তাবিত ইক্যুয়িটি ফর্মুলায় আসায় বাংলাদেশের অংশের সামান্য এলাকা মিয়ানমারের দিকে চলে গেছে। আবার মিয়ানমারের বেশ কিছু সমুদ্র অঞ্চলের মালিকানাও বাংলাদেশের হওয়ায় নতুন অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নতুন ব্লকের ডিজাইনের সম্ভাবনাও প্রকট হয়েছে। যদিও মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্র অঞ্চলের বিরোধ প্রায় একই রকম। যেহেতু মিয়ানমারের বিপক্ষে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পেয়েছে, সেহেতু খুব স্বাভাবিকভাবেই একই ধরনের মামলায় রায় ভারতের বিপক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সে ক্ষেত্রে চলমান মামলায় বাংলাদেশ কৌশলগত কারণেই এগিয়ে রয়েছে এবং বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাসও রয়েছে পূর্ণমাত্রায়। এখন অপেক্ষার পালা। আন্তর্জাতিক আদালত কিসের ওপর ভিত্তি করে রায় দেয়, তা দেখার বিষয়। যদি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সমুদ্রবিরোধের রায় অনুসরণে আদালত রায় প্রদান করেন, তাহলে বাংলাদেশের অফশোর ব্লকগুলোর ৯০ শতাংশ অক্ষত থাকবে। অন্যথায় বাংলাদেশের বৃহদাংশই চলে যাবে ভারতের দখলে।
পাদটীকা : বাংলাদেশের নিযুক্ত আরবিট্রেটর প্রফেসর ভোগান লু একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমুদ্র গবেষক এবং এ ধরনের মামলায় প্রফেসর ভোগান লুর ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে কাজ করার পূর্ব-অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রফেসর ভোগান লু ব্রিটিশ নাগরিক ও অঙ্ফোর্ডের স্কলার। অন্যদিকে ভারতের নিযুক্ত আরবিট্রেটর পি শ্রীনিভাসা রাওয়ের রয়েছে পররাষ্ট্রনীতিতে কাজ করার সুবিশাল অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে সমুদ্রবিজ্ঞানে তাঁর রয়েছে ৩০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা। ব্যক্তিগতভাবে প্রফেসর ভোগান লু ও পি শ্রীনিভাসা রাও একে অপরের ভালো বন্ধু। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুজন একসঙ্গে কাজ করেছেন এক যুগেরও বেশি সময়।
লেখক : ভূতত্ত্ববিদ ও কলাম লেখক
বঙ্গীয় বদ্বীপ অঞ্চলের মাউথ হিসেবেই বঙ্গোপসাগরের পরিচিতি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। যার ৬০ শতাংশ এলাকাই বাংলাদেশের। বঙ্গোপসাগর প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ামক ভাণ্ডার হিসেবেও সুপরিচিত। প্রাকৃতিক তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ এ উপসাগরের মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে। ২০১১ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত ইটলসের রায়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ও ভারতের অমীমাংসিত সমুদ্রবিরোধ রয়ে গেছে। যদিও ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ও ভারত দুটি দেশই সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তিতে কূটনৈতিক সম্পর্ককে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ বিরোধ নিষ্পত্তিতে কোনো সুরাহাই করতে পারেনি। ফলে দেশ দুটিকে আদালতের আশ্রয় নিতে হয়েছে। এখন পুরো বিষয়টিই আন্তর্জাতিক আদালতের নজরদারিতে থাকায় রায় হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো দেশই বিরোধপূর্ণ স্থানে কোনো ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারবে না।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার জাতিসংঘের সমুদ্র কনভেশনে আনক্লসের সদস্যপদ লাভ করে। আনক্লসের ১৫ নম্বর অংশে স্পষ্ট বলা আছে, সমুদ্রসীমা নির্ধারণবিষয়ক মামলার মীমাংসার্থে হয় ইটলস বা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আইসিজেই সর্বময় ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে এবং এ-সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসায় এ দুটি আদালতই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আনক্লসে স্বাক্ষর করা সদস্য দেশগুলোকে আদালতের রায় মেনে নিতে এবং আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আদেশ পুনর্বিবেচনার কোনো ধরনের আবেদন গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। তার মানে, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের কোনো সুযোগ নেই। আদালত যে রায় দেবেন, সেটা দুই পক্ষকেই মেনে নিতে হবে। আর এসব নিয়মকানুন জেনেশুনেই আনক্লসের সদস্য হতে হয়। সমুদ্রবিরোধের সমাধানার্থে এ দুটি আদালতের বিকল্প নেই।
২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার_তিনটি দেশই সমুদ্রবিরোধ মীমাংসার্থে আনক্লসের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়। আন্তর্জাতিক আদালত বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের জন্য অধিকতর অর্থনৈতিক অঞ্চল পুনর্নির্ধারণসহ কন্টিনেন্টাল সেলফকে বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গোপসাগরের সীমানা নির্ধারণে চাহিদাপত্র চেয়েছে। ফলে এ-সংক্রান্ত সব দলিল-দস্তাবেজ বাংলাদেশ ও ভারত ইতিমধ্যেই আদালতে উপস্থাপন করেছে। বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চল অধিকতর অস্থায়ী ও দ্রুত পরিবর্তনশীল হওয়ায় বাংলাদেশ টেরিটরিয়াল ওয়াটার ও মেরিটাইম জোন্স অ্যাক্ট ১৯৭৪ অনুযায়ী ১০ ফ্যাদম বা ৬০ ফুট গভীরতার এলাকাকে সোজাসুজি বেজলাইন ধরে বিরোধ মীমাংসার প্রস্তাবনা দাখিল করেছে। যা নিয়ে ভারতের মতবিরোধ রয়েছে। ভারত চাইছে ইক্যুয়ি-ডিসট্যান্স বা সমদূরত্ব পদ্ধতির প্রয়োগ। যা বাংলাদেশ চাইছে না। কারণ সমদূরত্ব পদ্ধতির প্রয়োগ হলে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানের আমূল পরিবর্তন হবে। তাই বাংলাদেশ নচড বা ইক্যুয়িটি পদ্ধতির প্রয়োগের যুক্তিতে ভারতের ভীতি রয়েছে। ভারত মনে করছে, যদি নচড পদ্ধতিতে সমুদ্রবিরোধ মীমাংসার রায় দেওয়া হয়, তাহলে বঙ্গোপসাগরের তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ অঞ্চল ভারতের হাতছাড়া হয়ে যাবে। বাংলাদেশের ইক্যুয়িটি ফর্মুলায় ভারতের না। আবার ভারতের ইক্যুয়ি-ডিসট্যান্স ফর্মুলায় বাংলাদেশের না। কারণ বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ২৮টি ব্লক নির্ধারণ করেছে। যদি ইক্যুয়ি-ডিসট্যান্স বা সমদূরত্ব পদ্ধতিতে বাংলাদেশ বিরোধ মীমাংসায় রাজি হয়, তাহলে সমুদ্র অঞ্চলের ২৮টি ব্লকের ১০টি বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর যদি বাংলাদেশের প্রস্তাবিত নচড বা ইক্যুয়িটি পদ্ধতিকে অনুসরণ করে এ মামলার রায় দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের বিদ্যমান তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ব্লকগুলো অক্ষত থাকবে। এমনকি বাংলাদেশ মাদ্রাজ ও কলকাতার বঙ্গোপসাগরের অংশের বেশ কিছু জায়গার মালিকানা পাবে। তাতে হয়তো আরো গোটা চারেক ব্লকের ডিজাইন করা যেতে পারে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার রায় অবশ্য বাংলাদেশ প্রস্তাবিত ইক্যুয়িটি ফর্মুলায় আসায় বাংলাদেশের অংশের সামান্য এলাকা মিয়ানমারের দিকে চলে গেছে। আবার মিয়ানমারের বেশ কিছু সমুদ্র অঞ্চলের মালিকানাও বাংলাদেশের হওয়ায় নতুন অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নতুন ব্লকের ডিজাইনের সম্ভাবনাও প্রকট হয়েছে। যদিও মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্র অঞ্চলের বিরোধ প্রায় একই রকম। যেহেতু মিয়ানমারের বিপক্ষে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পেয়েছে, সেহেতু খুব স্বাভাবিকভাবেই একই ধরনের মামলায় রায় ভারতের বিপক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সে ক্ষেত্রে চলমান মামলায় বাংলাদেশ কৌশলগত কারণেই এগিয়ে রয়েছে এবং বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাসও রয়েছে পূর্ণমাত্রায়। এখন অপেক্ষার পালা। আন্তর্জাতিক আদালত কিসের ওপর ভিত্তি করে রায় দেয়, তা দেখার বিষয়। যদি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সমুদ্রবিরোধের রায় অনুসরণে আদালত রায় প্রদান করেন, তাহলে বাংলাদেশের অফশোর ব্লকগুলোর ৯০ শতাংশ অক্ষত থাকবে। অন্যথায় বাংলাদেশের বৃহদাংশই চলে যাবে ভারতের দখলে।
পাদটীকা : বাংলাদেশের নিযুক্ত আরবিট্রেটর প্রফেসর ভোগান লু একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমুদ্র গবেষক এবং এ ধরনের মামলায় প্রফেসর ভোগান লুর ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে কাজ করার পূর্ব-অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রফেসর ভোগান লু ব্রিটিশ নাগরিক ও অঙ্ফোর্ডের স্কলার। অন্যদিকে ভারতের নিযুক্ত আরবিট্রেটর পি শ্রীনিভাসা রাওয়ের রয়েছে পররাষ্ট্রনীতিতে কাজ করার সুবিশাল অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে সমুদ্রবিজ্ঞানে তাঁর রয়েছে ৩০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা। ব্যক্তিগতভাবে প্রফেসর ভোগান লু ও পি শ্রীনিভাসা রাও একে অপরের ভালো বন্ধু। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুজন একসঙ্গে কাজ করেছেন এক যুগেরও বেশি সময়।
লেখক : ভূতত্ত্ববিদ ও কলাম লেখক
No comments