সংসদে তুলোধুনো-অর্থমন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনা

হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির বিষয়ে বেফাঁস মন্তব্যের জন্য তীব্র সমালোচনার শিকার হয়ে অবশেষে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে দাঁড়িয়ে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রী বলেন, 'এই মুহূর্তে কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে দেশে বিরাট রকমের তোলপাড় ও আলোচনা চলছে।


মনে হয়, দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি আমি। এ জন্য আমি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করব না। ওই দিন ওইভাবে আমার কথাটা বলা ঠিক হয়নি। এর জন্য আমি সকলের কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি।' সোনালী ব্যাংক-হলমার্ক কেলেঙ্কারি বিষয়ে অর্থমন্ত্রী গত মঙ্গলবার মন্তব্য করেছিলেন, 'চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি বড় কিছু নয়।'
গতকাল সংসদে এই মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেন, 'আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারও করা হবে। তদন্তকাজ শেষ হোক। দোষীদের শনাক্ত করতে তদন্ত হচ্ছে। তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। গ্রেপ্তারের প্রয়োজন হলে সেটাও করা হবে।'
সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ কেন ভেঙে দেওয়া হয়নি- এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'তদন্তকাজ চলছে। তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তদন্তের স্বার্থে বর্তমান পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ তিনজনকে আমরা রেখে দিয়েছি। বাকিদের পুনর্গঠন করিনি। পর্ষদের মেয়াদ শেষ হলে ৯ সেপ্টেম্বর অন্যরা এমনিতেই চলে যাবে।'
আগের দিনের মতো গতকালও জাতীয় সংসদে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সংসদে মহাজোট সরকারের সিনিয়র এমপিদের তোপের মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী। গত বুধবার আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী সংসদে ছিলেন না। তবে গতকাল প্রধানমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় সংসদ সদস্যরা বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগকে এ ঘটনায় দায়ী করে বক্তব্য দেন। এত বড় কেলেঙ্কারির পরেও কেন সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়নি, এর কারণ জানতে চান তাঁরা।
২০১০ সালে এ ঘটনার শুরু হলেও এত দিন কেন অর্থমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে চুপ ছিলেন, এর কারণও জানতে চান সংসদ সদস্যরা। একই বিষয়ে দোষীদের স্পষ্ট বিবৃতি জাতির সামনে উপস্থাপনের দাবি জানান তাঁরা।
অবশ্য গতকাল অর্থমন্ত্রী তাঁর সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে নিজেই এ প্রসঙ্গ তুলে আলোচনার সূত্রপাত করেন। এরপর সরকারি দলের সিনিয়র এমপি আব্দুল জলিল, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল মতিন খসরু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।
আব্দুল জলিল পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেন, 'আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে জড়িত। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ওপরের মহলের ও পর্ষদের সহযোগিতা ছাড়া এত বড় দুর্নীতি সম্ভব নয়। পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া এত টাকা কিভাবে গেল? আমরা জনপ্রতিনিধি। আমাদের সব কিছু নিয়ে জনগণের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এসব কর্মকাণ্ড আমাদের জন্য আগামী দিনে দুর্ভাগ্যের ইঙ্গিত নিয়ে আসে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চার হাজার কোটি টাকা এমন কিছু টাকা নয়। আমি জানতে চাই, কত টাকা হলে এমন কিছু হবে? পুরো বিষয়টি জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। ধামাচাপা দেওয়া চলবে না।'
তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে জনগণ যে মতামত দিচ্ছে, এর মূল্যায়ন আমাদের করতে হবে। আমরা যখন আমাদের নির্বাচনী এলাকায় যাই, মানুষ আমাদের প্রশ্ন করে- জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা কী করছি। যে মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো, সে সময়ে একটি কেলেঙ্কারি নিয়ে যে লেখালেখি হচ্ছে, দেশব্যাপী আলোচনা হচ্ছে- তার নিরসন হওয়া উচিত। যে ব্যাংকটি নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেখানকার পরিচালনা পর্ষদ তার দায় এড়াতে পারে না। ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে দোষী ব্যক্তি আস্তে আস্তে জামানত ফিরিয়ে দেবেন। আমি মনে করি, পর্ষদ কোনোভাবে এর দায় এড়াতে পারে না। যে ব্যাংক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এর চেয়ারম্যানকে কেন রাখা হয়েছে? কেন তাঁকে অপসারণ করা হয়নি? এই ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে সরকারকেই এর দায় নিতে হবে।'
আবদুল মতিন খসরু বলেন, 'অর্থমন্ত্রী আজ কেন এ বিষয়ে কথা বলছেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা দুই বছর ধরে চলছে। ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা কোথায় গেল, জাতি জানতে চায়। যেখানে তিন হাজার টাকা চুরি গেলে জেল হয়, সেখানে এত বড় কেলেঙ্কারির কী বিচার হবে, আমরা দেখতে চাই।'
মজিবুল হক চুন্নু বলেন, 'এত বড় ঘটনার পরও সরকার কেন চুপ। যে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপপরিচালকের সহযোগিতায় এটা হয়েছে, এখনো কেন তাঁদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়নি। কেন তাঁদের সরিয়ে নিরপেক্ষ লোক বসিয়ে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা হয়নি, দেশবাসী তা জানতে চায়।'
রাশেদ খান মেনন বলেন, 'এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ দেখি না আমি।' এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর আরো স্পষ্ট বিবৃতি দাবি করে তিনি বলেন, '৬৫ কোটি টাকার কথা পর্ষদ জানত। তাহলে বাকি টাকার কথা কে জানত? এর পেছনে সরকারের কোনো অংশ জড়িত আছে কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য বলব। কারণ যেখানে সরকার দায়ী নয়, সেখানে এর দায় সরকার বা মহাজোট বহন করতে পারে না।'
সংসদ সদস্যদের এসব বক্তব্যের আগে ও পরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবুল মুহিত দুই দফায় হলমার্ক কেলেঙ্কারির বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন। দুই দফার বক্তব্যে তিনি সোনালী ব্যাংক-হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ জড়িত নয় দাবি করে বলেন, পর্ষদ হলমার্ককে ৬৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছে। ওই ঋণের সুযোগ নিয়ে কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে তারা অনেক টাকা পাচার করেছে, যা সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। দায়ীদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। এ ঘটনায় সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। একই সঙ্গে জড়িতদের এমন শাস্তি দেওয়া উচিত, যাতে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে দেশে আর না ঘটে। তিনি আরো বলেন, 'এ ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদের ধরার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করেছি। ১৭ জনকে শোকজ করেছি।'
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'হলমার্ককে আমরা মোটামুটি হলমার্ক কেলেঙ্কারি বলি। এটা মোটামুটি ২০১০ সালে ধরা পড়ে। ২০১১ সালে সোনালী ব্যাংক দুটি প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু পরে দেখা যায়, এ দুটি প্রতিবেদন অন্যায়ভাবে দাখিল করা হয়। এ হলমার্ক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। কিন্তু ঋণের নামে তারা অনেক টাকা পাচার করে। এটা তারা অন্যায় করেছে।' তিনি আরো বলেন, একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি অডিট পরিচালনা করে। তাদের অডিটেও হলমার্কের কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে। তাদের প্রতিবেদনে তারা হলমার্কের ঘটনার সঙ্গে কিছু দুষ্ট লোক জড়িত বলে অভিযোগ করে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমরা ঘটনাটি তদন্তকারী সব প্রতিষ্ঠানকে বলেছি সুষ্ঠুভাবে তদন্ত চালিয়ে নেওয়ার জন্য।'

No comments

Powered by Blogger.