সময়ের প্রতিবিম্ব- নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংকট নিরসনে দুটি প্রস্তাব by এবিএম মূসা
‘আপনি কিতা গুম ওইসলানি?’—সিলেটি ভাষায় আমার উদ্দেশে মুঠোফোনে ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নটি শুনে প্রথমে অবাক হলাম, পরে মজা পেলাম। প্রায় ছয় মাস পত্রিকাটিতে আমার নিয়মিত কলাম ‘সময়ের প্রতিবিম্ব’ ছাপা হচ্ছে না বলেই তাঁর মনে স্বাভাবিকভাবে এই প্রশ্ন জেগেছিল।
অবশেষে চ্যানেল আইতে মতিউর রহমান চৌধুরীর মধ্যরাতের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে আমাকে দেখেই নাকি প্রশ্নকারী নিশ্চিত হয়েছেন, আমি গুম হইনি। ক্রসফায়ারে খরচও হইনি, বুড়িগঙ্গা ও অন্যান্য স্থানে একের পর এক পাওয়া অজ্ঞাতপরিচয় লাশগুলোর কোনোটিই আমার নয়। তাঁর সিলেটি ভাষায় সবচেয়ে আমোদজনক মন্তব্যটি ছিল, ‘আপনি বেডরুমে খুন হননি, তা তো বুঝতেই পারছি। আপনি বোধ হয় এখন রান্নাঘরে অথবা বাথরুমে নিশ্চিন্তে ঘুমান, তাই না?’
আমার সিলেটি পাঠককে আশ্বস্ত করলাম, অন্য কোনো কারণে নয়, প্রায় ছয় মাস হূদয়ের বেদনা, ফুসফুসের দুর্বলতা, আরও অনেক বয়সজনিত রোগে পর্যুদস্ত হওয়ার কারণে লেখালেখি হয়নি। ঢাকার ল্যাবএইডের প্রখ্যাত চিকিৎসক বরেন চক্রবর্তী কিছুদিন কেবিনে শুইয়ে রেখে পাঠালেন প্রথমে নয়াদিল্লির এসকর্টে, তারপর সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে। কিঞ্চিৎ সুস্থ হয়ে প্রথম আলোর পাঠকদের সামনে হাজির হয়ে লিখতে গিয়ে মহা ফাঁপরে পড়েছি। আমার এই কলামটিতে প্রথাগত কারণে দেশে সর্বশেষ সংঘটিত ঘটনা ন্যূনাধিক বিচার-বিশ্লেষণ করি। কিন্তু এক দিন পর পরই দেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে নিত্যনতুন ঘটনার সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিবিম্ব আয়নায় দেখছি। একটি নিয়ে লেখা শুরু করলে আরেকটি বিষয় সামনে এসে যায়। সঠিক সময়ে তক্ষুনি সংঘটিত ঘটনার বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করা হয় না। তবু রেশ হারিয়ে যায়নি এমন দু-চারটি নিয়ে ‘বুড়ি ছোঁয়ার’ মতো আলোচনা করছি।
পাঁচ-ছয় মাস অথবা আরও বেশি সময় পূর্বকালে আমার সর্বশেষ লেখাটি ছিল সাগর-রুনি হত্যা নিয়ে সাংবাদিক অনুজদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। আমি লিখেছিলাম, ‘সাগর-রুনি প্রাণ দিয়েই’ বিগত বিএনপি আমলের বিভক্তকৃত সাংবাদিক সমাজকে নিজস্ব পেশাগত নয়, রাজনৈতিক বিভেদের বৃত্ত থেকে অনেকখানি বের করে নিয়ে এসেছে। তারা আবার ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, বিভেদের প্রাচীর ভেঙে পড়া শুরু হলো। তাদের উৎসাহ দিতে অসুস্থ শরীর নিয়েই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ঐক্যবদ্ধ ‘মানববন্ধনে’ কিছুক্ষণের জন্য অংশ নিয়েছিলাম। মানববন্ধনে অংশ নেওয়ায় ডা. বরেন চক্রবর্তী বিচলিত হলেন। প্রতিদিন দেশের চলমান ঘটনা টেলিভিশনে দেখে ও পত্রিকায় পড়ে উত্তেজিত হতে পারি, এই আশঙ্কায় নিষেধাজ্ঞা জারি হলো, কিছুদিন টেলিভিশন দেখতে মানা, আর পত্রিকার পাতায় চোখ বোলানোর প্রশ্নই ওঠে না।
নিষেধাজ্ঞাটি প্রসঙ্গে প্রথম আলোর একটি সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রে ‘ভ্রমণ রঙ্গে’ প্রকাশিত রসাল গল্পটি একটুখানি অদলবদল করে ছাপছি। গল্পের সূচনা হচ্ছে জাহাজডুবির পর এক বাংলাদেশি নির্জন দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছেন। দ্বীপটিতে ছিল হিংস্র বাঘ-ভালুক আর সাপের বিচরণ। আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশি কয়েক দিন সেই দ্বীপে শঙ্কিত জীবনযাপনের পর একদিন দূরে সমুদ্রে একটি জাহাজ দেখতে পেলেন। তিনি হাত নাড়তেই বাংলাদেশি জাহাজটি থেকে একটি ডিঙি নৌকা এল। বাংলাদেশি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘যাক, সাপ আর বাঘ-ভালুকের ভয়ে শঙ্কিত ও ভয়ার্ত দিন কাটাতে হবে না। ডিঙি নৌকার নাবিকটি বলল, ‘আপনাকে নিতে আসিনি। আমাদের কাপ্তেন আপনার জন্য গত এক মাসের ঢাকার কয়েকটি পত্রিকা পাঠিয়েছেন। পত্রিকাগুলো পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—দেশে যাবেন, নাকি এখানে থাকাটা অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যময় ও নিরাপদ মনে করেন।’
রূপান্তরিত রসাল গল্পটি এখানেই শেষ। কয়েকটি হাসপাতালে বিচরণ করে বাসায় ফিরে আমি সাম্প্রতিক ও বর্তমানের দৈনিক কাগজগুলো পড়ে ভাবছিলাম, সেই নির্জন দ্বীপে আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তিটি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা কিন্তু গল্পে নেই। আমার প্রিয় পাঠকদের জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনি হলে কী উত্তর দিতেন?’
দীর্ঘদিন পর নতুন করে লিখতে বসেছি, যদিও প্রথম আলোর স্নেহভাজন এ কে এম জাকারিয়া সস্নেহে বারবার বলেছেন, ‘পুরোপুরি সুস্থ হয়ে নিন, তারপর লেখালেখি।’ কিন্তু ঢেঁকি ধান ভানবে না, তা কী করে হয়! অর্ধসুস্থ অবস্থায় প্রথমে জানতে ইচ্ছে হলো, সাগর-রুনি হত্যার কী সমাধান হলো? সাংবাদিকদের মিলিত আন্দোলনের ফলাফল কী। প্রেসক্লাবে এক অনুজ সাংবাদিককে প্রশ্নটি করার পর সে জানাল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চা খাইয়ে আর প্রধানমন্ত্রী ডেকে নিয়ে মিষ্টি হেসে বেতন বোর্ড দেওয়ার পর হত্যার সমাধান হয়ে গেছে। হায় রে কপাল! মনে পড়ল ১৯৬০ সালে আমি যখন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ডেইলি স্টার-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আমার বন্ধু এস এম আলী সভাপতি, তখনই আমরা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের কাছ থেকে বেতন বোর্ড আদায় করেছিলাম। সেই বোর্ডের সুপারিশ কার্যকর করার জন্য ১৯৬১ সালে ধর্মঘট করতে হয়েছিল। সমগ্র পাকিস্তানের সব পত্রিকায় ব্যতিক্রম ছিল একটি, গোলাম রসুল মল্লিকের ‘এনা-ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি।’ খুশি হয়ে রসুলকে বললাম, ‘তুই সবার আগে বেতন বোর্ড কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছিস, কী ব্যাপার।’ সে বত্রিশটি দাঁত দেখিয়ে উত্তর দিল, ‘বেতনই যখন দিই না, বেতন বোর্ডের সুপারিশ মেনে নিতে বাধা কোথায়!’ যা-ই হোক, বোঝা গেল, সব পত্রিকা বোর্ডের নির্দেশনা মানবে কি না জানি না, তবে বিএনপির আমলে বিভক্ত সাংবাদিক সমাজকে আওয়ামী আমলে জোড়া লাগতে দেওয়া হলো না।
পাঠক, মাঝেমধ্যে লেখার খেই হারিয়ে অন্যদিকে যেতে হচ্ছে। কারণ, আপডেটেড হয়ে, মানে পত্রিকাজগৎ থেকে আমার বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণকালে এত সব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো সম্পর্কে সব দু-চার বাক্য লিখলেও প্রথম আলোর একটি পূর্ণ পৃষ্ঠা পূরণ হয়ে যাবে। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, প্রধানমন্ত্রীর বেডরুম পাহারা অথবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজ দায়িত্বে ঘরে তালা দিয়ে বাড়ি যাওয়া এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিতর্ক, সেমিনার, বিদগ্ধজনের মতামত এবং সর্বোপরি দুই প্রধান দলের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। এ ছাড়া বুয়েট সংকট, সর্বশেষ হলমার্ক কেলেঙ্কারি এবং এ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘চার হাজার কোটি কোনো টাকাই নয়।’ প্রতিটি বিষয় আলোচনা করতে হবে কিন্তু স্থানাভাবে করা যাচ্ছে না। তাই শুধু নির্বাচন-পদ্ধতি তথা তত্ত্বাবধায়ক বনাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের ও অবসানের উপায় বাতলাতে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
যে একটি বিষয় আলোচনা করব বলেছি, সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। আগামী নির্বাচন নিয়ে তথা কোন পদ্ধতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিংবা আদৌ নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিতর্ক চলছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটাও হয়, ওটাও হয়। বাংলাদেশের সচেতন সাধারণ মানুষও ভাবছেন আর আতঙ্কে আছেন। তাঁরা শঙ্কিত, এ নিয়ে সংঘাত-হানাহানি হবে। এই সরকারের মেয়াদ পূর্তির শেষ লগ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে এক-এগারো ধরনের কোনো ব্যবস্থা কায়েম হতে পারে কি না, এ নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সরাসরি কেউ কেউ বলছেন, এক-এগারো এনেছিল নৌকার মালিক আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠার মাধ্যমে। এবার কি ধানের শীষের মালিক বিএনপি কাস্তে-কোদাল নিয়ে রাস্তায় নামবে? সে ধরনের কোনো লক্ষণ এখনো দেখছি না। আগামী বছর শেষে দেখব কি না জানি না। এ নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, কৌশলগত কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এত আগে মালকোঁচা মেরে কোনো জঙ্গি আন্দোলনে নামতে চায় না বিএনপি। টেলিভিশনে আমার এ ধরনের পর্যবেক্ষণে অনুজ স্নেহভাজন কলামিস্ট অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রথম আলোতে তাঁর নিবন্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, বিএনপি একটি নির্জীব প্রতিষ্ঠান। এরা বর্তমান সরকারের কোনো নীলনকশার নির্বাচন প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে না। হয়তো তাই, কিন্তু তার পরও তো আদৌ হবে কি না, আশঙ্কাটি তো যাচ্ছে না। তার পরও দ্বিতীয় ভাবনা বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক বনাম আওয়ামী লীগের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা নিয়ে কোন্দলের অবসান হবে কি? না হলে আরেকটি এক-এগারো সরকার বহালের আশঙ্কা অবসানের জন্য নির্বাচন আদৌ না হলে কী হয়? এই প্রশ্নের জবাব পরবর্তী সময়ে দিচ্ছি।
আজকের নিবন্ধটি হালকা মেজাজে শুরু করেছিলাম। কিন্তু নির্বাচন সম্পর্কীয় আমার উক্ত আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তা নিরসনের যে দুটি উপায় নির্ধারণ করেছি অথবা সমাধানের প্রস্তাব দিচ্ছি, সেগুলো নিছক রসিকতা মনে না করে সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে অনুরোধ করছি। দুটি প্রস্তাবের একটি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেত্রী বিবেচনা করে দেখতে পারেন। সেটি হলো এত ঝামেলা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অস্বচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কে না গিয়ে একাধিপত্যের সংসদে ষোড়শ সংশোধনী পাস করা যেতে পারে। সংবিধানের পঞ্চম ভাগ ষোড়শ সংশোধন করে মেয়াদ শেষে বর্তমান সংসদের আয়ুষ্কাল এখনই আরও পাঁচ বছর বর্ধিত করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে সংবিধানের যে চতুর্থ সংশোধনী করেছিল, সেখানে ৩৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে দায়িত্ব পালনরত সংসদ এই আইন প্রবর্তন হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে ভাঙ্গিয়া যাইবে।’ তার মানে ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ সদস্যরা নিজেরাই তিন বছর বাড়িয়ে দিলেন। এমনটি করলে তত্ত্বাবধায়ক নাকি অন্তর্বর্তীকালীন সংসদের অধীনে নির্বাচন হবে, সেই বিতর্কের সাময়িক অবসান ঘটবে। এই সংশোধনী নতুন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাবে কি না, সেটি পরে দেখা যাবে। এতে নতুন সংকট ও সংঘাতের সূচনা হতে পারে। তা হোক না, এমনিতে যা হবে তেমনিতেও তা হবে। তবে বর্তমান সরকার বিতর্কের ঝামেলা থেকে মুক্ত হবে।
আমার অন্য প্রস্তাবটি হচ্ছে, জাতিসংঘের মাধ্যমে আফ্রিকার বিভিন্ন সংঘাতময় দেশে শান্তিরক্ষী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই সব বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনা ও পুলিশও রয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে সংঘাত শুরু হওয়ার আগেই বিরোধী দল জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করতে পারে। প্রস্তাবটি সর্বজনগ্রাহ্য হবে বলে মনে হচ্ছে।
সম্মানিত দুই নেত্রীকে অনুরোধ, দুটি প্রস্তাব হালকাভাবেই নেবেন অথবা নেবেন না। তবে আমার রসিক পাঠকেরা উপভোগ করবেন। যা হোক, অসুস্থ শরীরে, চিন্তাশক্তির এলোমেলো অবস্থানের কারণে হালকা মেজাজে নিবন্ধটি শুরু করেছিলাম, সেভাবেই শেষ করলাম।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
আমার সিলেটি পাঠককে আশ্বস্ত করলাম, অন্য কোনো কারণে নয়, প্রায় ছয় মাস হূদয়ের বেদনা, ফুসফুসের দুর্বলতা, আরও অনেক বয়সজনিত রোগে পর্যুদস্ত হওয়ার কারণে লেখালেখি হয়নি। ঢাকার ল্যাবএইডের প্রখ্যাত চিকিৎসক বরেন চক্রবর্তী কিছুদিন কেবিনে শুইয়ে রেখে পাঠালেন প্রথমে নয়াদিল্লির এসকর্টে, তারপর সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে। কিঞ্চিৎ সুস্থ হয়ে প্রথম আলোর পাঠকদের সামনে হাজির হয়ে লিখতে গিয়ে মহা ফাঁপরে পড়েছি। আমার এই কলামটিতে প্রথাগত কারণে দেশে সর্বশেষ সংঘটিত ঘটনা ন্যূনাধিক বিচার-বিশ্লেষণ করি। কিন্তু এক দিন পর পরই দেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে নিত্যনতুন ঘটনার সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিবিম্ব আয়নায় দেখছি। একটি নিয়ে লেখা শুরু করলে আরেকটি বিষয় সামনে এসে যায়। সঠিক সময়ে তক্ষুনি সংঘটিত ঘটনার বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করা হয় না। তবু রেশ হারিয়ে যায়নি এমন দু-চারটি নিয়ে ‘বুড়ি ছোঁয়ার’ মতো আলোচনা করছি।
পাঁচ-ছয় মাস অথবা আরও বেশি সময় পূর্বকালে আমার সর্বশেষ লেখাটি ছিল সাগর-রুনি হত্যা নিয়ে সাংবাদিক অনুজদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। আমি লিখেছিলাম, ‘সাগর-রুনি প্রাণ দিয়েই’ বিগত বিএনপি আমলের বিভক্তকৃত সাংবাদিক সমাজকে নিজস্ব পেশাগত নয়, রাজনৈতিক বিভেদের বৃত্ত থেকে অনেকখানি বের করে নিয়ে এসেছে। তারা আবার ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, বিভেদের প্রাচীর ভেঙে পড়া শুরু হলো। তাদের উৎসাহ দিতে অসুস্থ শরীর নিয়েই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ঐক্যবদ্ধ ‘মানববন্ধনে’ কিছুক্ষণের জন্য অংশ নিয়েছিলাম। মানববন্ধনে অংশ নেওয়ায় ডা. বরেন চক্রবর্তী বিচলিত হলেন। প্রতিদিন দেশের চলমান ঘটনা টেলিভিশনে দেখে ও পত্রিকায় পড়ে উত্তেজিত হতে পারি, এই আশঙ্কায় নিষেধাজ্ঞা জারি হলো, কিছুদিন টেলিভিশন দেখতে মানা, আর পত্রিকার পাতায় চোখ বোলানোর প্রশ্নই ওঠে না।
নিষেধাজ্ঞাটি প্রসঙ্গে প্রথম আলোর একটি সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রে ‘ভ্রমণ রঙ্গে’ প্রকাশিত রসাল গল্পটি একটুখানি অদলবদল করে ছাপছি। গল্পের সূচনা হচ্ছে জাহাজডুবির পর এক বাংলাদেশি নির্জন দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছেন। দ্বীপটিতে ছিল হিংস্র বাঘ-ভালুক আর সাপের বিচরণ। আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশি কয়েক দিন সেই দ্বীপে শঙ্কিত জীবনযাপনের পর একদিন দূরে সমুদ্রে একটি জাহাজ দেখতে পেলেন। তিনি হাত নাড়তেই বাংলাদেশি জাহাজটি থেকে একটি ডিঙি নৌকা এল। বাংলাদেশি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘যাক, সাপ আর বাঘ-ভালুকের ভয়ে শঙ্কিত ও ভয়ার্ত দিন কাটাতে হবে না। ডিঙি নৌকার নাবিকটি বলল, ‘আপনাকে নিতে আসিনি। আমাদের কাপ্তেন আপনার জন্য গত এক মাসের ঢাকার কয়েকটি পত্রিকা পাঠিয়েছেন। পত্রিকাগুলো পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—দেশে যাবেন, নাকি এখানে থাকাটা অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যময় ও নিরাপদ মনে করেন।’
রূপান্তরিত রসাল গল্পটি এখানেই শেষ। কয়েকটি হাসপাতালে বিচরণ করে বাসায় ফিরে আমি সাম্প্রতিক ও বর্তমানের দৈনিক কাগজগুলো পড়ে ভাবছিলাম, সেই নির্জন দ্বীপে আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তিটি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা কিন্তু গল্পে নেই। আমার প্রিয় পাঠকদের জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনি হলে কী উত্তর দিতেন?’
দীর্ঘদিন পর নতুন করে লিখতে বসেছি, যদিও প্রথম আলোর স্নেহভাজন এ কে এম জাকারিয়া সস্নেহে বারবার বলেছেন, ‘পুরোপুরি সুস্থ হয়ে নিন, তারপর লেখালেখি।’ কিন্তু ঢেঁকি ধান ভানবে না, তা কী করে হয়! অর্ধসুস্থ অবস্থায় প্রথমে জানতে ইচ্ছে হলো, সাগর-রুনি হত্যার কী সমাধান হলো? সাংবাদিকদের মিলিত আন্দোলনের ফলাফল কী। প্রেসক্লাবে এক অনুজ সাংবাদিককে প্রশ্নটি করার পর সে জানাল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চা খাইয়ে আর প্রধানমন্ত্রী ডেকে নিয়ে মিষ্টি হেসে বেতন বোর্ড দেওয়ার পর হত্যার সমাধান হয়ে গেছে। হায় রে কপাল! মনে পড়ল ১৯৬০ সালে আমি যখন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ডেইলি স্টার-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আমার বন্ধু এস এম আলী সভাপতি, তখনই আমরা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের কাছ থেকে বেতন বোর্ড আদায় করেছিলাম। সেই বোর্ডের সুপারিশ কার্যকর করার জন্য ১৯৬১ সালে ধর্মঘট করতে হয়েছিল। সমগ্র পাকিস্তানের সব পত্রিকায় ব্যতিক্রম ছিল একটি, গোলাম রসুল মল্লিকের ‘এনা-ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি।’ খুশি হয়ে রসুলকে বললাম, ‘তুই সবার আগে বেতন বোর্ড কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছিস, কী ব্যাপার।’ সে বত্রিশটি দাঁত দেখিয়ে উত্তর দিল, ‘বেতনই যখন দিই না, বেতন বোর্ডের সুপারিশ মেনে নিতে বাধা কোথায়!’ যা-ই হোক, বোঝা গেল, সব পত্রিকা বোর্ডের নির্দেশনা মানবে কি না জানি না, তবে বিএনপির আমলে বিভক্ত সাংবাদিক সমাজকে আওয়ামী আমলে জোড়া লাগতে দেওয়া হলো না।
পাঠক, মাঝেমধ্যে লেখার খেই হারিয়ে অন্যদিকে যেতে হচ্ছে। কারণ, আপডেটেড হয়ে, মানে পত্রিকাজগৎ থেকে আমার বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণকালে এত সব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো সম্পর্কে সব দু-চার বাক্য লিখলেও প্রথম আলোর একটি পূর্ণ পৃষ্ঠা পূরণ হয়ে যাবে। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, প্রধানমন্ত্রীর বেডরুম পাহারা অথবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজ দায়িত্বে ঘরে তালা দিয়ে বাড়ি যাওয়া এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিতর্ক, সেমিনার, বিদগ্ধজনের মতামত এবং সর্বোপরি দুই প্রধান দলের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। এ ছাড়া বুয়েট সংকট, সর্বশেষ হলমার্ক কেলেঙ্কারি এবং এ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘চার হাজার কোটি কোনো টাকাই নয়।’ প্রতিটি বিষয় আলোচনা করতে হবে কিন্তু স্থানাভাবে করা যাচ্ছে না। তাই শুধু নির্বাচন-পদ্ধতি তথা তত্ত্বাবধায়ক বনাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের ও অবসানের উপায় বাতলাতে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
যে একটি বিষয় আলোচনা করব বলেছি, সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। আগামী নির্বাচন নিয়ে তথা কোন পদ্ধতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিংবা আদৌ নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিতর্ক চলছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটাও হয়, ওটাও হয়। বাংলাদেশের সচেতন সাধারণ মানুষও ভাবছেন আর আতঙ্কে আছেন। তাঁরা শঙ্কিত, এ নিয়ে সংঘাত-হানাহানি হবে। এই সরকারের মেয়াদ পূর্তির শেষ লগ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে এক-এগারো ধরনের কোনো ব্যবস্থা কায়েম হতে পারে কি না, এ নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সরাসরি কেউ কেউ বলছেন, এক-এগারো এনেছিল নৌকার মালিক আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠার মাধ্যমে। এবার কি ধানের শীষের মালিক বিএনপি কাস্তে-কোদাল নিয়ে রাস্তায় নামবে? সে ধরনের কোনো লক্ষণ এখনো দেখছি না। আগামী বছর শেষে দেখব কি না জানি না। এ নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, কৌশলগত কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এত আগে মালকোঁচা মেরে কোনো জঙ্গি আন্দোলনে নামতে চায় না বিএনপি। টেলিভিশনে আমার এ ধরনের পর্যবেক্ষণে অনুজ স্নেহভাজন কলামিস্ট অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রথম আলোতে তাঁর নিবন্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, বিএনপি একটি নির্জীব প্রতিষ্ঠান। এরা বর্তমান সরকারের কোনো নীলনকশার নির্বাচন প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে না। হয়তো তাই, কিন্তু তার পরও তো আদৌ হবে কি না, আশঙ্কাটি তো যাচ্ছে না। তার পরও দ্বিতীয় ভাবনা বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক বনাম আওয়ামী লীগের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা নিয়ে কোন্দলের অবসান হবে কি? না হলে আরেকটি এক-এগারো সরকার বহালের আশঙ্কা অবসানের জন্য নির্বাচন আদৌ না হলে কী হয়? এই প্রশ্নের জবাব পরবর্তী সময়ে দিচ্ছি।
আজকের নিবন্ধটি হালকা মেজাজে শুরু করেছিলাম। কিন্তু নির্বাচন সম্পর্কীয় আমার উক্ত আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তা নিরসনের যে দুটি উপায় নির্ধারণ করেছি অথবা সমাধানের প্রস্তাব দিচ্ছি, সেগুলো নিছক রসিকতা মনে না করে সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে অনুরোধ করছি। দুটি প্রস্তাবের একটি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেত্রী বিবেচনা করে দেখতে পারেন। সেটি হলো এত ঝামেলা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অস্বচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কে না গিয়ে একাধিপত্যের সংসদে ষোড়শ সংশোধনী পাস করা যেতে পারে। সংবিধানের পঞ্চম ভাগ ষোড়শ সংশোধন করে মেয়াদ শেষে বর্তমান সংসদের আয়ুষ্কাল এখনই আরও পাঁচ বছর বর্ধিত করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে সংবিধানের যে চতুর্থ সংশোধনী করেছিল, সেখানে ৩৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে দায়িত্ব পালনরত সংসদ এই আইন প্রবর্তন হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে ভাঙ্গিয়া যাইবে।’ তার মানে ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ সদস্যরা নিজেরাই তিন বছর বাড়িয়ে দিলেন। এমনটি করলে তত্ত্বাবধায়ক নাকি অন্তর্বর্তীকালীন সংসদের অধীনে নির্বাচন হবে, সেই বিতর্কের সাময়িক অবসান ঘটবে। এই সংশোধনী নতুন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাবে কি না, সেটি পরে দেখা যাবে। এতে নতুন সংকট ও সংঘাতের সূচনা হতে পারে। তা হোক না, এমনিতে যা হবে তেমনিতেও তা হবে। তবে বর্তমান সরকার বিতর্কের ঝামেলা থেকে মুক্ত হবে।
আমার অন্য প্রস্তাবটি হচ্ছে, জাতিসংঘের মাধ্যমে আফ্রিকার বিভিন্ন সংঘাতময় দেশে শান্তিরক্ষী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই সব বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনা ও পুলিশও রয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে সংঘাত শুরু হওয়ার আগেই বিরোধী দল জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করতে পারে। প্রস্তাবটি সর্বজনগ্রাহ্য হবে বলে মনে হচ্ছে।
সম্মানিত দুই নেত্রীকে অনুরোধ, দুটি প্রস্তাব হালকাভাবেই নেবেন অথবা নেবেন না। তবে আমার রসিক পাঠকেরা উপভোগ করবেন। যা হোক, অসুস্থ শরীরে, চিন্তাশক্তির এলোমেলো অবস্থানের কারণে হালকা মেজাজে নিবন্ধটি শুরু করেছিলাম, সেভাবেই শেষ করলাম।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments