ফুটবলের দেশ পেলের ব্রাজিল ক্রিকেটও খেলে। পেলের দেশে ক্রিকেট by সিয়াম রহমান

একটা কৌতুক। ব্যাটে রান নেই ভারতীয় অধিনায়কের, তার পরও তিনি ধ...নী (বড়লোক)! আর ট্রিপল সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি করেও অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক সেই ক্লা....র্ক (কেরানি)! নামে কিবা আসে যায়! মর্যাদাটাই আসল। তাহলে একটা ছোটগল্প। ধোনি, ক্লার্কের মতো জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ম্যাট ফেদারস্টোনও।


কিন্তু তাঁকে কাজ করতে হয় উপহারসামগ্রীর দোকানে! তাও দোকানটা স্ত্রীর! জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে কিছু বেতন-ভাতা পান ঠিকই, তবে তা দিয়ে গাড়ির পেট্রলের খরচও হয় না। হবে কীভাবে, ফেদারস্টোন যে ব্রাজিলের ক্রিকেট অধিনায়ক।
পেলে, গারিঞ্চা, সক্রেটিস, জিকো, রোনালদোদের দেশে ‘ক্রিকেট’ নামটা শোনেনি ৯৫ শতাংশ মানুষ। ক্রিকেট বোঝে না সাও পাওলো, রিও ডি জেনিরোর সমুদ্রের ঢেউগুলোও। সেই দেশের ক্রিকেট অধিনায়ককে চিনবে কজন! তার পরও ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া ফেদারস্টোনের স্বপ্ন—ফুটবল আর কফির দেশে ছড়িয়ে দেবেন ক্রিকেট-সৌরভও। এ জন্য দরকার একটু পৃষ্ঠপোষকতা আর আইসিসির সাহায্যের হাত। গত মাসে অবশ্য ক্রিকেটের প্রচারে ব্রাজিলে এসেছিলেন প্রিন্স হ্যারি। তিনি উল্টো প্রেমে পড়ে যান ব্রাজিলিয়ান ‘ট্যাকো’র!
ক্রিকেটের আদলে ‘টু-এ-সাইড’ খেলা ট্যাকো। এ জন্য স্টেডিয়ামে যাওয়ার দরকার নেই, গলির একটা রাস্তা হলেই হয়। বোলার থাকবে একজন, উইকেটরক্ষক একজন। তাদের বিপক্ষে খেলবে দুজন ব্যাটসম্যান। বাউন্ডারির বালাই নেই, রানের জন্য দৌড়াতে হবে স্টাম্পের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত। মজার এই খেলায় মাত্র ৭ বলই টিকে থাকতে পেরেছিলেন প্রিন্স হ্যারি! তিনি ৭ বলের বেশি খেলতে না পারলেও ব্রাজিলে ট্যাকো টিকে রয়েছে ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। ১৮৫০ সালের দিকে ইংরেজদের হাত ধরে ব্রাজিলে এসেছিল ক্রিকেট। ফুটবলের প্রচলন কিন্তু তারও পরে। অথচ ফুটবল ব্রাজিলে হয়ে গেছে প্রাণের স্পন্দন আর ক্রিকেট বদলে রূপ নিয়েছে ট্যাকোর!
সেই ট্যাকো খেলোয়াড়দের ক্রিকেটে নিয়ে আসার নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন ফেদারস্টোন আর ব্রাজিলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা। স্ত্রীর হাত ধরে ২০০০ সালে ব্রাজিলে পাড়ি দেওয়ার পর জাতীয় দলে সুযোগ পেতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি ফেদারস্টোনকে । ছোট শহর পোকোস ডি ক্যালডাস থেকে সাও পাওলোয় গিয়ে ক্লাবে খেলতে তাঁকে গাড়ি চালাতে হয় ঘণ্টা তিনেক। ক্লান্ত হন না তাতেও। এমনকি খেলতে অস্বীকৃতি জানাননি আইসিসির আন-অফিসিয়াল ম্যাচেও। আইসিসির সহযোগী সদস্য হওয়ার আগেই তাই ব্রাজিলের জার্সিতে খেলেছেন অনেক আন-অফিসিয়াল ম্যাচ। ২০০২ সালে আইসিসির খাতায় নাম তোলার চার বছরের মাথায় ফেদারস্টোনের দল যোগ্যতা অর্জন করে আইসিসি আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপে। ডিভিশন থ্রির এই টুর্নামেন্টের অভিষেকে তিনটি ম্যাচই হেরে যায় ব্রাজিলিয়ানরা।
এই দলটাই ঘুরে দাঁড়ায় বছর তিনেকের মাথায়। ২০০৯ সালের আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপে তারা চ্যাম্পিয়ন হয় চিলি, পেরু আর বেলিজকে হারিয়ে। পেরুর সঙ্গে তিন ম্যাচের আমিসতাড কাপেও ফেদারস্টোনের দল জেতে ২-১ ব্যবধানে। সেই টুর্নামেন্টের ৩ ম্যাচে ০, ৬৮* আর ৬৮ রানের সুবাদে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন ব্রাজিলিয়ান অধিনায়কই। তবে ২০১০ সালে বাহামায় অনুষ্ঠিত আরও একটি টুর্নামেন্টে কোনো ম্যাচই জেতেনি ব্রাজিল। তার পরও ব্রাজিলের তিনজন হয়েছিলেন তিন বিভাগের সেরা ক্রিকেটার। সেরা বোলার নির্বাচিত হয়েছিলেন রুদি হার্তম্যান, সেরা ফিল্ডার গুইলহার্ম লেফারভে আর সেরা ব্যাটসম্যান গ্রেগর কাইসলি। ব্রাজিলিয়ান ক্রিকেটের প্রাপ্তি আছে আরও একটা। রিও ডি জেনিরোতো জন্ম নেওয়া অশোক গনদোত্রা ১৯৬৯ সালে দুটি টেস্টও খেলেছেন ভারতের হয়ে।
২০০৯ সালের আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতায় পরের বছর ডিভিশন টু-তে উঠে এসেছিল ব্রাজিল। কিন্তু বইতে পারেনি এই ভার। তিনটি ম্যাচই হেরে নেমে যেতে হয় ডিভিশন থ্রিতে। তার পরও ফেদারস্টোনের অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আমাদের স্থান আসলে এখানেই। ডিভিশন টু আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার হয়ে যায়। তবে ইতিবাচক হচ্ছে, এখন এই দলের ৯-১০ জনের জন্মই ব্রাজিলে। অভিবাসী ক্রিকেটার যতই কমবে, দলের ভিত মজবুত হবে তত বেশি।’
দলের বেশির ভাগ ক্রিকেটার তরুণ হলেও ফেদারস্টোন কাটিয়ে ফেলেছেন ৪১টি বসন্ত। সেই তরুণেরা ক্রমেই ঝকঝক করছেন, লড়ছেন। আর তিরিশ গজি বৃত্তে বুঝি এক অক্ষৌহিণী সেনা হয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে চলেছেন একসময় কেন্টের হয়ে খেলা ফেদারস্টোন।
১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রিও ক্রিকেট ক্লাব। ১৫ বছর না যেতেই হারিয়ে যায় সেটা। সেই ঘুম ভেঙে আবারও নতুন করে জেগে উঠেছে ক্লাবটা। তাদের সঙ্গে ক্রিকেট ডালপালা মেলেছে সাও পাওলো, পারানা আর ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট অব ব্রাজিলিয়াতেও। এখানে ছেলেদের পাশাপাশি ক্রিকেট খেলছে মেয়েরাও। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, মেয়েদের দলের শতভাগ ক্রিকেটারের জন্মই ব্রাজিলে। ২২-২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইসিসি আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপেও অংশ নিয়েছে তারা।
ব্রাজিলিয়ান ক্রিকেটের আয়ের উৎস বলতে বিভিন্ন টর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার ফি আর আইসিসির সদস্য হিসেবে পাওয়া বছরে ২৫ হাজার ডলার। তবে সম্প্রতি এইচএসবিসি আর ভারতীয় চিনির কোম্পানি রেনুকা স্পনসর হয়েছে তাদের। ভারতের সঙ্গে একটা অদ্ভুত চুক্তিও আছে ব্রাজিলের। সেই চুক্তি অনুযায়ী পেলের দেশ থেকে যেমন কোনো কোচ ফুটবলের টিপস দেবেন ভারতীয়দের, তেমনি ভারতীয় কোচও ক্রিকেটের দীক্ষা দেবেন ব্রাজিলিয়ানদের। ভারতের পা যখন পড়েছে, তখন কি আর কফির গন্ধের সঙ্গে ক্রিকেটের সুবাস না ছড়িয়ে পারে?

No comments

Powered by Blogger.