জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-এ দীর্ঘ অচলাবস্থার দায় কার? by শামছুল আলম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটল। আন্দোলনরত সাংস্কৃতিক কর্মীদের ওপর হামলা চালাল ছাত্রলীগের কর্মীরা। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, বর্তমান উপাচার্য ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যেও বিভাজন, অসন্তোষ সৃষ্টি করেছেন।
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে তাঁর অনুগত চেয়ারম্যান দিয়ে মারধরের নাটক সাজিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, তিনি আন্দোলনরত শিক্ষকদের ভয় দেখানোর জন্য উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান কর্তৃক মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত আন্দোলনকারী দুজন শিক্ষককে মধ্যরাতে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের কদর্য ঘটনা ঘটিয়ে তিনি নিন্দিত হয়েছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা এর প্রতিবাদে উপাচার্যের বাসভবন অবরোধ করেন।
সর্বশেষ ২৭ এপ্রিল উপাচার্য তাঁর অনুগত শিক্ষক বাহিনী এবং ভিসিপন্থী ছাত্রলীগ কর্তৃক পেছনের দরজা দিয়ে অবরোধ থেকে মুক্ত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। আলোর পথের লোকজন পেছনের পথ দিয়ে আসা-যাওয়া করে না। শুধু তা-ই নয়, এ দিন ভিসিপন্থী ছাত্রলীগ প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষকসমাজের স্থাপিত ‘উপাচার্য প্রত্যাখ্যান মঞ্চ’ ভেঙে পুড়িয়ে ফেলেছে। এটা কতটা তাঁর নৈতিক পরাজয়, তা অনুধাবনের সক্ষমতাও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। ড. শরীফ এনামুল কবির সব সময় উপাচার্য থাকবেন না। কিন্তু তিনি যে কর্ম সাধন করেছেন, তাতে ইতিহাসে এনামুল কবির নিন্দিত উপাচার্য হিসেবেই স্থান পাবেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাসের অধিক সময় ধরে ‘শিক্ষকসমাজের’ ব্যানারে শিক্ষকেরা উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। জুবায়ের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে ছাত্রছাত্রীরাই এর সূত্রপাত করে। জুবায়ের একসময় ছাত্রলীগের একটা গ্রুপের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া সত্ত্বেও তাকে খুন হতে হয় ছাত্রলীগের অপর গ্রুপের কর্মীদের হাতে।
জুবায়ের নিহত হওয়ার খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’-এর ব্যানারে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এরপর শিক্ষকেরা আন্দোলনে যুক্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে প্রথমে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। এরপর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিতর্কিত ও গোঁজামিলের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ জড়িত সাত ছাত্রকে আজীবন এবং পরোক্ষ জড়িত ছয় ছাত্রকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার ও অপরাধীদের ছবিসহ পোস্টার প্রকাশ করে। উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করলে সবার প্রশংসা পেতেন এবং হতে পারতেন অনুকরণীয়। শিক্ষকসমাজ সেই দাবি জানালেও তিনি আমলে নেননি।
জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষকসমাজ জুবায়ের আহমেদকে বাঁচানোর ব্যর্থতার দায়ে প্রক্টর ড. আরজু মিয়ার পদত্যাগের দাবি সামনে রেখে আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলনে প্রগতিশীল বাম, বিএনপি মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং আওয়ামী মতাদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষকেরা অংশগ্রহণ করছেন। একটা সময়ে প্রক্টর এবং সহকারী প্রক্টররা যখন পদত্যাগ করেন, তখন শিক্ষকসমাজের দাবির বিস্তৃতি ঘটে। শিক্ষকসমাজ মেয়াদোত্তীর্ণ সব পর্ষদের নির্বাচন দাবি করে। দাবি করে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনেরও। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুযায়ী চ্যান্সেলর যে কাউকে চার বছরের এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করতে পারলেও আবার ওই অ্যাক্টে ৪৫ দিনের মধ্যে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন আয়োজনের কথাও বলা আছে। গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে অতীতে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দেওয়াও হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে চ্যান্সেলর কর্তৃক উপাচার্য পদপ্রাপ্ত ড. জসীম উদ্দিন আহমদের কাছে বর্তমান উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের দাবিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। উপাচার্য পদে আসীন হয়ে এনামুল কবির বিষয়টি ভুলে গেলেন।
শিক্ষকসমাজ এসব নির্বাচন সামনে রেখে মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন পর্ষদের নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো শিক্ষক না দিতে উপাচার্যের কাছে দাবি জানিয়েছিল। শিক্ষকসমাজের প্রচারপত্রের বক্তব্য অনুযায়ী, উপাচার্য এই দাবি মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু গত ১০ মার্চ গণিত বিভাগের একটি সিলেকশন সভাকে কেন্দ্র করে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে যায়, পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য বলেছেন, বিগত প্রশাসনের সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিভিন্ন বিভাগে পদ বিজ্ঞাপিত হলেও শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই, বর্তমান প্রশাসন শিক্ষকস্বল্পতা দূর করার জন্য ১৯৫ জনের অধিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। পক্ষান্তরে শিক্ষকসমাজের বক্তব্য হচ্ছে, বিভাগের চাহিদার চেয়ে বহু গুণ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এভাবে মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্থিক দিক থেকে দুর্বল করার বিষয়টি চিন্তা না করে বর্তমান উপাচার্য বিভিন্ন পর্ষদের নির্বাচনে জেতার জন্য ‘ভোটার শিক্ষক’ নিয়োগ দিয়েছেন। তাঁরা আরও অভিযোগ করছেন, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অনেকেরই একাডেমিক এবং চারিত্রিক ও ব্যক্তিত্ব সমস্যা রয়েছে। ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে একজন হত্যা মামলার আসামিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে অনেককে ‘উপাচার্যের অনুগত’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। শিক্ষকসমাজের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. নাসিম আখতার হুসাইন একাধিকবার তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘কর্তৃপক্ষ এদের সঙ্গে প্রভুর মতো আচরণ করছে এবং এরাও সেই মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে।’ উপাচার্য নিয়োগপ্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রেখেছেন। সর্বশেষ ২৩ এপ্রিল বিভিন্ন বিভাগে ১৪টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনে জেতার জন্য শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগটি আমলে নেওয়ার মতো। বিগত শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের আগের দিন একসঙ্গে ৩২ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও নির্বাচনে উপাচার্যের অনুসারী শিক্ষকেরা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১৫ পদের মধ্যে চারটিতে হেরে যায়। প্রশ্ন জাগে, এই ৩২ জনকে নিয়োগ দেওয়া না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ পদে উপাচার্যবিরোধী গ্রুপের শিক্ষকেরা বিজয়ী হতেন।
বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণ করে স্কুল ও কলেজে কমপক্ষে পাঁচজনকে অ্যাডহক নিয়োগ দিয়েছিলেন। উপাচার্য তাঁর আস্থাভাজন ছাত্রীহলের এক প্রভোস্ট এবং সিন্ডিকেট সদস্যের শ্যালিকাকে জাবি স্কুল ও কলেজে অ্যাডহক নিয়োগের মাধ্যমে অ্যাডহক নিয়োগের সূচনা করেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী পদে অ্যাডহক নিয়োগ দিয়েছেন। অথচ সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য ল অ্যান্ড জাস্টিজ বিভাগের সভাপতি ছাড়া আর কাউকে অ্যাডহক নিয়োগ দেননি বলে চরম মিথ্যাচার করেছেন। শুধু তা-ই নয়, আর্থিক অভিযোগে দুষ্ট কোনো কোনো শিক্ষককে একাধিক প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
এখন শিক্ষকসমাজ ‘উপাচার্যের পদত্যাগের’ এক দফার দাবি নিয়ে এগোচ্ছে। ‘উপাচার্যের পদত্যাগ’ আন্দোলনকারী শিক্ষকদের দাবি ছিল না। কারণ, এনামুল কবির এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্য থেকে প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর ওপর আস্থা রাখা যায় না। শিক্ষকসমাজের কাছে দেওয়া সব আশ্বাস এবং প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করেছেন। সর্বোচ্চ প্রশাসনে থেকে অসত্য বলা অনুচিত, এটা তিনি ভুলে গেছেন। এ ছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষকসমাজ চিন্তাভাবনা করেছে, বর্তমান উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া হলে আওয়ামী মতাদর্শের আরেকজন নতুন উপাচার্য হবেন। সেখানে উপাচার্যের পরিবর্তনে গুণগত পরিবর্তন আশা করা যায় না। শিক্ষকসমাজ বর্তমানে বাধ্য হয়েই উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবি করছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিন মাসের অধিক সময় ধরে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি কচ্ছপগতিতে এগিয়ে চলছে। দ্রুত এ অবস্থার নিরসন প্রয়োজন। বিলম্বে বোধোদয় নয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চটজলদি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন সরকারেরও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা। অন্যথায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা ব্যাহত হতে পারে, যা কারও কাম্য নয়।
ড. শামছুল আলম: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ ২৭ এপ্রিল উপাচার্য তাঁর অনুগত শিক্ষক বাহিনী এবং ভিসিপন্থী ছাত্রলীগ কর্তৃক পেছনের দরজা দিয়ে অবরোধ থেকে মুক্ত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। আলোর পথের লোকজন পেছনের পথ দিয়ে আসা-যাওয়া করে না। শুধু তা-ই নয়, এ দিন ভিসিপন্থী ছাত্রলীগ প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষকসমাজের স্থাপিত ‘উপাচার্য প্রত্যাখ্যান মঞ্চ’ ভেঙে পুড়িয়ে ফেলেছে। এটা কতটা তাঁর নৈতিক পরাজয়, তা অনুধাবনের সক্ষমতাও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। ড. শরীফ এনামুল কবির সব সময় উপাচার্য থাকবেন না। কিন্তু তিনি যে কর্ম সাধন করেছেন, তাতে ইতিহাসে এনামুল কবির নিন্দিত উপাচার্য হিসেবেই স্থান পাবেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাসের অধিক সময় ধরে ‘শিক্ষকসমাজের’ ব্যানারে শিক্ষকেরা উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। জুবায়ের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে ছাত্রছাত্রীরাই এর সূত্রপাত করে। জুবায়ের একসময় ছাত্রলীগের একটা গ্রুপের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া সত্ত্বেও তাকে খুন হতে হয় ছাত্রলীগের অপর গ্রুপের কর্মীদের হাতে।
জুবায়ের নিহত হওয়ার খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’-এর ব্যানারে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এরপর শিক্ষকেরা আন্দোলনে যুক্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে প্রথমে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। এরপর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিতর্কিত ও গোঁজামিলের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ জড়িত সাত ছাত্রকে আজীবন এবং পরোক্ষ জড়িত ছয় ছাত্রকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার ও অপরাধীদের ছবিসহ পোস্টার প্রকাশ করে। উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করলে সবার প্রশংসা পেতেন এবং হতে পারতেন অনুকরণীয়। শিক্ষকসমাজ সেই দাবি জানালেও তিনি আমলে নেননি।
জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষকসমাজ জুবায়ের আহমেদকে বাঁচানোর ব্যর্থতার দায়ে প্রক্টর ড. আরজু মিয়ার পদত্যাগের দাবি সামনে রেখে আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলনে প্রগতিশীল বাম, বিএনপি মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং আওয়ামী মতাদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষকেরা অংশগ্রহণ করছেন। একটা সময়ে প্রক্টর এবং সহকারী প্রক্টররা যখন পদত্যাগ করেন, তখন শিক্ষকসমাজের দাবির বিস্তৃতি ঘটে। শিক্ষকসমাজ মেয়াদোত্তীর্ণ সব পর্ষদের নির্বাচন দাবি করে। দাবি করে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনেরও। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুযায়ী চ্যান্সেলর যে কাউকে চার বছরের এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করতে পারলেও আবার ওই অ্যাক্টে ৪৫ দিনের মধ্যে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন আয়োজনের কথাও বলা আছে। গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে অতীতে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দেওয়াও হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে চ্যান্সেলর কর্তৃক উপাচার্য পদপ্রাপ্ত ড. জসীম উদ্দিন আহমদের কাছে বর্তমান উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের দাবিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। উপাচার্য পদে আসীন হয়ে এনামুল কবির বিষয়টি ভুলে গেলেন।
শিক্ষকসমাজ এসব নির্বাচন সামনে রেখে মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন পর্ষদের নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো শিক্ষক না দিতে উপাচার্যের কাছে দাবি জানিয়েছিল। শিক্ষকসমাজের প্রচারপত্রের বক্তব্য অনুযায়ী, উপাচার্য এই দাবি মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু গত ১০ মার্চ গণিত বিভাগের একটি সিলেকশন সভাকে কেন্দ্র করে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে যায়, পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য বলেছেন, বিগত প্রশাসনের সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিভিন্ন বিভাগে পদ বিজ্ঞাপিত হলেও শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই, বর্তমান প্রশাসন শিক্ষকস্বল্পতা দূর করার জন্য ১৯৫ জনের অধিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। পক্ষান্তরে শিক্ষকসমাজের বক্তব্য হচ্ছে, বিভাগের চাহিদার চেয়ে বহু গুণ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এভাবে মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্থিক দিক থেকে দুর্বল করার বিষয়টি চিন্তা না করে বর্তমান উপাচার্য বিভিন্ন পর্ষদের নির্বাচনে জেতার জন্য ‘ভোটার শিক্ষক’ নিয়োগ দিয়েছেন। তাঁরা আরও অভিযোগ করছেন, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অনেকেরই একাডেমিক এবং চারিত্রিক ও ব্যক্তিত্ব সমস্যা রয়েছে। ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে একজন হত্যা মামলার আসামিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে অনেককে ‘উপাচার্যের অনুগত’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। শিক্ষকসমাজের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. নাসিম আখতার হুসাইন একাধিকবার তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘কর্তৃপক্ষ এদের সঙ্গে প্রভুর মতো আচরণ করছে এবং এরাও সেই মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে।’ উপাচার্য নিয়োগপ্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রেখেছেন। সর্বশেষ ২৩ এপ্রিল বিভিন্ন বিভাগে ১৪টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনে জেতার জন্য শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগটি আমলে নেওয়ার মতো। বিগত শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের আগের দিন একসঙ্গে ৩২ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও নির্বাচনে উপাচার্যের অনুসারী শিক্ষকেরা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১৫ পদের মধ্যে চারটিতে হেরে যায়। প্রশ্ন জাগে, এই ৩২ জনকে নিয়োগ দেওয়া না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ পদে উপাচার্যবিরোধী গ্রুপের শিক্ষকেরা বিজয়ী হতেন।
বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণ করে স্কুল ও কলেজে কমপক্ষে পাঁচজনকে অ্যাডহক নিয়োগ দিয়েছিলেন। উপাচার্য তাঁর আস্থাভাজন ছাত্রীহলের এক প্রভোস্ট এবং সিন্ডিকেট সদস্যের শ্যালিকাকে জাবি স্কুল ও কলেজে অ্যাডহক নিয়োগের মাধ্যমে অ্যাডহক নিয়োগের সূচনা করেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী পদে অ্যাডহক নিয়োগ দিয়েছেন। অথচ সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য ল অ্যান্ড জাস্টিজ বিভাগের সভাপতি ছাড়া আর কাউকে অ্যাডহক নিয়োগ দেননি বলে চরম মিথ্যাচার করেছেন। শুধু তা-ই নয়, আর্থিক অভিযোগে দুষ্ট কোনো কোনো শিক্ষককে একাধিক প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
এখন শিক্ষকসমাজ ‘উপাচার্যের পদত্যাগের’ এক দফার দাবি নিয়ে এগোচ্ছে। ‘উপাচার্যের পদত্যাগ’ আন্দোলনকারী শিক্ষকদের দাবি ছিল না। কারণ, এনামুল কবির এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্য থেকে প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর ওপর আস্থা রাখা যায় না। শিক্ষকসমাজের কাছে দেওয়া সব আশ্বাস এবং প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করেছেন। সর্বোচ্চ প্রশাসনে থেকে অসত্য বলা অনুচিত, এটা তিনি ভুলে গেছেন। এ ছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষকসমাজ চিন্তাভাবনা করেছে, বর্তমান উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া হলে আওয়ামী মতাদর্শের আরেকজন নতুন উপাচার্য হবেন। সেখানে উপাচার্যের পরিবর্তনে গুণগত পরিবর্তন আশা করা যায় না। শিক্ষকসমাজ বর্তমানে বাধ্য হয়েই উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবি করছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিন মাসের অধিক সময় ধরে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি কচ্ছপগতিতে এগিয়ে চলছে। দ্রুত এ অবস্থার নিরসন প্রয়োজন। বিলম্বে বোধোদয় নয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চটজলদি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন সরকারেরও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা। অন্যথায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা ব্যাহত হতে পারে, যা কারও কাম্য নয়।
ড. শামছুল আলম: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments