বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-সুখের ঠিকানা : সামনে ভুটান পেছনে বাংলাদেশ by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
ভুটান দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট একটি দেশ। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক জোট 'সার্ক'-এর সদস্য রাষ্ট্র ভুটানের জনসংখ্যা এক কোটিরও কম। প্রায় ৭৫ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই ছোট্ট রাষ্ট্রটিতে সুখের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দাবি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ইউরোপ এগিয়ে রয়েছে বটে এবং তাদের মধ্যে সুখী কয়েকটি দেশও আছে; কিন্তু এর পরও ভুটানের মানুষ অনেক বেশি সুখী।
হিমালয়ের ছোট্ট দেশ ভুটান সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুটি কারণে অধিক পরিচিত হয়ে উঠেছে। প্রথমটি হলো, কিংডম অব ভুটানে পর্যটকদের আগমন হ্রাস করতে উচ্চ ভিসা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি খুব মজার। ভুটানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বদলে উন্নয়ননীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে মোট জাতীয় সুখের ধারণা। গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস অর্থাৎ জাতীয় সুখ নিশ্চিত করার ব্যাপারে ভুটান ইতিমধ্যে জোরদার পদক্ষেপও নিয়েছে। দেশটির নীতিনির্ধারকদের যুক্তি, পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি জাতীয় অর্থনীতির জন্য সুবার্তা বয়ে আনলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতি। সন্দেহ নেই, শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য এ দুই-ই জরুরি। পরিবেশ ও সংস্কৃতি যদি আক্রান্ত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে মানুষের সুখ কমে যেতে বাধ্য। এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে ভূরি ভূরি। ভুটানের নীতিনির্ধারকরা উপার্জন বা মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির (জিডিপি) চেয়েও সংগত কারণেই মানুষের সুখের মাত্রা বাড়ানোর দিকে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর দৃষ্টি দিয়েছেন এবং তাঁরা এ ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছেন।
২০১২ সালের ২ এপ্রিল নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সুখবিষয়ক সম্মেলনে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত 'ওয়ার্ল্ভ্র হ্যাপিনেস রিপোর্ট'-এ যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে, তা হলো টাকা-পয়সা দিয়ে সুখ কেনা যায় না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, প্রযুক্তির বিকাশ, উন্নত জীবনযাত্রার মান একটি দেশের সুখের জন্য যথেষ্ট নয়। ধনী দেশ মাত্রই সে দেশের মানুষ সুখী হবে_এমনও কোনো কথা নেই। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে উলি্লখিত এসব বিষয় যুক্তিযুক্ত। এও সত্য যে সামাজিক নিরাপত্তা, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শান্তি, শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য এবং শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন মানুষকে সুখী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উলি্লখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই রক্তস্নাত বাংলাদেশের চিত্র খুব বিবর্ণ। এই চিত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বপ্নের বাংলাদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। স্বাধীনতা অর্জনের ৪১ বছর ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত হলেও যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে এ দেশের মানুষ বিপুল প্রাণ বিসর্জন এবং রক্ত খরচে দেশটির অভ্যুদয় ঘটিয়েছিল, সব রকম বর্বরতা-পাশবিকতা, অন্যায়-অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এর বেশির ভাগই অর্জিত হয়নি। আর এ জন্যই ওই প্রতিবেদনে সুখী দেশের তালিকায় ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৪তম নির্ণয় হয়েছে। গত আড়াই বছরে যদিও আমাদের দারিদ্র্য কমেছে ১০ শতাংশ, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, শিক্ষা ও গড় আয়ুষ্কালও বেড়েছে, কমেছে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার, তবুও অর্থনীতি ও সামাজিক এসব সূচকের উন্নতি মানুষের সুখী হওয়ার জন্য যে যথেষ্ট নয়, বাংলাদেশের চেয়ে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? সন্দেহ নেই যে অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করায় এটি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। ওই প্রতিবেদনে নাগরিকদের সুখী করার জন্য বেশ কিছু পরামর্শও উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ, সামাজিক ব্যবস্থাকে ফের সঞ্চারিত করা, কার্যকর শ্রম নীতিমালার বাস্তবায়ন, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, জনস্বার্থ সংরক্ষণ এবং সর্বোপরি স্থিতিশীল ও গঠনমূলক রাজনীতি চর্চার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব প্রস্তাবের বেশির ভাগই বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় বাস্তবায়ন দুরূহ শুধু রাষ্ট্র ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রক কিংবা পরিচালকদের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ডের কারণে। এখানে প্রধান সমস্যা রাজনীতি ও তৎসংশ্লিষ্ট আরো কিছু বিষয়। যে রাজনীতি রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিকদের জন্য অপরিহার্য, সে রাজনীতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখান থেকে হারিয়ে গেছে। অথচ এ দেশের যা কিছু শুভ ও কল্যাণকর অর্জন ইতিমধ্যে সাধিত হয়েছে, সবই কিন্তু রাজনীতির মাধ্যমে। রাজনীতির মাঠ থেকে রাজনীতিকদের নানাভাবে হটিয়ে দেওয়ার অপক্রিয়া এখনো অব্যাহত। রাষ্ট্রকে বিরাজনীতিকীকরণের অপক্রিয়াও থেমে নেই। এ সবই একটি দেশ ও সে দেশের জনগণকে অসুখী করার অন্যতম কারণ। নিশ্চয়ই এ বিষয়টি রাজনীতিকরাও অস্বীকার করবেন না।
এ দেশে সাধারণ মানুষের জীবন কাটে অন্তহীন সমস্যার মধ্যে। এখন আর কেবল নিম্ন আয়ের মানুষই নয়, মধ্য ও উচ্চমধ্যবিত্ত, এমনকি যাদের সংগতি যথেষ্ট শক্ত, তাদের জীবনও নানা রকম বিড়ম্বনার ঝড়ে ঝড়াক্রান্ত। এখানে মানুষের আয়ের অর্ধেকের বেশি অর্থ চলে যায় শুধু খাদ্য কিনতেই। আয় বেড়েছে তা অসত্য নয়; কিন্তু আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যয়ও। শুধু যে খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রেই ব্যয় বেড়েছে তা-ই নয়, ব্যয় বেড়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহনসহ জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে। আমাদের সব সমস্যার উৎস হলো দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অদূরদর্শিতা আর সম্পদের অসমচিত্র। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য পায় দল বা ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা। নিরাপত্তাহীনতা অন্যতম একটি উপসর্গ, যা সাধারণ মানুষের সুখ কেড়ে নিয়েছে। উপসর্গ আরো আছে, যা এ দেশের জনজীবনের সব স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছে। এ দেশে সরকারে কিংবা সরকারের বাইরে যাঁরা আছেন, দেশ-জাতির কল্যাণে তাঁদের উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি একটি খেলায় পরিণত হয়েছে। নিজ বা দলীয় স্বার্থটাই তাঁদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। যে দেশে রাজনীতির নামে মানুষ মানুষকে পুড়িয়ে মারতেও কুণ্ঠাবোধ করে না, সে দেশে সুখ কতটা সুদূরপরাহত_এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। এটি একটি মাত্র মর্মন্তুদ ঘটনার উল্লেখ করা গেল_এ রকম নেতিবাচক দৃষ্টান্ত আছে অসংখ্য এবং সচেতন মানুষমাত্রই এসব বিষয়ে জ্ঞাতও। তবে আশার কথা হলো, মানুষকে অচেতন করে রাখার সব রকম অপপ্রয়াস সত্ত্বেও মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন।
বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে ভুটান অন্যতম একটি দেশ হলেও, সেখানেই রয়েছে সুখের ঠিকানা_এটি কাল্পনিক কোনো বক্তব্য নয়, গবেষণালব্ধ ফল। দেশটির গড় জাতীয় উৎপাদন নয়, বরং 'গড় জাতীয় সুখ'-এর মানদণ্ডে বিশ্বের শীর্ষে অবস্থান করছে ভুটান। জাতিসংঘ এখন অনুসরণ করছে ভুটানের পদক্ষেপ। ভুটান যে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে, তা অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জিগমে থিনলে সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে বলেছেন, সাধারণ মানুষ যেন ভালোভাবে ও সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে পারে, তাঁরা সে চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। ভুটানের মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ মানুষের বসবাস এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে। এর পরও তারা সুখী। জীবনযাপন, দেশ, সমাজ ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। টাকা-পয়সা ও ধনদৌলত সুখ দিতে পারে_এমনটি বিশ্বাস করে না ভুটানের মানুষ। ভুটানের মানুষের কাছে মানসিক প্রশান্তি অত্যন্ত জরুরি। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া, শিক্ষা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, সবার সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে চলা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা_এসব বিষয়ের ওপর ভুটানের মানুষ জোর দিয়ে থাকে। তাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি ও পর্যটন। কিন্তু সুখ ধরে রাখতে কিংবা এর মাত্রা আরো বাড়াতে দ্বিতীয়টির ওপর তারা কড়াকড়ি আরোপ করেছে। দেশটির নীতিনির্ধারকরা জন-আকাঙ্ক্ষা কিংবা চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে সব কিছু বিবেচনা করেন। আমাদের এমন দিন কবে আসবে? জাতিসংঘ যেখানে ভুটানের পদক্ষেপ অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে আমাদের নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিকরা কি সেদিকে একটু দৃষ্টি দেবেন? ঢাকা থেকে ভুটান খুব বেশি দূরে নয়।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
২০১২ সালের ২ এপ্রিল নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সুখবিষয়ক সম্মেলনে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত 'ওয়ার্ল্ভ্র হ্যাপিনেস রিপোর্ট'-এ যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে, তা হলো টাকা-পয়সা দিয়ে সুখ কেনা যায় না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, প্রযুক্তির বিকাশ, উন্নত জীবনযাত্রার মান একটি দেশের সুখের জন্য যথেষ্ট নয়। ধনী দেশ মাত্রই সে দেশের মানুষ সুখী হবে_এমনও কোনো কথা নেই। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে উলি্লখিত এসব বিষয় যুক্তিযুক্ত। এও সত্য যে সামাজিক নিরাপত্তা, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শান্তি, শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য এবং শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন মানুষকে সুখী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উলি্লখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই রক্তস্নাত বাংলাদেশের চিত্র খুব বিবর্ণ। এই চিত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বপ্নের বাংলাদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। স্বাধীনতা অর্জনের ৪১ বছর ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত হলেও যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে এ দেশের মানুষ বিপুল প্রাণ বিসর্জন এবং রক্ত খরচে দেশটির অভ্যুদয় ঘটিয়েছিল, সব রকম বর্বরতা-পাশবিকতা, অন্যায়-অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এর বেশির ভাগই অর্জিত হয়নি। আর এ জন্যই ওই প্রতিবেদনে সুখী দেশের তালিকায় ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৪তম নির্ণয় হয়েছে। গত আড়াই বছরে যদিও আমাদের দারিদ্র্য কমেছে ১০ শতাংশ, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, শিক্ষা ও গড় আয়ুষ্কালও বেড়েছে, কমেছে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার, তবুও অর্থনীতি ও সামাজিক এসব সূচকের উন্নতি মানুষের সুখী হওয়ার জন্য যে যথেষ্ট নয়, বাংলাদেশের চেয়ে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? সন্দেহ নেই যে অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করায় এটি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। ওই প্রতিবেদনে নাগরিকদের সুখী করার জন্য বেশ কিছু পরামর্শও উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ, সামাজিক ব্যবস্থাকে ফের সঞ্চারিত করা, কার্যকর শ্রম নীতিমালার বাস্তবায়ন, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, জনস্বার্থ সংরক্ষণ এবং সর্বোপরি স্থিতিশীল ও গঠনমূলক রাজনীতি চর্চার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব প্রস্তাবের বেশির ভাগই বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় বাস্তবায়ন দুরূহ শুধু রাষ্ট্র ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রক কিংবা পরিচালকদের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ডের কারণে। এখানে প্রধান সমস্যা রাজনীতি ও তৎসংশ্লিষ্ট আরো কিছু বিষয়। যে রাজনীতি রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিকদের জন্য অপরিহার্য, সে রাজনীতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখান থেকে হারিয়ে গেছে। অথচ এ দেশের যা কিছু শুভ ও কল্যাণকর অর্জন ইতিমধ্যে সাধিত হয়েছে, সবই কিন্তু রাজনীতির মাধ্যমে। রাজনীতির মাঠ থেকে রাজনীতিকদের নানাভাবে হটিয়ে দেওয়ার অপক্রিয়া এখনো অব্যাহত। রাষ্ট্রকে বিরাজনীতিকীকরণের অপক্রিয়াও থেমে নেই। এ সবই একটি দেশ ও সে দেশের জনগণকে অসুখী করার অন্যতম কারণ। নিশ্চয়ই এ বিষয়টি রাজনীতিকরাও অস্বীকার করবেন না।
এ দেশে সাধারণ মানুষের জীবন কাটে অন্তহীন সমস্যার মধ্যে। এখন আর কেবল নিম্ন আয়ের মানুষই নয়, মধ্য ও উচ্চমধ্যবিত্ত, এমনকি যাদের সংগতি যথেষ্ট শক্ত, তাদের জীবনও নানা রকম বিড়ম্বনার ঝড়ে ঝড়াক্রান্ত। এখানে মানুষের আয়ের অর্ধেকের বেশি অর্থ চলে যায় শুধু খাদ্য কিনতেই। আয় বেড়েছে তা অসত্য নয়; কিন্তু আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যয়ও। শুধু যে খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রেই ব্যয় বেড়েছে তা-ই নয়, ব্যয় বেড়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহনসহ জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে। আমাদের সব সমস্যার উৎস হলো দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অদূরদর্শিতা আর সম্পদের অসমচিত্র। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য পায় দল বা ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা। নিরাপত্তাহীনতা অন্যতম একটি উপসর্গ, যা সাধারণ মানুষের সুখ কেড়ে নিয়েছে। উপসর্গ আরো আছে, যা এ দেশের জনজীবনের সব স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছে। এ দেশে সরকারে কিংবা সরকারের বাইরে যাঁরা আছেন, দেশ-জাতির কল্যাণে তাঁদের উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি একটি খেলায় পরিণত হয়েছে। নিজ বা দলীয় স্বার্থটাই তাঁদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। যে দেশে রাজনীতির নামে মানুষ মানুষকে পুড়িয়ে মারতেও কুণ্ঠাবোধ করে না, সে দেশে সুখ কতটা সুদূরপরাহত_এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। এটি একটি মাত্র মর্মন্তুদ ঘটনার উল্লেখ করা গেল_এ রকম নেতিবাচক দৃষ্টান্ত আছে অসংখ্য এবং সচেতন মানুষমাত্রই এসব বিষয়ে জ্ঞাতও। তবে আশার কথা হলো, মানুষকে অচেতন করে রাখার সব রকম অপপ্রয়াস সত্ত্বেও মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন।
বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে ভুটান অন্যতম একটি দেশ হলেও, সেখানেই রয়েছে সুখের ঠিকানা_এটি কাল্পনিক কোনো বক্তব্য নয়, গবেষণালব্ধ ফল। দেশটির গড় জাতীয় উৎপাদন নয়, বরং 'গড় জাতীয় সুখ'-এর মানদণ্ডে বিশ্বের শীর্ষে অবস্থান করছে ভুটান। জাতিসংঘ এখন অনুসরণ করছে ভুটানের পদক্ষেপ। ভুটান যে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে, তা অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জিগমে থিনলে সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে বলেছেন, সাধারণ মানুষ যেন ভালোভাবে ও সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে পারে, তাঁরা সে চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। ভুটানের মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ মানুষের বসবাস এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে। এর পরও তারা সুখী। জীবনযাপন, দেশ, সমাজ ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। টাকা-পয়সা ও ধনদৌলত সুখ দিতে পারে_এমনটি বিশ্বাস করে না ভুটানের মানুষ। ভুটানের মানুষের কাছে মানসিক প্রশান্তি অত্যন্ত জরুরি। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া, শিক্ষা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, সবার সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে চলা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা_এসব বিষয়ের ওপর ভুটানের মানুষ জোর দিয়ে থাকে। তাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি ও পর্যটন। কিন্তু সুখ ধরে রাখতে কিংবা এর মাত্রা আরো বাড়াতে দ্বিতীয়টির ওপর তারা কড়াকড়ি আরোপ করেছে। দেশটির নীতিনির্ধারকরা জন-আকাঙ্ক্ষা কিংবা চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে সব কিছু বিবেচনা করেন। আমাদের এমন দিন কবে আসবে? জাতিসংঘ যেখানে ভুটানের পদক্ষেপ অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে আমাদের নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিকরা কি সেদিকে একটু দৃষ্টি দেবেন? ঢাকা থেকে ভুটান খুব বেশি দূরে নয়।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments