প্রতিক্রিয়া: পারিবারিক আইন সংস্কারের চিন্তাভাবনা-বাস্তবায়িত হলে জটিলতা বাড়বে by সোহেল রানা
আইন কমিশনের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে পারিবারিক আইনের পর্যালোচনা’ শীর্ষক জাতীয় কর্মশালায় উপস্থিত থাকার সুযোগ না ঘটলেও প্রথম আলোর ‘আইন অধিকার’ পাতার কল্যাণে সে বিষয়ে বিশদ অবহিত হওয়া সম্ভব হয়েছে এবং পারিবারিক আদালতের একজন বিচারক হিসেবে ওই বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাও রয়েছে।
পারিবারিক (মুসলিম) আইনের দুটি বিষয়ের ওপর অভিমত জানানোর প্রয়োজন মনে করছি।
দাম্পত্য-স্বত্ব পুনরুদ্ধার
দাম্পত্য-স্বত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা করার সুযোগ উভয় পক্ষের থাকলেও বাস্তবে স্বামীকেই তা করতে দেখা যায়; বিদ্যমান আইনব্যবস্থায় বিকল্প বা পরোক্ষ প্রতিকার গ্রহণের সুযোগ রয়েছে বিধায় কোনো স্ত্রীকে সে পথে খুব একটা যেতে দেখা যায় না। এ বিষয়ে ওই কর্মশালায় গৃহীত প্রস্তাবনা ছিল দাম্পত্য-স্বত্ব পুনরুদ্ধারের বিষয়টি পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ সালের এখতিয়ারবহির্ভূত করা (মোদ্দা কথায় আলাদা বসবাসকারী স্ত্রীকে নিজের কাছে পাওয়ার জন্য আদালতে মামলা করার বিদ্যমান সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া)। আমার মতে, এতে করে পারিবারিক স্বেচ্ছাচারিতা আরও বেড়ে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। ‘কোনো মেয়েই চায় না স্বামীর ঘর ছাড়তে’ কথাটি আগে বহুলবিশ্বাস্য হলেও বর্তমানে অবস্থা আর সে পর্যায়ে নেই। একজন স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে দূরে বসবাস করলেও স্বামী তালাক না দেওয়ায় এবং নিজেরও তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটানোর ক্ষমতা বা যৌক্তিক সুযোগ না থাকায় স্বামীর ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে যৌতুক দাবির মিথ্যা অভিযোগে ফৌজদারি বা আলাদা ভরণপোষণের দাবিতে পারিবারিক মামলা দায়ের করে বসেন। অথচ যথেষ্ট যৌক্তিক কারণে ওই স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক চুকে দেওয়ার ইচ্ছা বা সামর্থ্য (তালাক দিলে বিলম্বিত দেনমোহর পরিশোধের দায়ও সৃষ্টি হয়) কোনোটিই হয়তো নির্দোষ ও নাদান ওই স্বামীর নেই; বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাস্তবতা হয়তো এমনও যে তাঁর মূল্যবান ও অমূল্য সব সম্পদ ও সময় ইতিমধ্যে ওই স্ত্রীর পেছনেই ব্যয়িত হয়ে আছে। এরূপ অবস্থায় ওই স্বামীটির একমাত্র রেহাই হচ্ছে স্ত্রীকে পাওয়ার জন্য দাম্পত্য-স্বত্ব পুনরুদ্ধারের দাবিতে পারিবারিক মামলা করা। মামলায় ডিক্রি দেওয়া হলেও দায়িক-স্ত্রীকে তা জোর করে প্রতিপালনে বাধ্য করা যাবে না মর্মেও রায়ে বলে দেওয়া থাকে। ফলে নাদান স্বামীটি দাম্পত্য-স্বত্ব পুনরুদ্ধারের ডিক্রি পেলেও স্ত্রীকে নিজের কাছে পাবেন কি না, তা যদিও ওই স্ত্রীর ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে, তবু ডিক্রিটি ওই স্ত্রীরই দায়েরি অন্যান্য মামলা বা অভিযোগ মোকাবিলায় আইনি বর্ম হিসেবে কাজে দেয়।
স্ত্রীর ভরণপোষণ
এ বিষয়ে কর্মশালায় গৃহীত প্রস্তাবনার মূল প্রতিপাদ্য ছিল ভরণপোষণের হার নির্ধারণে সালিসি পরিষদের ক্ষমতা বাড়ানো। এটা করার প্রয়োজন বা সুযোগ কোনোটিই নেই। স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে অপর্যাপ্তভাবে বা একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলকভাবে ভরণপোষণ দেওয়ার ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ করার যে সুযোগ ১৯৬১ সালের ‘মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ’-এ রয়েছে, তা শুধু বৈবাহিক-সম্পর্ক বজায় আছে এমন স্ত্রীদের জন্য প্রযোজ্য, তালাকপ্রাপ্তদের নয়। আবার সেসব ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের (সালিসি পরিষদ) প্রদত্ত সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত নয় বা তা আইনত কার্যকর করারও সুযোগ নেই; রায়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সহকারী জজ আদালতে রিভিশন করার সুযোগও রয়েছে। ফলে সরাসরি সহকারী জজের আদালতে ভরণপোষণের দাবিতে পারিবারিক মামলা করে ফেলাই বিবেচনাপ্রসূত এবং বাস্তবে হচ্ছেও তা-ই। পারিবারিক আদালতের বিচারক হিসেবে ভরণপোষণের প্রাপ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের চাহিদা ও সামর্থ্য এবং জীবনযাপনের খরচ বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং ব্যয় ক্রমবর্ধনশীল হওয়ায় ভবিষ্যৎ-ভরণপোষণের ক্ষেত্রে ডিক্রির সময় নির্ধারণ করা হারের সঙ্গে বার্ষিক বৃদ্ধির (ইনক্রিমেন্ট) বিধানও যুক্ত রাখা হয়। এমনকি স্বাভাবিক ভরণপোষণ-ব্যয় হিসেবে ডিক্রিতে যে মাসভিত্তিক পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তার সঙ্গে কখনো কখনো এ-ও বলে দেওয়া হয় যে নিজ বা বাচ্চার পড়াশোনা বা বিয়ে, চিকিৎসা প্রভৃতি যেসব ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হয়, তা মেটানোর ভারও স্বামী-বিবাদীরই থাকবে।
তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্ত্রীর বয়স যা-ই হোক, ইদ্দতকালের বাইরে ভরণপোষণ পাওয়ার সুযোগ যেহেতু বন্ধ হয়েই গেছে, সেহেতু তা আর ঘোরানোর চেষ্টা সমীচীন হবে না। বয়স্ক একজন মহিলা স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত হলে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে যেমন বঞ্চিত হন, তেমনি দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণের সুযোগ বা ইচ্ছাও তাঁর আর থাকে না, সে ক্ষেত্রে তাঁর একমাত্র সহায় হতে পারে দেনমোহরের বিলম্বিত অংশ হাতে পাওয়া। মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর থাকা বাধ্যতামূলক করা এবং অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণের ‘বিলম্বিত’ অংশকে স্বামীহারা হওয়ার পর প্রাপ্তির যে বিধান ইসলাম ধর্মে রয়েছে, তার অন্যতম উদ্দেশ্যই হচ্ছে সে রূপ মানবেতর পরিস্থিতির শিকার হওয়া একজন নারীকে পরিত্রাণ দেওয়া। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, তালাকদাতা স্বামী বিয়ের অনেক দিন পর এসে দেনমোহর পরিশোধ করার সুযোগ নিলেও তাঁকে কিন্তু বিয়ের সময় ধার্য করা পরিমাণের বাইরে এক টাকাও অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে না। বিয়ের সময় ধার্য করা দেনমোহরের পরিমাণ পরবর্তী সময় যেহেতু উভয় পক্ষের সম্মতিতে বৃদ্ধি করার সুযোগ ধর্মে রয়েছে, সেহেতু প্রত্যেক নারীর বিবাহকালীন দেনমোহরের পরিমাণ যাতে পরিশোধকালের সময়ানুপাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বৃদ্ধি পায়, তার বিধান করার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। বিয়ের সময় পক্ষগণ দেনমোহর ধার্য করার পাশাপাশি কত বছর পর পরিশোধিত হলে স্বামীকে কত টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে, সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতে পারেন এবং কাবিননামায়ও তা অন্তর্ভুক্ত থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
লেখক সিনিয়র সহকারী জজ, গাইবান্ধা
No comments