সময়চিত্র-আওয়ামী লীগ: হলুদ কার্ডের পর by আসিফ নজরুল
গত বছর ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে অপেক্ষা করছি শহীদ মিনারের বেদিতে। একুশের প্রথম প্রহরে ফুল দিতে আসবেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মন্ত্রিসভা ও দলের নেতারা এ জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁরা শহীদ মিনারের বাঁ দিকে দাঁড়ান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃস্থানীয় শিক্ষকেরা সারি বেঁধে দাঁড়ান মিনারের ডান দিকে।
বহু বছর ধরে এটাই নিয়ম, এটাই রীতি। গত বছর তার আকস্মিক ব্যতিক্রম ঘটে। শিক্ষকদের সারির দিকে লম্বা লম্বা কিছু কর্মী নিয়ে এগিয়ে আসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। কারও কাছে জিজ্ঞেস না করে দলের কর্মীদের তিনি ফুলের তোড়া দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের ঠিক সামনে। শিক্ষকেরা বিমূঢ় হয়ে তাকান এ-ওর দিকে। কেউ কেউ খেদোক্তি করেন। সামনে আওয়ামী লীগের কর্মীরা অস্বস্তি নিয়ে উসখুস করেন। তাঁদের কিছু করার নেই, সাধারণ সম্পাদক নিজে এসে দাঁড় করিয়ে গেছেন!
আমার তখনই মনে হলো, সৈয়দ আশরাফের মতো সজ্জন ব্যক্তি এই কাজটি করেছেন সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞতা থেকে, অজ্ঞানতা থেকে। একুশের রাতের বহু বছরের নিয়ম যিনি জানেন না, বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক কিছু তাঁর না জানার কথা। জীবনের বড় একটা সময় তিনি কাটিয়েছেন বিদেশে, রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণও তাঁর বেশি নয়। এক-এগারো না ঘটলে এবং সভানেত্রী দলের বহু জ্যেষ্ঠ নেতার প্রতি রুষ্ট না হলে আওয়ামী লীগের মতো সুপ্রাচীন দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কথা নয় তাঁর। একই কথা প্রযোজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ আরও অনেক সম্পাদকের ক্ষেত্রে।
নেতৃত্বে এই অনভিজ্ঞতার সঙ্গে পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের সম্পর্ক রয়েছে। দুই বছর আগের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপির তুলনায় প্রায় সাত গুণ বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। সে তুলনায় এবার দলীয় ভিত্তিতে পরিচালিত পৌরসভা নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়েছে বিএনপির প্রায় সমান আসনে। এই বিপর্যয়ের একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে দলের ভেতরের শৃঙ্খলা আর ঐক্যের অভাবকে এবং দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রাবল্যকে। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের কাছে শুনেছি, অতীতেও এমন হতো, বিরোধ মেটাতে কাজ করতেন দলের তখনকার প্রথম সারির নেতারা। স্থানীয় পর্যায়ে বহু নেতার রাজনীতিতে হাতেখড়ি তাঁদের হাতে, কাজেই তাঁদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে কাজ হতো, নির্বাচনী লড়াইয়ে ঐক্যের সমস্যা হতো না আওয়ামী লীগে। স্থানীয় পর্যায়ের এমন বহু নেতাকে আওয়ামী লীগের এখনকার কেন্দ্রীয় নেতারা নাকি চেনেনই না ভালো করে। এমনকি তাঁদের কেউ কেউ রাজনীতিতে স্থানীয় অনেক নেতার চেয়ে বহুলাংশে নবাগত। কাজেই স্থানীয় বিরোধ মেটানোতে, দলের শৃঙ্খলা ও ঐক্য রক্ষা করতে, দলের সাংগঠনিক শক্তিকে সংহত করতে এখনকার কেন্দ্রীয় নেতাদের সফল হওয়ার কথা নয়। নিজের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা দিয়ে দলের প্রার্থীকে সাহায্য করার যোগ্যতাও নেই কারও কারও। গত দুই বছরে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের তাণ্ডবলীলা বন্ধে বা দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে এই নেতৃত্ব কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা জ্বালানিসংকটের ব্যর্থতার দায় সরকারের, এখানে দলকে সরাসরি দায়ী করা কঠিন। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি আর দুর্নীতি-অনিয়মের রাশ টেনে ধরতে যে ব্যর্থতা, তা অনেকাংশে দলেরও। এগুলো পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের বড় কারণ হলে দলের নেতৃত্ব তার জন্য কিছুটা হলেও দায়ী।
২.
দলের মতো অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতা আছে সরকারের ভেতর। দলের পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ নেতাদের প্রায় পুরোপুরি বাদ দিয়ে নতুনদের নিয়ে যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে, তা মানুষের মনে আশাবাদ জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। মেয়াদের দুই বছর শেষে প্রায় সব রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিরোধী দলের কোনো কোনো নেতা মতিয়া চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম নাহিদের মতো দু-একজন মন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মন্ত্রিসভায় নবাগতদের অধিকাংশই সমালোচিত হয়েছেন নানা কারণে। বাণিজ্যমন্ত্রী বারবার ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়েছেন, দ্রব্যমূল্য কমেনি; পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শ্রমমন্ত্রী নানা আশার বাণী শুনিয়েছেন, কিন্তু বিদেশে কর্মসংস্থান সমস্যা দূর হয়নি; আইনমন্ত্রী বিচার বিভাগের স্বাধীনতার গুণগান গেয়েছেন, মানুষ এর কোনো সারবত্তা পায়নি; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরোধী দলের প্রতি যুদ্ধংদেহি থেকেছেন, কিন্তু নিজ দলের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি যে অপারগ বা অসমর্থ, তা মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এ ছাড়া কিছু প্রতিমন্ত্রীর লাগামহীন এবং কখনো কখনো অরুচিকর বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে সব মহল থেকে। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছে কোনো কোনো উপদেষ্টার আপত্তিকর ক্ষমতার দাপট। অসাংবিধানিক ও নজিরবিহীনভাবে তাঁরা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিতি থেকেছেন, কেউ মন্ত্রীদের ওপর খবরদারি করেছেন, কেউ প্রশাসনে দলীয়করণের গডফাদার সেজেছেন, কেউ পিলে চমকানো কথা বলে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছেন। সামগ্রিকভাবে সরকারের অনেকে যতটা মানুষের অভাব-অভিযোগের দিকে মনোযোগী ছিলেন, তার চেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন বিরোধী দল ও বিরোধী কণ্ঠ দমনে, এমনকি নাগরিক সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি ও মহলগুলোকে বিরোধী শিবিরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টায়।
সরকার ও দলের ব্যর্থতার সঙ্গে পৌরসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের সম্পর্ক ঠিক কতটুকু, কোনো গবেষণা ছাড়া তা বলা সম্ভব নয়। তবে সরকারের দুই বছর উপলক্ষে প্রধান কিছু পত্রিকার জরিপ এবং গত ছয় মাসে বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত অনলাইন জরিপে মানুষ অব্যাহতভাবে সরকারের বিভিন্ন কাজে (বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য, সন্ত্রাস, গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকট, বিরোধী দলের প্রতি মামলা-হামলা) তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। এই অসন্তুষ্টির আঁচ সম্পূর্ণ দলীয় ভিত্তিতে পরিচালিত পৌরসভা নির্বাচনের ভোটারদের অনেকের মনে থাকাই স্বাভাবিক।
স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় উন্নয়ন এবং দাবিদাওয়ার বিষয়টিও ভোটারদের মনে থাকে। কিন্তু এটি ভোটারদের একটি অংশের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল বলে মনে হয় না। তা-ই যদি হতো, তাহলে মানুষ কাতারবন্দী হয়ে কেবল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভোট দিত। সচেতন ভোটাররা জানেন, স্থানীয় উন্নয়নে সরকারের টাকা ও আনুকূল্য বিএনপির মেয়রের চেয়ে অনেক বেশি আওয়ামী লীগের মেয়ররা পাবেন। এটি জেনেও গত সংসদ নির্বাচনের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি অনুপাতে তাঁরা বিএনপির লোকদের নির্বাচন করছেন। তার অন্যতম যৌক্তিক ব্যাখ্যা এটি যে সরকার ও আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে তাঁরা অসন্তুষ্ট। স্থানীয় উন্নয়ন কম হতে পারে—এটি জেনেও তাঁদের অনেকে হয়তো শুধু প্রতিবাদ হিসেবে বিএনপির নেতাদের ভোট দিয়েছেন। কাজেই পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল শুধু প্রার্থীর নয়, সরকার ও সরকারি দলের বিপর্যয় হিসেবে দেখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
৩.
পৃথিবীর বহু দেশে মধ্যবর্তী সময়ে সরকারের জনপ্রিয়তা কতটুকু, তা বোঝার নানা পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে দুই কক্ষের নির্বাচন ভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠান, জনপ্রতিনিধি নির্বাচন বিভিন্ন পর্যায়ে আয়োজন, ভোটারদের কর্তৃক সাংসদদের প্রত্যাহার করার সুযোগ, দল কর্তৃক সরকারের; বিশেষ করে, সরকারপ্রধানের সমালোচনার সুযোগ। আমাদের সংবিধানের পশ্চাৎপদ ৭০ অনুচ্ছেদের মতো বিধান অধিকাংশ পশ্চিমা দেশে না থাকার কারণে সরকারি দলের সাংসদদের রয়েছে সরকারের বা কোনো মন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা প্রকাশের অবারিত সুযোগ। অনেক বেশি পেশাদারির ভিত্তিতে পরিচালিত সেখানকার জনমত জরিপগুলোও হয়ে ওঠে সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থনের মাত্রার নির্দেশক।
আমাদের দেশে এসব ব্যবস্থা নেই। ফলে সরকারের প্রায় মধ্যবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত এই পৌরসভা নির্বাচন হয়ে উঠেছে সরকারের জনপ্রিয়তা বোঝার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্দেশক। এর ফলাফল সরকারের জন্য অবশ্যই একটি সতর্কবার্তা। বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা সরকারকে বলেছেন নির্বাচনের ফলাফল হলুদ কার্ড হিসেবে দেখার জন্য। তিনি বাকি যা বলেছেন, তা আমরা বলতে চাই না। কারণ, ফুটবলের নিয়মিত দর্শকমাত্রই জানেন, হলুদ কার্ড পাওয়া বহু খেলোয়াড় বাকি সময়ে সতর্কভাবে ও ভালোভাবে খেলেছেন, দলকে বিজয়ী করেছেন। সরকারেরও এ সুযোগ রয়েছে। বাকি তিন বছর সরকার ঠিকভাবে দেশ চালালে এই আওয়ামী লীগই পারবে আগামী সংসদ নির্বাচনে জিতে আসতে।
তবে এ জন্য সরকারকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইতিহাস বলে, ঠিকভাবে দেশ চালানো মানে মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক মনোযোগ দেওয়া, নিজ দলের সন্ত্রাস আর দুর্নীতি সবচেয়ে আগে দমন করা, বিরোধী দল ও সমালোচকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখানো, সংসদ, বিচারালয়, বিভিন্ন কমিশন আর গণমাধ্যমকে স্বাধীন ও দক্ষভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং অন্য দেশের সঙ্গে চুক্তি ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজের স্বার্থ ও সম্মানকে রক্ষা করা।
আওয়ামী লীগের জন্য এখনো একটি বড় প্লাস পয়েন্ট জঙ্গি রাজনীতি রোধে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তার অঙ্গীকার। কিন্তু শুধু এগুলো দিয়ে আগামী নির্বাচনে জিতে আসা যাবে না। একজন প্রবীণ বিশ্লেষক লিখেছেন, ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সাফল্যজনকভাবে করতে পারলেই সরকারের সব ব্যর্থতা মানুষ ভুলে যাবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও এমন কিছু ভেবে থাকলে ভুল করবেন বলে আমার ধারণা। দেশের অধিকাংশ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তবে পেটে ক্ষুধা থাকলে, ঘর আলোহীন থাকলে, মনে সন্ত্রাসের ভয় থাকলে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে—শুধু এই সান্ত্বনা নিয়ে মানুষ আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে ভোট দেবে বলে মনে হয় না।
আসিফ নজরুল: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক।
আমার তখনই মনে হলো, সৈয়দ আশরাফের মতো সজ্জন ব্যক্তি এই কাজটি করেছেন সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞতা থেকে, অজ্ঞানতা থেকে। একুশের রাতের বহু বছরের নিয়ম যিনি জানেন না, বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক কিছু তাঁর না জানার কথা। জীবনের বড় একটা সময় তিনি কাটিয়েছেন বিদেশে, রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণও তাঁর বেশি নয়। এক-এগারো না ঘটলে এবং সভানেত্রী দলের বহু জ্যেষ্ঠ নেতার প্রতি রুষ্ট না হলে আওয়ামী লীগের মতো সুপ্রাচীন দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কথা নয় তাঁর। একই কথা প্রযোজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ আরও অনেক সম্পাদকের ক্ষেত্রে।
নেতৃত্বে এই অনভিজ্ঞতার সঙ্গে পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের সম্পর্ক রয়েছে। দুই বছর আগের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপির তুলনায় প্রায় সাত গুণ বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। সে তুলনায় এবার দলীয় ভিত্তিতে পরিচালিত পৌরসভা নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়েছে বিএনপির প্রায় সমান আসনে। এই বিপর্যয়ের একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে দলের ভেতরের শৃঙ্খলা আর ঐক্যের অভাবকে এবং দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রাবল্যকে। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের কাছে শুনেছি, অতীতেও এমন হতো, বিরোধ মেটাতে কাজ করতেন দলের তখনকার প্রথম সারির নেতারা। স্থানীয় পর্যায়ে বহু নেতার রাজনীতিতে হাতেখড়ি তাঁদের হাতে, কাজেই তাঁদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে কাজ হতো, নির্বাচনী লড়াইয়ে ঐক্যের সমস্যা হতো না আওয়ামী লীগে। স্থানীয় পর্যায়ের এমন বহু নেতাকে আওয়ামী লীগের এখনকার কেন্দ্রীয় নেতারা নাকি চেনেনই না ভালো করে। এমনকি তাঁদের কেউ কেউ রাজনীতিতে স্থানীয় অনেক নেতার চেয়ে বহুলাংশে নবাগত। কাজেই স্থানীয় বিরোধ মেটানোতে, দলের শৃঙ্খলা ও ঐক্য রক্ষা করতে, দলের সাংগঠনিক শক্তিকে সংহত করতে এখনকার কেন্দ্রীয় নেতাদের সফল হওয়ার কথা নয়। নিজের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা দিয়ে দলের প্রার্থীকে সাহায্য করার যোগ্যতাও নেই কারও কারও। গত দুই বছরে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের তাণ্ডবলীলা বন্ধে বা দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে এই নেতৃত্ব কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা জ্বালানিসংকটের ব্যর্থতার দায় সরকারের, এখানে দলকে সরাসরি দায়ী করা কঠিন। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি আর দুর্নীতি-অনিয়মের রাশ টেনে ধরতে যে ব্যর্থতা, তা অনেকাংশে দলেরও। এগুলো পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের বড় কারণ হলে দলের নেতৃত্ব তার জন্য কিছুটা হলেও দায়ী।
২.
দলের মতো অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতা আছে সরকারের ভেতর। দলের পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ নেতাদের প্রায় পুরোপুরি বাদ দিয়ে নতুনদের নিয়ে যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে, তা মানুষের মনে আশাবাদ জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। মেয়াদের দুই বছর শেষে প্রায় সব রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিরোধী দলের কোনো কোনো নেতা মতিয়া চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম নাহিদের মতো দু-একজন মন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মন্ত্রিসভায় নবাগতদের অধিকাংশই সমালোচিত হয়েছেন নানা কারণে। বাণিজ্যমন্ত্রী বারবার ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়েছেন, দ্রব্যমূল্য কমেনি; পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শ্রমমন্ত্রী নানা আশার বাণী শুনিয়েছেন, কিন্তু বিদেশে কর্মসংস্থান সমস্যা দূর হয়নি; আইনমন্ত্রী বিচার বিভাগের স্বাধীনতার গুণগান গেয়েছেন, মানুষ এর কোনো সারবত্তা পায়নি; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরোধী দলের প্রতি যুদ্ধংদেহি থেকেছেন, কিন্তু নিজ দলের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি যে অপারগ বা অসমর্থ, তা মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এ ছাড়া কিছু প্রতিমন্ত্রীর লাগামহীন এবং কখনো কখনো অরুচিকর বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে সব মহল থেকে। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছে কোনো কোনো উপদেষ্টার আপত্তিকর ক্ষমতার দাপট। অসাংবিধানিক ও নজিরবিহীনভাবে তাঁরা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিতি থেকেছেন, কেউ মন্ত্রীদের ওপর খবরদারি করেছেন, কেউ প্রশাসনে দলীয়করণের গডফাদার সেজেছেন, কেউ পিলে চমকানো কথা বলে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছেন। সামগ্রিকভাবে সরকারের অনেকে যতটা মানুষের অভাব-অভিযোগের দিকে মনোযোগী ছিলেন, তার চেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন বিরোধী দল ও বিরোধী কণ্ঠ দমনে, এমনকি নাগরিক সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি ও মহলগুলোকে বিরোধী শিবিরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টায়।
সরকার ও দলের ব্যর্থতার সঙ্গে পৌরসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের সম্পর্ক ঠিক কতটুকু, কোনো গবেষণা ছাড়া তা বলা সম্ভব নয়। তবে সরকারের দুই বছর উপলক্ষে প্রধান কিছু পত্রিকার জরিপ এবং গত ছয় মাসে বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত অনলাইন জরিপে মানুষ অব্যাহতভাবে সরকারের বিভিন্ন কাজে (বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য, সন্ত্রাস, গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকট, বিরোধী দলের প্রতি মামলা-হামলা) তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। এই অসন্তুষ্টির আঁচ সম্পূর্ণ দলীয় ভিত্তিতে পরিচালিত পৌরসভা নির্বাচনের ভোটারদের অনেকের মনে থাকাই স্বাভাবিক।
স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় উন্নয়ন এবং দাবিদাওয়ার বিষয়টিও ভোটারদের মনে থাকে। কিন্তু এটি ভোটারদের একটি অংশের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল বলে মনে হয় না। তা-ই যদি হতো, তাহলে মানুষ কাতারবন্দী হয়ে কেবল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভোট দিত। সচেতন ভোটাররা জানেন, স্থানীয় উন্নয়নে সরকারের টাকা ও আনুকূল্য বিএনপির মেয়রের চেয়ে অনেক বেশি আওয়ামী লীগের মেয়ররা পাবেন। এটি জেনেও গত সংসদ নির্বাচনের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি অনুপাতে তাঁরা বিএনপির লোকদের নির্বাচন করছেন। তার অন্যতম যৌক্তিক ব্যাখ্যা এটি যে সরকার ও আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে তাঁরা অসন্তুষ্ট। স্থানীয় উন্নয়ন কম হতে পারে—এটি জেনেও তাঁদের অনেকে হয়তো শুধু প্রতিবাদ হিসেবে বিএনপির নেতাদের ভোট দিয়েছেন। কাজেই পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল শুধু প্রার্থীর নয়, সরকার ও সরকারি দলের বিপর্যয় হিসেবে দেখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
৩.
পৃথিবীর বহু দেশে মধ্যবর্তী সময়ে সরকারের জনপ্রিয়তা কতটুকু, তা বোঝার নানা পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে দুই কক্ষের নির্বাচন ভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠান, জনপ্রতিনিধি নির্বাচন বিভিন্ন পর্যায়ে আয়োজন, ভোটারদের কর্তৃক সাংসদদের প্রত্যাহার করার সুযোগ, দল কর্তৃক সরকারের; বিশেষ করে, সরকারপ্রধানের সমালোচনার সুযোগ। আমাদের সংবিধানের পশ্চাৎপদ ৭০ অনুচ্ছেদের মতো বিধান অধিকাংশ পশ্চিমা দেশে না থাকার কারণে সরকারি দলের সাংসদদের রয়েছে সরকারের বা কোনো মন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা প্রকাশের অবারিত সুযোগ। অনেক বেশি পেশাদারির ভিত্তিতে পরিচালিত সেখানকার জনমত জরিপগুলোও হয়ে ওঠে সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থনের মাত্রার নির্দেশক।
আমাদের দেশে এসব ব্যবস্থা নেই। ফলে সরকারের প্রায় মধ্যবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত এই পৌরসভা নির্বাচন হয়ে উঠেছে সরকারের জনপ্রিয়তা বোঝার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্দেশক। এর ফলাফল সরকারের জন্য অবশ্যই একটি সতর্কবার্তা। বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা সরকারকে বলেছেন নির্বাচনের ফলাফল হলুদ কার্ড হিসেবে দেখার জন্য। তিনি বাকি যা বলেছেন, তা আমরা বলতে চাই না। কারণ, ফুটবলের নিয়মিত দর্শকমাত্রই জানেন, হলুদ কার্ড পাওয়া বহু খেলোয়াড় বাকি সময়ে সতর্কভাবে ও ভালোভাবে খেলেছেন, দলকে বিজয়ী করেছেন। সরকারেরও এ সুযোগ রয়েছে। বাকি তিন বছর সরকার ঠিকভাবে দেশ চালালে এই আওয়ামী লীগই পারবে আগামী সংসদ নির্বাচনে জিতে আসতে।
তবে এ জন্য সরকারকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইতিহাস বলে, ঠিকভাবে দেশ চালানো মানে মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক মনোযোগ দেওয়া, নিজ দলের সন্ত্রাস আর দুর্নীতি সবচেয়ে আগে দমন করা, বিরোধী দল ও সমালোচকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখানো, সংসদ, বিচারালয়, বিভিন্ন কমিশন আর গণমাধ্যমকে স্বাধীন ও দক্ষভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং অন্য দেশের সঙ্গে চুক্তি ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজের স্বার্থ ও সম্মানকে রক্ষা করা।
আওয়ামী লীগের জন্য এখনো একটি বড় প্লাস পয়েন্ট জঙ্গি রাজনীতি রোধে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তার অঙ্গীকার। কিন্তু শুধু এগুলো দিয়ে আগামী নির্বাচনে জিতে আসা যাবে না। একজন প্রবীণ বিশ্লেষক লিখেছেন, ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সাফল্যজনকভাবে করতে পারলেই সরকারের সব ব্যর্থতা মানুষ ভুলে যাবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও এমন কিছু ভেবে থাকলে ভুল করবেন বলে আমার ধারণা। দেশের অধিকাংশ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তবে পেটে ক্ষুধা থাকলে, ঘর আলোহীন থাকলে, মনে সন্ত্রাসের ভয় থাকলে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে—শুধু এই সান্ত্বনা নিয়ে মানুষ আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে ভোট দেবে বলে মনে হয় না।
আসিফ নজরুল: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক।
No comments